২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সমকালীন প্রসঙ্গ

২৮ অক্টোবরের রোজনামচা

২৮ অক্টোবরের রোজনামচা - নয়া দিগন্ত

অনেক বাঙালির মতো আমারও ভুলে যাওয়ার অভ্যাস খুব বেশি। আর এই অভ্যাস কেনই বা হবে না- কারণ বাঙালির প্রাত্যহিক জীবনচক্রে প্রকৃতি ও প্রাণীর আচরণে এত ভিন্নতা যা মহাবিশ্বের অন্য কোথাও নেই। নিরিবিলিতে সময় কাটানোর জন্য অথবা টিএস ইলিয়টের মতো একখানি কবিতা রচনার ভাব যদি আপনাকে পেয়ে বসে তবে নিশ্চয়ই আপনি কোনো বাঙালি নদীর তীরে বিশালকায় বটবৃক্ষ দেখলে সেখানে বসে কিছু একটা করার চিন্তায় বিভোর হওয়ার চেষ্টা করবেন। তারপর লক্ষ করবেন, গোটা দশেক মাছি এসে আপনাকে গান শোনানোর জন্য অস্থিরতা দেখাচ্ছে। মাছিদের দেখাদেখি এক ঝাঁক মশাও চলে আসবে আমন্ত্রিত অতিথির মতো। এরই মধ্যে দেখবেন কয়েকটি জোঁক আপনার পদপ্রান্তে এমন চুম্বন বসিয়েছে যার শিহরণে আপনার শরীরের বিশেষ অঙ্গগুলোতে এক ধরনের ঝাঁকুনি শুরু হয়ে গেছে।

উল্লিখিত অবস্থায় আপনি ধৈর্য না হারিয়ে আবার কাব্য প্রতিভার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার চেষ্টা যখন নতুন উদ্যমে শুরু করেছেন, ঠিক তখন কোত্থেকে যেন সাত-আটটি নেড়ি কুত্তা আপনার আগমনে অতিশয় আনন্দ প্রকাশ করার জন্য- আপনাকে ঘিরে এমন ঘেউ ঘেউ শুরু করল- যার কারণে মশা-মাছি-জোঁকের যন্ত্রণা আপনি বেমালুম ভুলে গেলেন। কবিতার ভূত মাথা থেকে বটগাছের ডালে উঠল এবং আপনি যখন ভালো করে চারদিকে তাকালেন তখন লক্ষ করলেন, দুষ্টু কিছু পাখি তাদের বাহারি বিষ্ঠা দিয়ে আপনার পরিচ্ছদ ও মস্তিষ্কের ঊর্ধ্বাংশ রঞ্জিত করে দিয়েছে। আপনাকে স্বাগত জানানোর জন্য কোত্থেকে যেন এক দঙ্গল পোলাপান চলে এসেছে এবং তারা আপনার হালহকিকত দেখে এমন খুনসুটি শুরু করল যে, কুকুরের নাচন-কুদন-পাখির মলত্যাগ আপনি ভুলে যেতে বাধ্য হলেন এবং বাংলাদেশে কেন নিউটন পয়দা হয়নি সেই মহাসত্যটি আবিষ্কার করে আপনার আলয়ে ফেরার পথে আরো অনেক ঘটনার তাণ্ডবে বাঙালি নদীর তীরে বটবৃক্ষের তলে যা কিছু ঘটেছে তা ভুলে গেলেন।

বাঙালির প্রাত্যহিক জীবনের হাজারো সমস্যা হাজারো সম্ভাবনা হাসি-আনন্দ-বেদনা সুনামি-কালবৈশেখী অথবা মরুঝড় সাইমুমের মতো এতটা প্রবল বেগে আঘাত হানে যার কারণে আত্মভোলা, ভুলে যাওয়া অথবা স্মরণে না থাকার মতো মনস্তাত্ত্বিক রসায়নে আমি যেন ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসের ২৮ তারিখটি ভুলে না যাই সে জন্য দিনটিতে কী ঘটেছিল তার কিছু চাক্ষুষ বর্ণনা আপনাদের কাছে পেশ করার চেষ্টা করব। ২৮ অক্টোবরের পূর্ববর্তী দিন এবং পরবর্তী দিনের ঘটনা ও অনুঘটনাকে কেন্দ্র করেই বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতি-সামাজিক এবং পারিবারিক সম্পর্ক আবর্তিত হচ্ছে। ২৮ অক্টোবরের ওপর ভিত্তি করে যে ইতিহাসের সৃষ্টি হয়েছে তার রেশ আগামী ২৫ বছর পর্যন্ত চলতে থাকবে এবং দিনটির প্রভাবে আমরা যে দুঃখ-দুর্দশার মায়াবী জালে আটকা পড়েছি তা থেকে বের হতে কয়েক যুগ সময়ের প্রয়োজন হবে। ফলে গত ৫০ বছরের ইতিহাসে যেসব দিনকে আমরা স্মরণ করতে বাধ্য হই সেগুলোর সাথে ২৮ অক্টোবর নতুন করে কেন যুক্ত হলো তার কার্যকারণও আপনাদের বলব।

