০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`


দেশ এখন কোন স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে!

দেশ এখন কোন স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে! - ছবি : নয়া দিগন্ত

এখন এক অনিরাপদ ও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জনপদের বাসিন্দা বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষ। অবাক হতে হয় এজন্য যে, ঘরে-বাইরে, রাজপথে সর্বত্রই খোদ রাষ্ট্রযন্ত্র নাগরিকদের শায়েস্তা করার জন্য তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। প্রশ্ন হতে পারে, কী তাদের অপরাধ! গর্হিত কোনো অপরাধ কি? না, তাদের দোষ এতটুকুই যে, তারা বিশ্বাস ও মান্য করে ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র’। এই বাণী অবশ্যই তাদের নিজেদের রচনা নয়। এ দেশের সর্বোচ্চ আইনগ্রন্থ তথা সংবিধানের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এই বাক্য। মানুষ এই মন্ত্রকে জীবনাচরণের সাথে একীভূত করে নিয়েছে। প্রতিদিনের প্রতিটি মুহূর্তে সর্বত্র এর অনুশীলন দেখতে চায়। কিন্তু পক্ষশক্তি শুধু তাদের যখন যতটুকু প্রয়োজন, মানুষ ঠিক ততটুকুই কেবল তারা কার্য করতে চায়। মানুষের চিন্তাচেতনায় রয়েছে সংবিধানের সবটুকু প্রথম শেষ পর্যন্ত তার অনুশীলন। আর সরকারের বিবেচনা আছে খণ্ডাংশ। দুই পক্ষের বিরোধটা মূলত এখানেই। জনগণের এই কামনার প্রতি অবজ্ঞা অবহেলা শাসকদের। সেটা মানুষকে করছে মর্মাহত ক্ষুব্ধ। জনগণ এজন্য আন্দোলনরত রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সারথি। আন্দোলনরত সংগঠনগুলো এখন সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করছে। তার পরও তাদের দাবি নিয়ে দলগুলো অটল অবিচল। মানুষ তাদের সাথি হওয়ার জন্য জ্বালাযন্ত্রণা কষ্ট দুর্ভোগ বঞ্চনা সয়ে যাচ্ছে।

সংবিধান যেখানে পরিষ্কার করেছে ‘প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ’, অথচ সে মালিককে দাসে পরিণত করার সব আয়োজন সম্পন্ন করছে পক্ষশক্তি। এই প্রত্যয় জনগণের। তারা যাকে চাইবে তার হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেবে। সেই প্রক্রিয়া হচ্ছে ‘স্বচ্ছ প্রশ্নমুক্ত প্রতিযোগিতাপূর্ণ অংশগ্রহণমূলক ভোটব্যবস্থা তথা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা। অথচ তার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকার ও নির্বাচন কমিশন। ওই শক্তিদ্বয় এখন নাগরিক সমাজের প্রতিপক্ষ শক্তি বা খলনায়কের ভূমিকায়। পক্ষশক্তি এমন অনাচারের সাথে যুক্ত রয়েছে কিছু পরাশক্তি। তাতে শাসক শ্রেণী যা ইচ্ছা তাই করার সাহস পাচ্ছে।
লক্ষ করার বিষয়, সরকারি দলের শীর্ষ নেতাদের অঙ্গীকার হচ্ছে, তারা নাকি ভালো নির্বাচন চান। তবে কেন সর্বজন স্বীকৃত ও সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন একটি প্রশাসনের কাছে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে, সবার সাথে এক কাতারে এবং একই সুযোগ সুবিধা নিয়ে ভোটের যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে না, এতে সমস্যা কোথায়। ১৫ বছর একনাগাড়ে ক্ষমতায় থেকে তারা নাকি দেশের প্রচুর ‘উন্নয়ন’ করেছে। তবে কেন তেমন একটা ব্যবস্থার অধীনে ভোট করতে বাধা এবং শাসকরা বারবার বলছেন, ‘আমি কি ডরাই রাঘবে’। সত্যি যদি তারা নাই ডরাতেন। একবার না হয় মোকাবেলা করেই দেখান না কেন! আসলে শাসকরা তাদের ‘মূল্যায়নে’ আস্থা রাখতে পারছেন না। তাদের ভয় কেঁচো খুঁড়তে যদি সাপ বেরিয়ে পড়ে। সরকারি দল সব নিয়ে কিন্তু সোরগোল করছে। এ ক্ষেত্রে এক গ্রাম্য প্রবাদের কথা অনেকের মনে উদয় হতে পারে। যেমন- রাতে বাঁশ ঝাড়ের নিচ নিয়ে চলার সময় ভূতের ভয়ে কারো গা ছমছম করে। তখন বাঁশঝাড় অতিক্রমের সময় উচ্চ কণ্ঠে গান গাওয়া শুরু করে। আজ সরকারের অবস্থাটাও কি সেরকম!

যা হোক, এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের বিষয় নিয়েই কথা বলা যাক। সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবির বিপরীতে একটি যেনতেন নির্বাচনের ব্যবস্থার আয়োজন নিয়ে সরকার ও কমিশন একত্রে অভিন্ন ধারায় চলছে। যেমন একটি ‘থোড় বড়িখাড়া’ গোছের নির্বাচন অনুষ্ঠানের চতুর্মুখী প্রয়াস চালাচ্ছে শাসকরা।

বিএনপি ও তার সহযোগীরাসহ জামায়াত জানবাজি রেখে আন্দোলন নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের সাথে রয়েছে কোটি জনতার সরব, কখনো নীরব শুভেচ্ছা সমর্থন। উপরে বলা হয়েছে জনসমর্থিত, এই আন্দোলনের স্বরধ্বনি দেশের সীমান্ত পার হয়ে বহুদূর গেলেও ক্ষমতাসীনদের মন-মগজে সে ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে না। শাসকরা বরং তাদের প্রতিপক্ষ শক্তি ও জনগণকে পথেঘাটে বনবাদাড়ে শুধু তাড়িয়ে বেড়াচ্ছেই না, শাসক দল তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের কারাগারের অন্ধ গহ্বরে ঢুকিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে শেষ করে ফেলতে চায়। সেজন্য পক্ষশক্তির এক নেতা দম্ভভরে বলেন, আগামীতে এ দেশে বিএনপি-জামায়াতের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। আসলে দেশকে একটা ‘অরণ্যের রাজ’ প্রতিষ্ঠার সবরকম প্রয়াস চালানো হচ্ছে।

বলা হয়েছে, আগামীতে বিএনপি-জামায়াতের অস্তিত্ব আর এই জনপদে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ কথার সত্যতা অবশ্যই আছে। মানুষ যা দেখছে এবং শুনছে, শত শত মানুষ গুম খুন হয়েছে। সে ধারা এখনো চলমান। অবাক লাগে, মানুষ নিধনের এমন ঘোষণা কিভাবে প্রকাশ্যে কেমন করে দিতে পারছে পক্ষশক্তির নেতৃত্ব? কোথায় আইন আর কোথায় আইনের শাসন? জানি, দেশের মানুষ অধিক এখন শোকের পাথর। কিন্তু বিশ্ববিবেক কি তাদের চোখ কান বোধ বিবেচনা সব অন্যত্র বন্ধক দিয়ে বসে আছে? হয়তো শাসকরা সেটাই ভাবছেন। না, তাদের ভাবনা সঠিক নয়। জাতিসঙ্ঘ সম্প্রতি দেশের সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমের মতো ঘটনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে। তারা এ ঘটনার যাবতীয় তথ্য জানতে চেয়েছে। তবে এসব বিষয় জানতে চাওয়ার অর্থ এই নয় যে, তারা কোনো কিছু জানেন না। তারা শুধু এ নিয়ে ব্যবস্থা নেয়ার আগে বাংলাদেশের সরকারের বক্তব্যটা জানতে চান। জাতিসঙ্ঘ যা করার সেটা করবে। সেখান থেকে পার পাওয়া আদৌ সহজ নয়।

কেউ কেউ বলছেন, শাসকরা নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গের মতোই কাজ করছেন। যেমন দেশের সম্পদের সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। অথচ সেই সম্পদ এখন নষ্ট বা ধ্বংস করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এমন সব অপকর্ম বা গর্হিত কাজ বিরোধী দলের লোকজনরাই করছে। অপর দিকে, খোদ জাতিসঙ্ঘ সব জারিজুরি ফাঁস করে দিয়েছে। তারা পরিষ্কার মন্তব্য করেছে, ক্ষমতাসীনদের সমর্থকদের দ্বারা যত সন্ত্রাসী কর্ম সংঘটিত হচ্ছে। এখন তাহলে বলতে হয়, শাসকরা নিজের নাক শুধু কাটতে শুরু করেছেন। সেই সাথে কী কাটা পড়বে সেটা এখন বলা যাবে না। এতটুকুতে ক্ষান্ত থাকা যাক, অতি চালাক শেষে প্রমাণিত হয়, তারাই বুরবক। সবাই বলে, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। ক্ষমতাসীনরা সেটা করে প্রমাণ করছেন। আরো বোঝার বিষয়, সরকারি সম্পদ পুড়িয়ে আসলে কারা অগ্নিউৎসব করছে? প্রশ্ন হতে পারে, কোন সে পামর আইন রক্ষাকারী বাহিনীর পাশে থেকেই অগ্নিউৎসবে যোগ দিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ছে। আরো অবাক হওয়ার বিষয়, এসব অপকর্ম অনুসন্ধানের কোনো খবর এ যাবত কোনো পত্রিকায় বা অন্য কোনো মিডিয়ায় আসছে না কেন? আবার কিছু মিডিয়ায় অতি উৎসাহ অগ্নিউৎসবের খবর ফলাও করে প্রকাশ করে। কিন্তু কারা করছে, কোন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। তারা প্রকাশের সামান্য চেষ্টা পর্যন্ত করছে না। এটা কি তথ্য প্রকাশে অনৈতিকতা নয়?

এদিকে কথিত নির্বাচনী বৈতরণী পার করানোর কাজটি খুব সহজ করার জন্য অনেক মিডিয়াই উঠেপড়ে লেগেছে। তা হলে আর সত্য প্রকাশে মিডিয়া অবিচল, বলা অর্থ কী? মিডিয়ার সবাই দাবি করেন, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হচ্ছে মিডিয়া। এখন দেশের অপর তিন স্তম্ভের চতুর্থ স্তম্ভকেও কি উলি পোকায় খেয়ে ধ্বংস করতে চলেছে? তাহলে বাংলাদেশ এখন কোন্ স্তম্ভের ওপর ভর করে দাঁড়াবে?

ndigantababar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement