২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সমকালীন প্রসঙ্গ

১৭ ডিসেম্বর, ২০২৩! নয়া ইতিহাসের পিরামিড!

১৭ ডিসেম্বর, ২০২৩! নয়া ইতিহাসের পিরামিড! - নয়া দিগন্ত

এই শিরোনাম নিয়ে কেন লিখছি তা বলার আগে চলমান সময় নিয়ে কিছু বলা আবশ্যক। আমাদের দেশে কথায় কথায় হাজার বছরের ইতিহাসের প্রসঙ্গ টেনে প্রায়ই এমন সব আজগুবি লোক অদ্ভুত সব আজগুবি কথা বলে থাকেন যা শুনলে মন-মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের মতে, বাঙালির হাজার বছর বলতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট নদী কবিতার মতো সহজ সরল কিছু ঘটনার ঘনঘটা অথবা কবির বীরপুরুষ কবিতার উপ্যাখ্যানের মতো শিশুতোষ কল্পনার মতো কিছু কাহিনীর সমাবেশ ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ আজ থেকে হাজার বছর আগের যদি কোনো কিছু বলতে শুরু করি তবে ১০২৩ সাল থেকে শুরু করতে হবে। বাংলা তখন পাল সাম্রাজ্যের অধীন। সম্রাট মহীপাল তখন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাসহ উত্তর ভারতের বিরাট অংশের শাসক। অন্য দিকে, দক্ষিণ ভারতে চোল সম্রাট রাজেন্দ্র হঠাৎ করেই ইদানীংকালের নরেন্দ্র মোদির মতো অতিশয় ক্ষমতাসীন হয়ে পড়েন। তিনি ১০২৩ সালে বিরাট এক শক্তিশালী বাহিনী পাঠিয়ে আজকের বাংলাদেশসহ বিশাল এলাকা দখল করে নেন।

চোল সম্রাট রাজেন্দ্রর বাংলা আক্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল গঙ্গার পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। তিনি মহীপালকে পরাস্ত করে বিশাল হস্তিবাহিনী ও হাজার হাজার বাঙালি রমণীকে বন্দী করে দক্ষিণ ভারতে নিয়ে যান। ওই ঘটনার প্রেক্ষাপটে পুরো ভারতের রাজনীতি কিভাবে ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল তা না হয় আরেক দিন বলব। আজ শুধু সেই ঘটনার এক হাজার বছর পর অর্থাৎ ২০২৩ সালে কী ঘটছে তা একটু স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য চলমান সালের ডিসেম্বর মাসের ১৭ তারিখের একটি রোজনামচা পেশ করব; যাতে করে আরো হাজার বছর পর কেউ যদি খোঁজ নেন তবে আজকের বাংলাদেশের চালচিত্র এবং মানুষের আকুতি ও আজকের দিনের পরিণতির একটি যোগসূত্র মেলাতে পারেন।

আজকের দিনের বাংলাদেশে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের বাস। তিভিন্ন অভাব-অভিযোগ, ভয়-ভীতি, দমন-পীড়ন, মামলা-হামলা ইত্যাদির কারণে দেশের বেশির ভাগ মানুষের মন খারাপ। বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা অনেক রাজনৈতিক দল শত চেষ্টা করেও রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের সাথে পেরে উঠছে না। আওয়ামী লীগের চালাকি, ক্ষমতায় থাকার জন্য দুনিয়ার তাবৎ প্রচলিত এবং অপ্রচলিত কূটকৌশল, রাষ্ট্রক্ষমতা এবং রাষ্ট্রীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদের তাপ ও চাপ ঘটিয়ে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা ও কামনা-বাসনাকে এমন দুঃস্বপ্নে পরিণত করেছে, যার কারণে বহুসংখ্যক মানুষ ভয় ও আতঙ্কে কান্না করতেও সাহস পাচ্ছে না। অনেকের চোখের পানি শুকিয়ে গেছে এবং হৃদয়ের মধ্যে হাহাকারের মরুঝড়ের তাণ্ডবে তারা বেঁচে থাকার পরিবর্তে আল্লাহর কাছে নিজেদের মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা করছে।