আলোচনার শুরুতে ২৮ অক্টোবর সম্পর্কে একটি সূচনা বক্তব্য দেয়া আবশ্যক। দিনটিকে আমার কাছে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরের ঘটনা অথবা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতের ঘটনার মতো সুদূরপ্রসারী বলেই মনে হচ্ছে। অর্থাৎ ২৮ অক্টোবরের কারণে আমাদের জীবনে বিদেশী প্রভাব অপরিহার্য হয়ে পড়তে পারে অথবা আমরা গণতন্ত্রের বিজয়ের মহীসোপানের বাসিন্দা হয়ে যেতে পারি। বাংলাদেশ সম্পর্কে পশ্চিমা দুনিয়া-দিল্লি ও চীনের যে অতি আগ্রহ হালআমলে দেখতে পাচ্ছেন ঠিক তদ্রুপ আগ্রহের কারণে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। অন্য দিকে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিনের বেলায় যা কিছু ঘটেছে তা দেখে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে, ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস হতে চলেছে।

অতীতের নানামুখী তৎপরতা এবং অপতৎপরতায় মানুষ যখন মজলুম হয়ে পড়েছে এবং বাতাসে বারুদের গন্ধ ছড়িয়ে হাতকে দুর্বল করে হাতিয়ারকে মারণাস্ত্র বানানো হয়েছে তখন পৃথিবীর ঘটনাপঞ্জি উল্টে দেয়ার জন্য নিয়তির খেলা শুরু হয়েছে। মানুষের জবান যখন বোবা প্রাণীর মতো হয়েছে কিংবা ময়না-টিয়া-শালিকের মতো হয়ে গেছে তখনো প্রকৃতি নিদারুণ খেলা খেলেছে। মানুষের দৃষ্টিতে যা ধরা পড়েছে তার সাথে যখন প্রকৃত ঘটনার মিল ছিল না, তখন প্রকৃতি তার আপন মহিমাতে জমিনে এমন ভেলকিবাজি দেখিয়েছে যা রক্তমাংসের ভেলকিবাজরা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। সুতরাং ২৮ অক্টোবর নিয়ে অনাগত দিনে নতুন ইতিহাস সৃষ্টির আগেই সেদিনের রোজনামচা বর্ণনা করা আবশ্যক।

ঘটনার দিন খুব সকালে আমি অফিসে আসি। আমার অফিসের অবস্থান বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অফিসের ঠিক মাঝামাঝি স্থান, তোপখানা রোড। ঘটনার দিনের উত্তেজনায় আমি ছিলাম অস্থির। খাওয়া-দাওয়া কাজকর্ম ফেলে কম্পিউটারে বসে ঘটনাপ্রবাহ দেখছিলাম। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের শত শত সরাসরি অনুষ্ঠান বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে এমনভাবে প্রচার হচ্ছিল যার কারণে আমার কম্পিউটারের ১৬ ইঞ্চি পর্দার মধ্যে পুরো ঢাকা মহানগরসহ দিল্লি ওয়াশিংটনের বাংলাদেশবিষয়ক প্রতিক্রিয়া দিবালোকের মতো দৃশ্যমান হচ্ছিল। দুপুর ১২টা নাগাদ শাহবাগ থেকে মৎস্য ভবন ও সেখান থেকে কাকরাইল মসজিদ হয়ে নয়াপল্টন এবং তারপর ফকিরের পুল-আরামবাগ ও গোপীবাগ পর্যন্ত সব অলিগলি ছিল লোকে লোকারণ্য।

আওয়ামী লীগের সমাবেশ উপলক্ষে কার্জন হল থেকে উসমানী উদ্যান-তারপর জিরো পয়েন্ট থেকে ভাসানী স্টেডিয়াম ছিল রীতিমতো জনারণ্য। সবার মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও নির্ভার নির্ভীক একটি ভাব থাকার কারণে আমজনতা ধরে নিয়েছিল যে, সন্ধ্যার আগেই বিএনপি-আওয়ামী লীগের সমাবেশ অতীতের মতো শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হবে। ২৮ অক্টোবরে পুলিশি অ্যাকশনের আগে ছোট্ট দুটো ঘটনা ঘটেছিল যার কার্যকারণ খুঁজে পাওয়া যায়। প্রথমটি ঘটে কাকরাইল মসজিদের সামনে। সেখানে বিএনপি-আওয়ামী লীগ কর্মীদের মধ্যে মারধর-ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয় এবং পুলিশের মধ্যস্থতায় ১০ মিনিটের মধ্যে দফারফা হয়ে যায়। দ্বিতীয় ঘটনা ঘটে আওয়ামী লীগের সভামঞ্চে। কে বা কারা গুজব রটায় যে, বিএনপি নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগের জনসভার দিকে লাঠিসোটা নিয়ে ধেয়ে আসছে।

উল্লিখিত গুজবে আওয়ামী লীগের জনসভায় চিত্তচাঞ্চল্য দেখা দেয়। হাজার হাজার নেতাকর্মী দিগিবেদিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন। নেতারা মঞ্চ থেকে উপর্যুপরি ঘোষণা দিতে থাকেন যে, কেউ গুজবে কান দেবেন না। বিএনপির কেউ আসছে না, ভয় পাবেন না ইত্যাদি। ফলে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে অস্থিরতা ভয়-আতঙ্ক-দৌড়াদৌড়ি বন্ধ হয় এবং জোহরের আজান ও মধ্যাহ্নভোজনের সময়ে পুরো পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণভাবে এগোতে থাকে। এমতাবস্থায় লোকজন বলাবলি শুরু করে- কোন সমাবেশে কত লোক এসেছে, পরবর্তী কর্মসূচি কী হতে পারে ইত্যাদি। সমাবেশস্থলের খাবার হোটেল, পান-বিড়ি-চায়ের দোকানে উৎসবের আমেজ এবং কোথাও ভয়-ভীতি-আতঙ্কের চিহ্নমাত্র ছিল না। কিন্তু হঠাৎ প্রধান বিচারপতির বাসভবনকে কেন্দ্র করে এমন কিছু ঘটল যার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের মাত্র ৩৫ মিনিটের নজিরবিহীন অ্যাকশনে বিএনপির সমাবেশে যে বিভীষিকা নেমে এলো তা নিয়ে দেশ-বিদেশে বিতর্কের শেষ নেই। আমি আজকের নিবন্ধে সেসব বিতর্ক নিয়ে আলোচনা না করে বরং বিএনপির একটি শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক সমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে যে ভয়াবহ পরিণতির দিকে আমরা পুরো জাতি ধেয়ে চলেছি তা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব।

২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশটি পুলিশি অ্যাকশনে পণ্ড এবং ২৯ তারিখ দিনে ও রাতে সারা দেশে পুলিশি তৎপরতার কারণে বাংলাদেশ যে সন্ধিক্ষণে পৌঁছে গেছে সেখান থেকে পরিণতি ভোগ না করে কোনো পক্ষেরই ঘরে ফেরা সম্ভব নয়। সেদিনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশ-কাল-সমাজে নিম্নরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

১. পুরো দেশের মানুষের বিভেদ-বিসংবাদ, পারস্পরিক ঘৃণা-ক্রোধ ও একদল অন্য দলকে নির্মূল করার জন্য যেভাবে বদ্ধপরিকর হয়ে মাঠে মহড়া দিচ্ছে তা অতীতে কোনো দিন দেখা যায়নি।

২. তিক্ত ও উত্তপ্ত সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে মন্দ মানুষগুলো সম্মুখসারিতে চলে এসেছে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য এবং ভালো মানুষগুলো নেপথ্যে চলে গেছে। ফলে অস্থিরতা প্রকাশিত হলে সর্বস্তরে যে শূন্যতা সৃষ্টি হবে তা পূর্ণ করার জন্য যোগ্য লোক পাওয়া যাবে না। এ অবস্থায় অনাগত দিনে দুর্ভোগ-দুর্দশা-অনাচার-অবিচার-দুর্নীতি-দরিদ্রতাসহ অসভ্যতার সব উপকরণ আমাদের অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরবে।

৩. আমাদের দেশে বিদেশীদের আধিপত্য বাড়বে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ কিংবা নেপালের চেয়েও আমাদের রাজনীতি জটিল আকার ধারণ করবে এবং বিদেশী শক্তির চরিত্র ও মেজাজমর্জি অনুযায়ী আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিবর্তন ঘটবে।

৪. আমাদের আর্থিক ব্যবস্থা মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে এবং জনজীবনে অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা ও অসম্মানের বোঝা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাবে।

৫. গণতন্ত্র শাসনতন্ত্র রাজনীতি ইত্যাদির নতুন সংজ্ঞা রচিত হবে এবং রাজনীতির ময়দানের দুটো বৃহৎ শক্তির মধ্যে একটির পতন এমনভাবে হবে যে, আগামী ২৫ বছরের মধ্যে তাদের নামটি উচ্চারণের মতো লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে তা পূর্ণ করার মতো ক্ষমতা এই জমিনের কোনো মানুষের হাতে থাকবে না।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement