০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫
`


তৃতীয় নয়ন

ঢাকার যানবাহন

-

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রাক্কালে ‘গুপ্ত কবি’ ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত ঊনবিংশ শতাব্দীতে বলেছিলেন, ‘রেতে (রাতে) মশা, দিনে মাছি, এই নিয়ে কলকাতায় আছি।’ এখন কথাটা ঢাকার বেলায় প্রযোজ্য। ঢাকা পৃথিবীর দ্বিতীয় অবাসযোগ্য শহর হিসেবে অভিহিত। জলজট ও জনজট এখন এর নিত্যসঙ্গী। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে যানজট। কথায় বলে রাজধানী ঢাকায় অল্প বৃষ্টিতে বেশি সমস্যা হয়। নগর ঢাকা এখন আর যুদ্ধবিধ্বস্ত নয়, অথচ ঢাকার অবস্থা যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগান রাজধানী কাবুল বা সিরীয় রাজধানী দামেস্কের কাছাকাছি।

মহানগরী ঢাকায় যানজট সমস্যা বর্তমান বহুমুখী ও জটিল। ঢাকায় যানজটের কবলে কত যে সময় নষ্ট হচ্ছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ছোটবেলায় শুনতাম, লোকাল ট্রেনের ড্রাইভার ট্রেন থামিয়ে তার শ্বশুরবাড়ি যায়। ফলে ‘৯টার গাড়ি কয়টায় ছাড়ে’ কথাটার এ দেশে উদ্ভব। কিন্তু ঢাকায় আধুনিক যানবাহনের ভিড়ে কথাটা আজো টিকে আছে।

ঢাকাতে লোকাল ট্রেন নেই, আছে অত্যাধুনিক প্রাইভেট কার ও অসংখ্য রিকশা যা মধ্যবিত্তের প্রধান যান। যানজটে বই পড়ে শেষ করা এবং ফেসবুকে কোনো কিছু লেখা অত্যন্ত মামুলি ব্যাপার। হঠাৎ করে যানজট সৃষ্টি হয় ঢাকায়। এর পেছনে পাবলিকও দায়ী; ট্রাফিক পুলিশও দায়ী। গত কয়েক দিন ঢাকার পল্টন মোড়ে এই যানজট দেখা যাচ্ছে। ঢাকার বাইরে থেকে যারা আসেন, তারা ঢাকা মহানগরীতে প্রবেশের সময় বিরাট বাধার সম্মুখীন হন। তখন দীর্ঘ যানজটে মানুষকে বিষম নাস্তানাবুদ হতে হয়। যেমন- ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে। বন্দর নগরী চট্টগ্রাম থেকে মাত্র ৬ ঘণ্টায় ঢাকায় আসা যায়। কিন্তু যাত্রাবাড়ীতে অপেক্ষা করতে হয় কমপক্ষে দুই ঘণ্টা। ফলে ঢাকা শহরে প্রবেশ করতে অনেক বিলম্ব হয়। রাজধানীর কেন্দ্রস্থল পল্টন মোড়ে সাম্প্রতিক ভয়াবহ যানজটের কারণ কী, বুঝা যায় না।

রাজধানীর যানবাহনে কিছু দিন তোড়জোড় ছিল টিকিট মেশিনের। এখন সেই মেশিনের দেখা নেই। ফাঁকতালে শেওড়াপাড়া-ফার্মগেট ১৩ টাকার জায়গায় ১৫ টাকা আদায় করা হয়। প্রত্যেক ট্রিপে একটি মিনিবাসে অন্তত ৬০ জন যাত্রী থাকে। এভাবে প্রতিদিন মিনিবাসে অসংখ্য যাত্রী যাতায়াত করে। তাদের থেকে ড্রাইভার, কন্ডাক্টর মোট কত টাকা অতিরিক্ত আদায় করছে তা সহজেই বোঝা যায়। মিরপুর রুটে প্রতিদিন কয়েক লাখ লোক যাতায়াত করে। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে দুই টাকা করে অতিরিক্ত নিলে মোট কত টাকা আয় হয়, এটা সহজেই অনুমেয়। শাহবাগ থেকে মৎস্যভবনেও ১০ টাকা করে আদায় করা হয়। অথচ ভাড়া আরো অনেক কম। একজন গ্রামের লোক মতিঝিল থেকে শাহবাগ যাবেন। তার কাছ থেকে ১০ টাকার বদলে ৩০ টাকা আদায় করা হয়েছে। মতিঝিল থেকে যারা মিরপুর যাবেন তাদের সরাসরি কোনো বাস নেই। বিকল্পের গাড়িগুলো সব যাত্রাবাড়ী চলে গেছে। মতিঝিল থেকে এখন কোনো বাসই ছাড়ে না। অথচ যাত্রীরা তীর্থের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন। এমনি হাজারো সমস্যার মধ্য দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করতে হয়।

শুধু ফার্মগেট থেকেই প্রতিদিন অতিরিক্ত কয়েক লাখ টাকা আদায় করা হচ্ছে নিরীহ যাত্রীদের কাছ থেকে। যাত্রী হয়রানির অন্যান্য ধরনও আছে। যাত্রীদের শাসানো, এমনকি পিটানো পর্যন্ত হয়। ধানমন্ডির আবাহনী মাঠের কাছে মোহাম্মদপুর রুটের একটি গাড়ি থেকে ড্রাইভারের হাত থেকে বাঁচতে যাত্রী পলায়নের দৃশ্য অনেকেরই দেখা। কিন্তু কী করা! যাকে বলে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট।

নিম্নবিত্ত মানুষের এখন ঢাকায় চলাচলের কোনো উপায় নেই। কারণ সব রুটেই ভাড়া বেড়ে গেছে অনেক। মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস উঠছে। নিম্নবিত্ত তো সেখানে দাঁড়াতেই পারে না। করোনার অতিমারী এবং ডলার সঙ্কটের কারণে এমনিতেই সাধারণ মানুষের অবস্থা বড়ই কাহিল। তার ওপর পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ভাড়া বেড়েছে অনেক। এখন ১০ টাকার কমে কোনো ভাড়া নেই। বড় নোট দিলে হিসাব পাওয়া যায় না। শাহবাগ থেকে মতিঝিল ভাড়া ১০ টাকা হলেও মতিঝিলের ভিতরেই ভাড়ার তারতম্য রয়েছে। এ দুর্ভোগ নিত্যদিনই পোহাতে হয়। কিন্তু এসব দেখার কেউ নেই। কত আর ঝগড়া করা যায়। ভাড়া বাড়ানোর পরে প্রথম দিকে আপত্তি উঠলেও দু’দিন পরে সব ‘ঠিক হয়ে’ যায়। সবাই নতুন ভাড়াকে মেনে নেয় বা মেনে নিতে বাধ্য হয়। যানবাহনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অবস্থা কাহিল হলেও বলার কিছু নেই। কর্তৃপক্ষ দেখেও না দেখার ভান করে।

একটি কৌতুক আছে। একজনের ঘাড় বাঁকা দেখে আরেকজনের প্রশ্নের জবাবে বলা হচ্ছে- ‘মিনিবাসে রড ধরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে তার এ অবস্থা।’ এ অবস্থা অনেকেরই। কিন্তু বলার বা করার কিছু নেই। এই নিয়তি মেনেই ঢাকায় থাকতে হয়। ঢাকার আকর্ষণে মানুষ এখানে আসতে বাধ্য।


আরো সংবাদ



premium cement