২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইফতারের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য

ইফতারের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য - নয়া দিগন্ত

ইফতার রমজানের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ইফতার ইবাদত। মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্মারক। ইফতার হলো রমজানে রোজা ভাঙায় মুসলমানদের সূর্যাস্তের সময় খাওয়া খাবারের নাম। ইফতার নিজে করা যেমন সওয়াবের কাজ তেমনি যতজন রোজাদার ইফতার করাবে, ততটা রোজার সওয়াব আমলনামায় যুক্ত হবে। বাংলাদেশসহ গোটা মুসলিম দুনিয়ায় ভ্রাতৃত্বের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মুসলমানরা ইফতারের আয়োজন করে থাকেন। ইফতার পালন মুসলিমদের জন্য একটি আনন্দঘন অনুষ্ঠান। এটি তাদের ধর্মীয় কর্তব্য পালনের পাশাপাশি সামাজিক বন্ধন আরো দৃঢ় করে। মুসলমানদের সারা দিনের রোজা ভাঙার এবং একসাথে খাওয়ার একটি উপলক্ষ। ইফতার আত্মত্যাগ, ধৈর্য এবং সহানুভূতির শিক্ষা দেয়।

দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও পথশিশুসহ যেকোনো স্তরের মানুষ এতে অংশগ্রহণ করতে পারে। এটি মুসলিমদের সারাদিন রোজা রাখার পর পুনরুজ্জীবিত হতে সাহায্য করে। এটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানও যা পরিবার, স্বজন ও সাধারণ রোজাদারদের একত্রিত করে। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের পাশাপাশি উত্তরাধিকার ঐতিহ্য লালনের একটি আকুতি লক্ষ করা যায় ইফতার আয়োজনে। ইউনেস্কো ২০২৩ সালে মুসলিমদের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় রীতি ইফতারকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আওতাভুক্ত করে। ইউনেস্কোর ভাষায়- ইফতার রমজান মাসে সব ধরনের ধর্মীয় বিধান মানার পর সূর্যাস্তের সময় মুসলিমদের পালনীয় রীতি। সংস্থাটি মনে করে, এ ধর্মীয় রীতি পরিবার ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করে এবং দান, সৌহার্দের মতো বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসে।

স্বাস্থ্য ও পুষ্টির দিক থেকে ইফতার গুরুত্বপূর্ণ হলেও এর আধ্যাত্মিক অর্থ ও তাৎপর্যও রয়েছে। আল্লাহ ইফতারের সময় রোজাদারদের প্রতি বিশেষ করুণা ও ভালোবাসা দেখান; বিশেষ করে যারা ইফতারের সময় অন্যদের জন্য খাবার সরবরাহ করেন তাদের প্রতি। সহমর্মিতার চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে দেশের প্রায় সব মসজিদে গণইফতারের আয়োজন করা হয়।

এ দেশে বহু পুরনো আমল থেকে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ইফতার পার্টির আয়োজন চলে আসছে। স্বাধীনতা-উত্তর ও স্বাধীনতা পূর্বকাল থেকে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দল ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে আসছে। চলতি বছর ইফতার মাহফিলের আয়োজন নিয়ে বিতর্ক ও সঙ্ঘাত তৈরি হয়েছে, যা আগে কখনো হয়নি। ১৪ মার্চ থেকে শহীদ জিয়া মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ক্যাম্পাসের মসজিদের ‘ইফতার কার্যক্রম স্থগিত’ লেখা নোটিশ টাঙিয়ে দেয়া হয়। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তি জারি করে ক্যাম্পাসে ইফতার আয়োজন নিষিদ্ধ করে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ক্যাম্পাসে রমজানে ইফতার আয়োজন বন্ধ করে দেয়। এর আগে ১৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের ছাত্ররা ‘বঙ্গবন্ধু টাওয়ার’ ভবনের মসজিদে ‘প্রোডাকটিভ রমজান’ শীর্ষক আয়োজিত ইফতার মাহফিলে একদল দুর্বৃত্ত হামলা চালিয়ে কয়েকজন ছাত্রকে রক্তাক্ত করে। ফেনী সরকারি কলেজে ছাত্ররা ইফতারের আয়োজন করায় দুর্বৃত্তরা আয়োজকদের আটজনকে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় রমজানকে স্বাগত জানিয়ে কুরআন তিলাওয়াত অনুষ্ঠান আয়োজনের সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীদের কেন শাস্তি দেয়া হবে না তার জবাব চেয়ে আরবি বিভাগের চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছেন কলা অনুষদের ডিন। ডিনের অভিযোগ ছাত্ররা অনুমতি নেয়নি। নয়া দিগন্তের সাথে এক সাক্ষাৎকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরবি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. যোবায়ের মোহাম্মদ এহসানুল হক বলেন, ‘এখানে কোনো একটি অপতৎপরতা চলছে। শিক্ষার্থীরা কুরআন তিলাওয়াত করছে। অনৈতিক কাজ তো করছে না। তাহলে কেন এত সমস্যা? কতশত প্রোগ্রাম এখানে হয় তখন তো কোনো অনুমতি লাগে না। তাহলে কুরআন তিলাওয়াতের প্রোগ্রামে কী সমস্যা আমি বুঝি না।’ দ্বিতীয় রমজানের দিন অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ইফতার পার্টি না করতে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। রোজা শুরুর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে ইফতার পার্টি না করার ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোজা শুরুর পর আবারো একই নির্দেশনা দিলেন। তিনি বলেন, যারা ইফতারে আগ্রহী ও সাধ্য আছে তারা যেন সেই ইফতার পার্টির টাকা নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ায়। মূলত অপচয় রোধ, বিলাসিতা বর্জন ও কৃচ্ছ্রতা সাধনের লক্ষ্যে সরকারিভাবে ইফতার আয়োজন না করার ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একই সাথে এ নির্দেশনা গ্রহণ করেছে তার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারীর বক্তব্যে তার প্রমাণ রয়েছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, গতবারও কিন্তু আওয়ামী লীগ থেকে এবং প্রধানমন্ত্রীর গণভবনে কোনো ইফতার পার্টির আয়োজন করা হয়নি।

তিনি বলেন, সাধারণত গণভবনসহ বিভিন্ন জায়গায় খুব আড়ম্বরপূর্ণ ইফতার পার্টি হয়, এটি অনেকটা সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়, কিন্তু সেখানে যারা যায় তাদের সবারই কিন্তু ইফতার করার সামর্থ্য থাকে। তাই সরকার ও দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে যারা গরিব, দুস্থ তাদের কাছে ইফতারসামগ্রী বিতরণের জন্য। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘এটি খরচ কমানোর চলমান প্রক্রিয়া কিনা আমি জানি না, তবে এ জাতীয় অকারণে আরো বহু খরচ করা হয়, সেগুলোও বন্ধ করা উচিত। তিনি বলেন, এটি ভালো সিদ্ধান্ত, কিন্তু বাড়াবাড়ি ব্যয় অন্য সব কিছুতেই বন্ধ করা উচিত। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে একটি অস্থায়ী প্যান্ডেল বানানো থাকে, মাসে অন্তত ১০-১৫ দিন ইফতারের আয়োজন হয় বিভিন্ন গ্রুপের সাথে। এতে কেমন খরচ হয় তার সঠিক পরিমাণ বলতে পারব না, তবে অনেক হয়। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতর থেকেও ইফতার পার্টি করা হয়ে থাকে।’

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, আমরা যখন কোনো ইফতারের আয়োজন করি সেখানে অনেক লোকজনকে দাওয়াত দেয়া হয়, অনেকেই সেখানে আসে। আয়োজনও বেশি করতে হয়। বড় কমিউনিটি সেন্টার বা বিলাসবহুল হোটেলে অনেক খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করতে হয়। এগুলোকে অপচয় হিসেবে বিবেচনা করে সেখান থেকে সরে আসার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান আওয়ামী লীগের এই নেতা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের তরফ থেকে প্রায়ই বলা হয়- দেশে নিম্নবিত্ত মানুষের সংখ্যা কমেছে ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। সেখান ইফতার ঘিরে সরকারের এমন সিদ্ধান্ত দেশের দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতির বাস্তবতা যেন সামনে আনছে। রাষ্ট্রপতি ভবনে আড়ম্বরপূর্ণভাবে ইফতার আয়োজন হয়, বিভিন্ন বাহিনী ইফতারের আয়োজন করে, সবমিলে সরকারি উদ্যোগে প্রচুর ইফতারের আয়োজন হয় বলে জানান আলী ইমাম মজুমদার। আর এর সবগুলোতে আয়োজনের মাত্রাটা হয় ব্যাপক। তবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার মনে করিয়ে দেন, শুধু ইফতারের ক্ষেত্রে এমন নির্দেশনা না দিয়ে সব ক্ষেত্রে কী করে অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত ব্যয় কমানো যায় সেটি ভাবা উচিত। সামনে পয়লা বৈশাখ আসছে, উন্মাদের মতো খরচ করা হয়, রাষ্ট্রীয়ভাবেও হয় বেসরকারিভাবেও হয়, এগুলো আগে ছিল না, এখন এগুলো বন্ধ করা উচিত। (যুগান্তর, ঢাকা, ১৭ মার্চ, ২০২৪)

প্রধানমন্ত্রীর কৃচ্ছ্রতার এই নির্দেশনা সরকার ও তার দলের জন্য প্রযোজ্য এবং তারা এটি গ্রহণ করেছেন। কিন্তু এ নির্দেশনাকে পুঁজি করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণীর অতি উৎসাহী মানুষের ছোটখাটো ইফতার আয়োজন বন্ধ করে দেয়ার বিজ্ঞপ্তি বাড়াবাড়ির নামান্তর। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইফতার মাহফিল না করুন কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীরা ইফতার আয়োজন করতে পারবে না, এটি কী কথা! এতে জাতির কাছে ভুল মেসেজ যাচ্ছে। এ দেশের যেকোনো নাগরিকের ধর্মশিক্ষা, ধর্মচর্চা, ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি লালনের সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশে সে অধিকারচর্চার উজ্জ্বল ইতিহাস আছে। চলতি সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭২টি এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৬টি মণ্ডপ স্থাপন করে সরস্বতীর পূজা করা হয় সমারোহে। মণ্ডপ তৈরিতে অনেক অর্থ ব্যয় হয়। তাহলে ক্যাম্পাসে সাদামাটা ইফতার আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা কেন? এ প্রশ্ন সঙ্গত।

তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে করেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে ইফতার মাহফিলে নিষেধাজ্ঞা জারি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেশে নতুন সঙ্কট সৃষ্টি করবে, যা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে দেশকে গভীর সঙ্কটে ফেলতে পারে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহরিতে গরুর গোশত নিয়ে বিদ্বেষচর্চার সাম্প্রদায়িক ঘটনাসমূহ মুসলিম শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। যেকোনো মূল্যে এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবে। ধর্মবিশ্বাসী প্রতিটি নাগরিকের ধর্মীয় আচার অনুশীলনের অধিকার রয়েছে।

লেখক : কলামিস্ট ও লেখক


আরো সংবাদ



premium cement