২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সুশাসন

গিবত ও অপবাদ এক নয়

গিবত ও অপবাদ এক নয় - নয়া দিগন্ত

গিবত আরবি শব্দ। এ শব্দটির আভিধানিক অর্থ- পরনিন্দা, পরচর্চা, অসাক্ষাতে দুর্নাম করা, পেছনে সমালোচনা করা, অপরের দোষ প্রকাশ করা, কুৎসা রটনা করা প্রভৃতি। সাধারণ অর্থে- গিবত হলো কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ প্রকাশ করা। ইসলাম ধর্মের ভাষ্যমতে, গিবত হলো কারো অনুপস্থিতিতে অন্যের কাছে এমন কোনো কথা বলা যা শুনলে সে মনে কষ্ট পায়। অপবাদ অর্থ গিবতের সমরূপ হলেও এ দুইয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো- কারো অনুপস্থিতিতে দোষ প্রকাশ ও দোষ না থাকা সত্ত্বেও তা আরোপ করে অনুপস্থিতি বা উপস্থিতিতে প্রকাশ।

গিবত বিষয়ে রাসূল সা: সাহাবিদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘তোমার কোনো ভাই সম্পর্কে এমন কথা বলা, যা সে অপছন্দ করে, তা-ই গিবত। অতঃপর রাসূল সা:-কে বলা হলো, আমি যা বলব তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে পাওয়া যায় সে ক্ষেত্রেও কি তা গিবত হবে? এর উত্তরে রাসূল সা: বললেন, ‘তুমি যা বলছ তা যদি তার মধ্যে থাকে তবে তা হবে গিবত, আর যদি তা তার মধ্যে পাওয়া না যায় তবে তা হবে অপবাদ।’

উপরোক্ত হাদিসের আলোকে নির্দ্বিধায় বলা যায়, কোনো ভাইয়ের এমন দোষের কথা বলা গিবত যা সে অপছন্দ করে। গিবতের কারণে সমাজ বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হয়, সমাজের ভ্রাতৃত্ববোধ বিনষ্ট হয়, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে এবং পারস্পরিক সম্পর্কে ফাটল ধরে। গিবতের কারণে একজন মানুষ নিকৃষ্টতম প্রাণীতে পরিণত হয়। আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনে এবং রাসূল সা: তার জীবদ্দশায় মানুষকে এ নিকৃষ্ট কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য বারবার তাগিদ দিয়েছেন। গিবত প্রসঙ্গে সূরা হুজুরাতের ১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘আর তোমরা একে অন্যের গিবত করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস খেতে ভালো বাসবে? বস্তুত তোমরা নিজেরাই তা অছন্দ করে থাকো।’

মানুষ সামাজিক জীব বিধায় মানুষের পক্ষে সমাজবদ্ধ জীবন ছাড়া একাকী জীবনযাপন সম্ভব নয়। পৃথিবীর সমাজবদ্ধ কোনো মানুষের কাছে সামাজিক বিপর্যয় কখনো কাম্য নয়। সুখ ও শান্তিতে বসবাস মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম। এ প্রত্যাশিত সুখ ও শান্তি নির্ভর করে সমাজবদ্ধভাবে বসবাসরত মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর। শান্তি মানুষের আরাধ্য বিষয় হলেও শয়তান দ্বারা প্ররোচিত হয়ে মানুষের মধ্যে কিছু বিপথগামী শান্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ধনী-গরিব ও উচ্চবিত্ত- নি¤œবিত্ত এসব পার্থক্য আল্লাহর সৃষ্ট। মানুষের পারস্পরিক পরিচয় সম্পর্কে আল্লাহ সূরা হুজুরাতের ১৩ নম্বর আয়াতে বলেন- ‘হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি এবং গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়াসম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সম্যক অবহিত।’

গিবত খুবই অপছন্দনীয় কাজ। আল্লাহ তায়ালা গিবত করা পছন্দ করেন না। গিবত করাকে আল-কুরআনে নিজ মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। সুস্থ ও বিবেকবান কোনো মানুষই জ্ঞান অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত হালাল যেকোনো পশু মৃত হলে তার মাংস ভক্ষণ করবে না।

ইসলামী শরিয়তে গিবত হারাম ও কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। গিবতের পরিণাম প্রসঙ্গে আল্লাহ সূরা হুমাজার ১ নম্বর আয়াতে বলেন- ‘ধ্বংস তাদের জন্য, যারা অগ্র-পশ্চাতে দোষ বলে বেড়ায়।’ গিবত করা যেমন হারাম, অনুরূপ গিবত শুনাও হারাম। গিবত না করার পাশাপাশি গিবত শুনা থেকেও বিরত থাকতে হবে। গিবতকারীকে গিবত বলা থেকে বিরত থাকার জন্য বলতে হবে। যে সব স্থানে গিবতের আলোচনা হয় সে সব স্থান এড়িয়ে চলতে হবে। আমাদেরকে কারো গিবত শুনলে তার অনুপস্থিতিতে তার পক্ষ থেকে তা প্রতিরোধে সাধ্যমতো চেষ্টা করতে হবে। আর যদি প্রতিরোধে শক্তি না থাকে তবে অবশ্যই তা শ্রবণ থেকে বিরত থাকতে হবে। ইচ্ছাকৃতভাবে গিবত শুনা নিজে গিবত করার সমরূপ অপরাধ।

শুধু পরনিন্দাই গিবত নয়; বরং চোখের ইশারায়, অঙ্গ-ভঙ্গিতে, শ্রবণে ও লিখনের মাধ্যমেও গিবত হয়ে থাকে। উপরোক্ত যেকোনো পদ্ধতির গিবতই হারামের অন্তর্ভুক্ত। হজরত আয়েশা রা: বলেন, একদিন আমি হাতের ইশারায় এক স্ত্রীলোককে খর্বাকৃতি বললে রাসূল সা: আমাকে বললেন, ‘হে আয়েশা, তুমি গিবত করেছ। থুথু ফেলো। তৎক্ষণাৎ আমি থুথু ফেলে দেখলাম, তা কালো বর্ণের জমাট রক্ত।’ এরূপে কোনো ল্যাংড়া, কানা কিংবা টেরা চক্ষুবিশিষ্ট ব্যক্তির অবস্থা অনুকরণ করে খুঁড়িয়ে হাঁটলে কিংবা কানা বা টেরার মতো অনুরূপ ভঙ্গিতে চাইলে তার গিবত করা হলো। তবে কারো নাম উল্লেখ না করলে এতে গিবত হয় না। কিন্তু উপস্থিত লোকেরা যদি বুঝতে পারে যে, অমুক ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, তবে তা গিবত বলে গণ্য এবং হারাম হবে।

কোনো ব্যক্তিকে তার গুনাহের কারণে অপদস্থ করা এবং তাকে জাহান্নামি রূপে আখ্যায়িত করা আল্লাহ তায়ালার মর্জিবিরোধী কাজ। যে ব্যক্তি কোনো ব্যক্তিকে অপমান করে আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি অসন্তুষ্ট হন এবং তাকে অপমান করেন, অন্যদিকে যাকে অপমান করা হলো তার গুনাহ মাফ করে দেন।

গিবতের পরিণাম বিষয়ে রাসূল সা: বলেন, ‘পরচর্চা বা পরনিন্দা ব্যভিচারের চেয়েও গর্হিতকর কাজ।’ গিবত কিভাবে ব্যভিচারের চেয়ে মারাত্মক অপরাধ হয় সাহাবিদের এমন প্রশ্নের উত্তরে রাসূল সা: বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি ব্যভিচার করার পর তওবা করলে আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। কিন্তু গিবতকারীকে ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ ক্ষমা করবেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত না যার গিবত করা হয়েছে সে ব্যক্তি ক্ষমা করবে। অনেক সময় এমন ব্যক্তির গিবত করা হয় যার কাছে ক্ষমা চাওয়ারও সুযোগ থাকে না। এ ধরনের গিবতের পাপ আল্লাহপাকও ক্ষমা করবেন না। সুতরাং আমাদের সবার গিবত থেকে বিরত থাকা উচিত। যদি কোনো কারণে গিবত হয়ে যায় তবে সাথে সাথে গিবতকৃত ব্যক্তির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে।

আত্মপূজা, আত্মপ্রীতি, হিংসা-বিদ্বেষ, কুধারণা প্রভৃতি মানুষকে গিবতের পথে নিয়ে যায়। অনেক মানুষের মধ্যে নিজেকে বড় করে দেখার একটি প্রবণতা রয়েছে। এ প্রবণতাটিকে বলা হয় আত্ম-অহঙ্কার। আত্ম-অহঙ্কার একজন মানুষকে আত্মপ্রীতির দিকে ধাবিত করে। একজন মানুষের মধ্যে আত্মপ্রীতি দানা বাঁধলে তার মধ্য থেকে আত্মত্যাগের মতো মহৎ বৈশিষ্ট্য দূরীভূত হয়।

গিবত হারাম হলেও এমন কিছু ব্যক্তি রয়েছে যাদের দোষ বর্ণনা করা যায়, তা হলো- অত্যাচারী শাসকের অত্যাচারের কাহিনী প্রতিকারের আশায় বর্ণনা করা; সন্তানের বিরুদ্ধে পিতার কাছে অভিযোগ করা; স্ত্রীর বিরুদ্ধে তার স্বামীর কাছে অভিযোগ করা; ফতোয়া গ্রহণ করার নিমিত্ত ঘটনার বিবরণ দেয়া ও প্রয়োজন এবং উপযোগিতার কারণে কারো দোষ বর্ণনা করা ও যাদের স্বভাব গিবত করা তাদের সম্পর্কে অন্যদের সাবধান করা।

গিবত থেকে বেঁচে থাকা আমাদের সবার জন্য জরুরি। অপরের কল্যাণ কামনার মধ্যেই নিহিত রয়েছে গিবত থেকে নিজেকে রক্ষা করার প্রাথমিক সাফল্য। এ বিষয়ে রাসূল সা: বলেন, ‘দ্বীন হচ্ছে নিছক কল্যাণ কামনা করা।’ আত্মত্যাগের মাধ্যমেও নিজেকে গিবত থেকে রক্ষা করা যায়। আত্মত্যাগ অর্থ যেকোনো প্রয়োজনে অপরকে নিজের উপর অগ্রাধিকার দেয়া। এ বিষয়ে আল্লাহ সূরা হাশরের ৯ নম্বর আয়াতে বলেন- ‘তারা নিজের ওপর অন্যদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তারা অনটনের মধ্যে থাকে।’ অপরের অপরাধ ক্ষমার মাধ্যমেও গিবত পরিহার করা যায়। আবার মহৎ ব্যক্তিদের জীবনাদর্শ অধ্যয়ন ও অনুসরণের মাধ্যমে গিবত বর্জন করা যায়।

গিবত থেকে বাঁচার জন্য জিহ্বার নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি। এ বিষয়ে রাসূল সা: বলেন, ‘বান্দা যখন ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠে তখন তার দেহের অপর সব অঙ্গ জিহ্বার কাছে মিনতি করে- তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহর নাফরমানি কাজে পরিচালিত করো না, কেননা, তুমি যদি ঠিক থাকো, তবে আমরা সঠিক পথে থাকব। কিন্তু তুমি যদি বাঁকা পথে চলো, তবে আমরাও বাঁকা হয়ে যাবো।’ রাসূল সা: অপর এক হাদিসে বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার জন্য তার জিহ্বা ও লজ্জাস্থানের জিম্মাদার হবে, আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হবো।’

আমরা যেন গিবতের মতো জঘন্য সামাজিক ব্যাধিতে আমাদের নিমজ্জিত না করি, এ বিষয়ে আমাদের সব সময় আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে তার অনুগ্রহ কামনা করতে হবে। আর গিবতকে বর্জনের মধ্যেই আমাদের জন্য রয়েছে ভালো অর্জনের পাথেয়। আমাদেরকে গিবত ও অপবাদের পার্থক্য অনুধাবন করে ইহলৌকিক জীবনে এমনভাবে চলতে হবে যাতে আমাদের অপছন্দের ব্যক্তির চরিত্রে যে দোষের অস্তিত্ব রয়েছে তা নিয়ে তার অলক্ষে যেমন কোনো কিছু না বলা, অনুরূপ যে দোষের অস্তিত্ব নেই তা নিয়েও অমূলক বাক্যালাপ না করা। আর পার্থক্যটি অনুধাবন করে আমরা যদি সঠিকভাবে চলতে পারি, তাতেই রয়েছে আমাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের সার্থকতা।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail : iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
স্বর্ণের দাম ভরিতে কমলো ১১৫৫ টাকা গাজায় গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানালো উত্তর আয়ারল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার হোসেনপুরে চাঞ্চল্যকর সবুজ মিয়ার হত্যায় ভাতিজা গ্রেফতার দেশের সর্বোচ্চ ৪৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড চুয়াডাঙ্গায় সীমান্তে গুলির শব্দ নেই, তবুও আতঙ্কে স্থানীয়রা রাঙ্গাবালীর খালে পাওয়া টর্পেডো উদ্ধার করেছে নৌ-বাহিনী লক্ষ্মীপুরে বিজয়ী ও পরাজিত উভয় চেয়ারম্যান প্রার্থী আটক ৩৪ বছরেও মুছেনি ভয়াল ২৯ এপ্রিলের দুঃসহ স্মৃতি যশোরে দেশের সর্বোচ্চ ৪২.৮ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড উত্তর ইসরাইলে হামাসের রকেট হামলা প্রচণ্ড গরমে বেতাগীতে ৪ শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে অসুস্থ

সকল