উল্লিখিত অবস্থায় রাষ্ট্রক্ষমতা নিজেদের দখলে রাখার জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের তাঁবেদার গৃহপালিত দল-ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের সমষ্টি এবং নানা পদ-পদবি ও প্রকৃতির দালাল ফড়িয়ারা যে অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করে চলেছে তা আমার জানা মতে অতীতকালে কোনো দিন ঘটেনি। তারা নির্বাচন নাম দিয়ে এমন কিছু করার চেষ্টা করছে যার ফলে অনাগত দিনে নির্বাচন গণতন্ত্র-ভোট প্রতিযোগিতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা-নির্বাচনের ফলাফল, সরকারি দল-বিরোধী দল ইত্যাদি শব্দমালার শব্দ-বর্ণ-গন্ধ, প্রকৃতি-পরিবেশ-আকার-আয়তন, ব্যুৎপত্তিগত গঠন, রূপায়ণ ইত্যাদি বাংলার জমিনে নতুন করে রচিত হবে। যারা এসব করছেন তারা যদি সফল হন তবে এক ধরনের ইতিহাস রচিত হবে এবং যদি ব্যর্থ হন সে ক্ষেত্রেও মহাকালের ইতিহাসে তাদের কর্মকাণ্ড অনাগত দুনিয়ার জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। তারা চলমান নির্বাচন শব্দের সঙ্গে প্রার্থী-ডামি, প্রার্থী-বিদ্রোহী, প্রার্থী-স্বতন্ত্র, প্রার্থী-তাঁবেদার প্রার্থী, সদ্য কেনা গৃহপালিত প্রার্থী, পুরনো কেনা গৃহপালিত প্রার্থী ছাড়াও কিছু কুদরতি ও আচমকা প্রার্থী সৃষ্টি করে নির্বাচন নির্বাচন খেলার রঙ্গমঞ্চটি জমজমাট ও দর্শকনন্দিত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

আওয়ামী লীগের উল্লিখিত চেষ্টা-তদবিরের কারণে যে পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে সেই পরিবেশের যুগসন্ধিক্ষণ ছিল ১৭ ডিসেম্বর। এই দিনে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী হর্তাকর্তা থেকে শুরু করে তাদের সৃষ্টিকৃত রঙবেরঙের প্রার্থীকুলের সদস্যদের সবাই যে উত্তেজনা-উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতার মধ্যে কাটিয়েছে তার সাথে রাজনীতির কিয়ামত অথবা দু’নম্বরি রাজনীতির হাশর-নশরের তুলনা করা যেতে পারে। আজকের দিনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের পক্ষ-বিপক্ষের শক্তিগুলো যার যার মতাদর্শ অনুযায়ী ইবাদত-বন্দেগি, ঝাড়-ফুঁক, তোয়াজ-তদবির, প্রচার-প্রপাগান্ডা-কূটনামি-ষড়যন্ত্র, তাপ-চাপ-থেরাপি যা কিছু আছে তা সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে সদরে-অন্দরে নানামুখী কর্মকাণ্ড করেছে। ফলে আজকের দিনে কত কোটি লিটার ঘাম ঝরেছে- মানবদেহ থেকে কী পরিমাণ বর্জ্যরে নিঃসরণ ঘটেছে কিংবা নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস থেকে কী পরিমাণ অক্সিজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড বের হয়েছে তা কেবল আল্লাহই বলতে পারবেন।

উল্লিখিত অবস্থা সৃষ্টির অনেক কারণ ছিল। প্রথমত, নির্বাচনের নীতিনৈতিকতা মেনে সত্যিকার প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ নষ্ট করার জন্য এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে যার কারণে যোগ্য-আদর্শ ও জনগণের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টিকারী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা মামলা-হামলা-তাপ-চাপ-গুম-খুনের ভীতিকর বিস্ময়তায় নির্বাচনের মাঠ ছেড়ে পালিয়েছে। আর যারা পালাতে পারেনি তারা জেলে গেছে। দ্বিতীয়ত, তাদের শূন্যস্থান পূরণের জন্য যাদেরকে আনা হয়েছে তারা শূন্যতা পূরণ তো দূরের কথা বরং নতুন নতুন শূন্যতার সৃষ্টি করে পুরো নির্বাচনী ময়দানকে খেলতামাশা-হতাশা ও হাহাকারের বধ্যভূমি বানিয়ে ফেলেছে। তৃতীয়ত, গদাধারী শক্তিবর্গ দিনে-রাতে নকল প্রতিযোগীদেরকে গদাহাতে যেভাবে শাসাচ্ছে কিংবা বাঘের হুঙ্কারে সান্ত্বনা দিচ্ছে তা দেখে দৌড় শুরু হওয়ার আগেই অনেকের হাঁটু কাঁপুনির পাশাপাশি কিছু অঙ্গ-প্রতঙ্গ পেটের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। চতুর্থত, পুরো পরিস্থিতি অবলোকন করে রঙ্গপ্রিয় বাঙালি যেভাবে রঙ্গ করে ঠাট্টা-মশকরা হাসি-তামাশা শুরু করেছে তাতে করে কবি নজরুলের আমি জাহান্নামে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসির কবিতার ছন্দটি বাস্তব রূপ বাংলার আকাশে লক্ষকোটি চাঁদ-তারা হয়ে পাবলিককে পুলকিত করছে।

নির্বাচন সঠিক পদ্ধতিতে অনুষ্ঠানের জন্য পশ্চিমা সভ্য জাতিগুলো যারা সভ্যতার সাথে পাল্লা দিয়ে শক্তি অর্জন করেছে, তাদের বহুমুখী চাপের কারণে আওয়ামী লীগের সবার মধ্যে এক ধরনের মানবিক ও মানসিক রসায়ন শুরু হয়েছে। আমেরিকার তৎপরতা ভারতের দোটানা মনোভাব এবং চীন-রাশিয়ার কূটনামির কারণে নির্বাচন এবং ভোট এই মুহূর্তে ক্ষমতাসীনদের জন্য অগ্নিপরীক্ষায় পরিণত হয়েছে; যার প্রথম দফার ঝড় ১০ নম্বর বিপদসঙ্কেত নিয়ে আজকের দিনে বহু মানুষের মনে ভয়-আতঙ্ক-ইজ্জতহানি ও পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনাকে প্রবল করে তুলেছে।

আজকে ছিল নির্বাচনে প্রার্থিতা-প্রত্যাহারের শেষ দিন যা নিয়ে দেশ-বিদেশে গুজবের অন্ত ছিল না। তবে সব আলোচনা-সমালোচনা-বিতর্ক আবর্তিত হচ্ছিল জাতীয় পার্টি-ওয়ার্কার্স পার্টি-জাসদসহ নতুন ও পুরনো গৃহপালিত রাজনৈতিক দলগুলোর ছং ভং, হাপিত্যেশ, পাওয়া না পাওয়ার হিসাব এবং ফলাফল ও তাদের মতিগতি নিয়ে। অনেকে বলছিল, এবার ওদের দেশপ্রেম জেগেছে। মতিগতির লক্ষণ ভালো মনে হয়েছে। তারা তাদের জন্মদাতা পিতা-মাতার আদর্শ অথবা বিদেহী আত্মার কথা স্মরণ করছে। তারা আজকের দিনে আওয়ামী লীগকে এমন ঐতিহাসিক শিক্ষা দেবে যার হাত ধরে গণতন্ত্রের নতুন ইতিহাস রচিত হবে। তারা হবেন নয়া মুক্তিযোদ্ধা, অসহায় মানুষের ত্রাতা এবং নিজেদের পাপ নিজেদের পা দিয়ে পিষে ভালো হয়ে যাওয়া প্রশংসিত মানুষদের মধ্যে অন্যতম প্রজাতি। কিন্তু দিন শেষে ওরা এমন কিছু করল তাতে সবাই বাংলা প্রবাদে উল্লিখিত ‘জাত যায় না মরলে, ইজ্জত যায় না ধুইলে’ মর্মকথার যথার্থতা নতুন করে অনুভব করল।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে, আজ আওয়ামী লীগের সফলতা আকাশ স্পর্শ করেছে। কিন্তু তার পরও বিজয়ীদের মুখে হাসি নেই, আবার পরাজিতদের কণ্ঠে কান্নার শব্দ কিংবা চোখে অশ্রু নেই; বরং এক অজানা ভয় ও আতঙ্ক পুরো জাতিকে গ্রাস করেছে। আজ থেকে এক হাজার বছর আগে দক্ষিণ ভারতের সম্রাট রাজেন্দ্র যেভাবে গঙ্গা অববাহিকায় আক্রমণ চালিয়ে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছিলেন এবং আকাশে-বাতাসে যে কান্নার রোল ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তা নিয়ে আপনার মনে কী ধরনের প্রশ্ন বা কৌতূহল সঞ্চারিত হয়েছে তা আমি বলতে পারব না।
তবে আমি ভাবছি সে দিনের গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের কান্নার রোলে বাংলা ভাষা ছিল নাকি পালিত ভাষা ছিল সে কথার কোনো দলিল আমি পাচ্ছি না। অথবা ১০২৩ সালে হারানো স্বাধীনতা ফিরে পেতে কত বছর লেগেছিল তা যেমন স্পষ্ট করে জানতে পারছি না তদ্রƒপ বাঙলার শাসক মহীপালের সিংহাসন আরোহণের বছর অর্থাৎ ৯৭৮ সালেও কিন্তু বাংলা বা গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ পরাধীন ছিল। তিনি তিন বছর টানা যুদ্ধ করে বাংলা পুনরুদ্ধার করেছিলেন বটে কিন্তু ১০০৯ সালে কী এমন ঘটেছিল যার কারণে ১০২৩ সালে রাজা রাজেন্দ্র বাংলা দখল করেছিলেন তা জানার ইচ্ছে থাকলে আপনারা ইতিহাসের পাতাগুলো উল্টে দেখতে পারেন।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement