০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`


তৃতীয় নয়ন

ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খান

ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খান - নয়া দিগন্ত

‘আমার হাকিম হারিয়ে গেছে’, ‘মওলানা আজহারী ষড়যন্ত্রকারী ছিলেন না’। যেখানে ইসলামও নেই, ফাউন্ডেশনও নেই, তার নাম ইসলামিক ফাউন্ডেশন; ইত্যাদি স্মরণীয় ও বিতর্কিত উক্তিকারী ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খান। আসলে তার ছোট ছেলে হাকিম হারিয়ে যায়নি। মওলানা আলাউদ্দীন আল আজহারী তার বিরুদ্ধে ছিলেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনেক ভালো কাজও রয়েছে। তার পরও ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খান এসব কথা বলতেন। এটিকে আমরা তার ব্যক্তিগত স্বভাব বলে ধরে নিয়েছিলাম। ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খান ছিলেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের সন্তান। তার জন্ম দক্ষিণ চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তিনি নামকে শুদ্ধ করে লিখতেন এবং ঐতিহাসিক ফারায়েজী আন্দোলনের উপরে একজন ‘অথরিটি’ ছিলেন। অথচ তার মধ্যে কোনো অহঙ্কার ছিল না। তিনি চট্টগ্রাম মহানগরীর দেওয়ানবাজার এলাকায় শুকুর আলী মুন্সেফ লেনে বাড়ি করেছিলেন। তখন তার লেখা, ত্রিপুরা ভাষায় ইসলাম পরিচিতি পুস্তিকাটি দেখেছিলাম আমার এক আত্মীয়ের বাসায়।

তিনি জিয়ার আমলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক হয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এলেন। ঠিক এক বছরের মাথায় তিনি বিদায় নিলেন। এর কারণ রাশিয়ায় গিয়ে এক সেমিনারে তিনি খ্রিষ্টানদের ত্রিত্ববাদ এবং হিন্দুদের ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের মোকাবেলায় ‘ইসলামের ত্রিত্ববাদ’ প্রচার করলেন। এ দিকে, ঢাকাতে তার বিরুদ্ধে প্রথিতযশা কয়েকজন আলেম জোট বাঁধলেন। তিনি এসেই ঢাকা থেকে ‘আউট’ হলেন। তার বিরোধীদের মধ্যে ছিলেন মওলানা আলাউদ্দীন আল আজহারীর মতো খ্যাতনামা আলেমও। কিন্তু তিনি মওলানা আজহারীকে ষড়যন্ত্রকারী মনে করতেন না। মওলানা আজহারী কিছু দিনের মধ্যে ইন্তেকাল করেন মাত্র ৪২ বছর বয়সে। ড. মুঈনুদ্দীন খান চট্টগ্রামে ফিরে আসতেই আমরা ক্যাম্পাসের কয়েকজন দল বেঁধে দেখা করতে গেলাম তার সাথে। তিনি তার বাসায় হাসতে হাসতে বললেন, ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইসলামও নেই, ফাউন্ডেশনও (ভিত্তি) নেই। এর নাম ইসলামিক ফাউন্ডেশন।’ আমরা তার সাথে পুরো একমত না হলেও আমরাও হাসলাম।

ড. মুঈনুদ্দীন খান ছিলেন কৃতী ছাত্র। তিনি পাশ্চাত্যের বিখ্যাত প্রাচ্যবিদ প্রফেসর উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের কাছে ডক্টরেট করেন। সে বহু দিন আগের কথা। একজন কৃতী ছাত্র ও কৃতী শিক্ষক হওয়ার পরও তাকে স্মরণ করা হয় না। তার মৃত্যুর পরে দুই বছর পার হয়ে গেছে। অথচ ড. আ. ফ. ম খালিদ হোসেনের মতো ২-১ জন গবেষক ছাড়া, কেউ তাকে স্মরণ করেছেন বলে মনে হয় না। তিনি ঢাকাতে থাকলে অনেক প্রচার পেতেন। আজীবন চট্টগ্রামে অতিবাহিত করেন; এ জন্য প্রচার পাননি। এটা আমাদের হীনম্মন্যতার পরিচয়; তার দোষ নেই। তিনি ঢাকার বিখ্যাত কমিশনার খান-এ আলম খানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন। কিন্তু কখনো এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি। তিনি কবি বেগম সুফিয়া কামালেরও সমালোচনা করতেন। সুফিয়া কামাল সম্পর্কে তার চাচী হতেন। সুফিয়া কামালের স্বামী কামালউদ্দীন আহমদ খান সম্পর্কে তার চাচা হতেন। তাই বলে তাদের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র দর্শনকে তিনি গ্রহণ করেননি।

ড. মুঈনুদ্দীন খানের লেখা অনেক ইতিহাস বই আছে। তিনি বিশিষ্ট লেখক। তার পরও লেখকরা তাকে স্মরণ করেননি। ড. মুঈনুদ্দীন খান ভাবুক ছিলেন। তার দর্শনের সাথে অনেকে একমত হতে পারেন না। একজন তার সমালোচনা করে বলেছেন, ‘তিনি চিন্তাভাবনা করতেন আকাশের দিকে তাকিয়ে; মাটিতে তার পা ছিল না।’ তিনি ইসলামপন্থী ছাত্র সংগঠনকে পছন্দ করতেন। বলতেন, তারা বড়জোর পলিটিক্স করে। আর অন্যদের পলিটিক্স দিয়ে শুরু। একদিন তার বাসায় গিয়ে শুনি, তিনি ‘ডায়েট কন্ট্রোল’ করছেন। তার মতো ক্ষীণদেহী খুব কম ছিলেন। আমরা হাসব না কাঁদব, ঠিক করতে পারছিলাম না। তিনি বড় বড় অক্ষরে লিখতেন এবং তার লেখা ঢাকাতে খুব কমই প্রকাশিত হয়েছে। সবসময় একটি চিন্তাভাবনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তার সাথে একমত হওয়া কঠিন; আবার ভিন্নমত হওয়াও দুঃসাধ্য ছিল যুক্তির কারণে। তিনি অনেকেরই সমালোচনা করতেন। আবার অনেকের প্রশংসাও করতেন।

তার ব্যক্তিগত জীবন অসুখী ছিল। তার বাসায় চট্টগ্রামের অন্যান্যের মতো আতপ চালের ভাত খাওয়ার কথা কখনো ভোলা যাবে না। তার বড় ছেলে নাসের ফ্লোরা কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছেন। তার দুই ছেলে এবং ছোট ছেলের নাম হাকিম।
তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবুল ফজলের ধর্মীয় দর্শনের সমালোচনা করলেও তার প্রশংসাও করতেন। বলতেন, এই লোকটার কারণেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ক্যাম্পাসে মসজিদ হয়েছে। ফজলের মৃত্যুর পরে তাকে স্মরণ করতে গিয়ে ড. মুঈনুদ্দীন খান বিপাকে পড়েন। তার মতো বর্ণাঢ্য চরিত্রকে ভোলা যায় না।

ড. মুঈনুদ্দীন খান ষাটের দশকে ইসলামাবাদে কেন্দ্রীয় ইসলামী গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। তিনি সেখান থেকে এসে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে যোগদান করেন। অনেকে বলেন, তার দীর্ঘসময় ইসলামাবাদে কাটানোর প্রভাব তার চিন্তাধারা ও লেখায় পড়েছে।

মুঈনুদ্দীন খান বলতেন, সত্য তোমার ভেতরও নাই, আমার ভেতরও নাই। সত্য নিহিত রয়েছে সংলাপে বা ডায়ালগে। এ কথার দ্বারা তিনি সক্রেটিসের উদ্ধৃতির উল্লেখ করতেন। আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঘোর ঘনঘটা। কেউ সংলাপের কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না। কেউ বলছেন, সংলাপের সময় শেষ হয়ে গেছে। কেউবা বলছেন, সংলাপ কার সাথে কিসের জন্য? কোনো প্রয়োজনই নেই এটার।’ আজকে জাতির এই ঘোর দুর্দিনে মুঈনুদ্দীন খানের ওই কথাই মনে পড়ে, সংলাপের মাধ্যমেই সত্য বেরিয়ে আসে। তার কথার সত্যতা প্রমাণের এখনই সময়। তাকে এ জন্য স্মরণ করতে হয়।

সংলাপ মানেই সমঝোতা। আর সমঝোতার মাধ্যমে জাতির উত্তরণ ঘটবে। সক্রেটিস বহু আগে এ কথা বলে গেছেন। মরহুম মুঈনুদ্দীন খান তার প্রতিধ্বনি করেছেন। আমাদের তাদের পথেই চলতে হবে। কেউ অহঙ্কারী হলে চলবে না। সংলাপ ও সহযোগিতার পথই জাতির কাম্য।


আরো সংবাদ



premium cement
ইসরাইল ও হামাসকে যুদ্ধবিরতির জন্য ‘আরো প্রচেষ্টা চালাতে’ জাতিসঙ্ঘ প্রধানের আহ্বান পি কে হালদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ নিয়ে সিদ্ধান্ত ১০ জুন সখীপুরে চেতনানাশক স্প্রে করে ব্যবসায়ীর বাড়িতে চুরি ফতুল্লায় হত্যা মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি গ্রেফতার প্রধানমন্ত্রীর সাথে আইওএম মহাপরিচালকের সাক্ষাৎ নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রীরা প্রভাব বিস্তার করলে ব্যবস্থা : সিইসি রাফা ক্রসিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নিলো ইসরাইলি বাহিনী নিষেধাজ্ঞা নেই তবুও ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে অনিশ্চয়তা দৌলতদিয়ায় ৬ ও ৭ নম্বর ফেরিঘাট ভাঙনে বিলীন হচ্ছে নদীর পাড় জাতিসঙ্ঘে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্য পদে সমর্থন বেলজিয়ামের শিক্ষকের ২ হাত ভেঙ্গে দিল কিশোর গ্যাং

সকল