২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ফিলিস্তিনি জাতিসত্তা নির্মূলের প্রকল্প

ফিলিস্তিনি জাতিসত্তা নির্মূলের প্রকল্প - নয়া দিগন্ত

গাজা উপত্যকার ২৩ লাখ মানুষের ওপর ৪৪ দিন ধরে ইসরাইলের নজিরবিহীন বোমা হামলায় লাশের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে এবং বইছে রক্তবন্যা। নির্বিচারে চলছে গণহত্যা ও ধ্বংস-প্রক্রিয়া। গাজা আকাশের নিচে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কারাগার; যেখানে হত্যাযজ্ঞের তাণ্ডব চলছে। বিদ্যুৎ, খাদ্য, জ্বালানি, সুপেয় পানি ও ওষুধ সঙ্কটে অবরুদ্ধ গাজায় সৃষ্টি হয়েছে মানবিক বিপর্যয়। হাসপাতাল, উদ্বাস্তু শিবির, আবাসিক ভবন, মসজিদ এবং গির্জা বোমাবর্ষণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না।

৭ অক্টোবর থেকে ১২ হাজার ফিলিস্তিনি শাহাদতবরণ করেছেন। এর মধ্যে পাঁচ হাজার শিশু। ৪৫ শতাংশ বাড়িঘর ধসে পড়েছে। গাজা ভূখণ্ডের জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলের হামলায় ১৯৫ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হন। ৩৫টি হাসপাতালের মধ্যে ২৬টি বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত হয়ে গেলে আহতদের চিকিৎসা দেয়ারও ব্যবস্থা নেই। জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্থা ত্রাণসামগ্রীর সাথে কাফনের কাপড়ও পাঠাচ্ছে। নিধনযজ্ঞের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানিসহ সব পশ্চিমাশক্তির গ্রিন সিগন্যাল নিয়ে ফিলিস্তিনি জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার প্রকল্প বাস্তবায়নে এগিয়ে চলেছে ইসরাইল। মানবাধিকার নিয়ে সরব পশ্চিমা বিশ্ব তাই গাজায় চলমান স্পষ্ট গণহত্যা নিয়ে নিশ্চুপ। একের পর এক জাতিসঙ্ঘের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নাকচ করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।

ইসরাইলের অবরোধ ও হামলার শিকার গাজার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আশ-শিফায় পানি ও অক্সিজেন ফুরিয়ে গেছে। হাসপাতালটিতে ৬৫০ জনের বেশি রোগী আছেন। রয়েছেন ৫০০ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী। হামলায় বাস্তুচ্যুত হওয়া পাঁচ হাজার ফিলিস্তিনিও হাসপাতাল প্রাঙ্গণে আশ্রয় নিয়েছেন। হাসপাতালটি ঘিরে রেখেছে ইসরাইলি ট্যাংক। সেনারা হাসপাতালে তল্লাশি চালাচ্ছে।

একটি ছোট্ট ভূখণ্ডে ১৬ বছর ধরে অবরুদ্ধ থাকা ২৩ লাখ মানুষের বিষয়ে ইসরাইলি নেতারা যেসব মন্তব্য করেছেন তা রীতিমতো আঁতকে উঠার মতো। আল-জাজিরাকে দেয়া ইসরাইলি ক্যাবিনেট সদস্য মোশে ফিগলিন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এ সমস্যার একমাত্র সমাধান হলো পারমাণবিক বোমার ব্যবহার ছাড়া ড্রেসডেন ও হিরোশিমার মতো গাজাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলা। ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গালান্ত ফিলিস্তিনিদের ‘নররূপী জানোয়ার’ আখ্যা দিয়ে পুরো গাজা মুছে ফেলা দরকার বলে বক্তব্য দিয়েছেন। ইসরাইলি গবেষক এলিইয়াহু ইয়োসিয়ানের মন্তব্য আরো ভয়াবহ। তিনি গাজায় হামলা চালানো ইসরাইলি সেনাদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘প্রতিশোধের নেশা, শূন্য মাত্রার মানবিকতা ও সর্বোচ্চসংখ্যক লাশ জড়ো করার কথা মাথায় নিয়ে নৃশংসতম রূপ নিয়ে আপনাদের গাজায় ঢুকতে হবে।’

আর এ কানানেহ ‘স্ট্র্যাটেজিজ অব প্যালেস্টানিয়ান উইমেন ইন ইসরাইল’ নামের বইতে বলেন, ফিলিস্তিনি নারীদের জরায়ুকে হুমকি হিসেবে প্রচার করে ইসরাইল। কেননা, জায়নিস্ট রাষ্ট্রবাসনা আর সব জাতিসত্তাকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। ফিলিস্তিনিদের জন্ম রুখতে চায়। ২০১৪ সালে ইসরাইলি আইনপ্রণেতা এয়িলেট শ্যাকেড পুরো ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে শত্রু ঘোষণা দিয়ে নারীদের হত্যার ডাক দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়েছিলেন। তার সেই পোস্ট হাজার হাজার লাইক কুড়িয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ওই নারীদের হত্যা করতে হবে, কেননা তারা ‘সাপের বাচ্চা’র জন্ম দেয়।

জায়নবাদী ক্ষমতাকাঠামো দুনিয়াজুড়ে আধিপত্য নিরঙ্কুশ করার যন্ত্র-প্রকৌশলের ল্যাবরেটরি হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে ফিলিস্তিনকে। ইসরাইলি বিমান হামলায় মরতে বসেছেন; এমন অন্তঃসত্ত্বা নারীর গর্ভ থেকে জীবন্ত নবজাতক বের করে আনছেন গাজার ডাক্তাররা। মা মরে গেলেও নবজাতক আইসিইউতে প্রাণান্ত চেষ্টা চলছে অপরিপক্ব শিশুদের বাঁচানোর। উপত্যকার সাতটি নবজাতক আইসিইউতে রয়েছে ১৩০টি অপরিপক্ব শিশু। তারা বাঁচবে কি না, তা নিশ্চিত নয়। কারণ যেকোনো মুহূর্তে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হতে পারে হাসপাতাল। তার পাঁচ মিনিটে ওই শিশুরা মারা যাবে (বাধন অধিকারী, বিডিনিউজ২৪.কম) ইতোমধ্যে অনেক নবজাতক মারা গেছে। জায়নবাদী প্রকল্পের অংশ হিসেবে শিশুহত্যাকে নির্বিচারী রূপ দেয়া হয়েছে সেখানে। আন্তর্জাতিক সংস্থা বলছে, যে সঙ্ঘাতে এভাবে শিশুহত্যার নজির বিশ্বে আর নেই।

কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের তথ্য থেকে জানা যায়, আজ পর্যন্ত ইসরাইলকে দ্বিপক্ষীয় সহায়তা ও সামরিক অর্থায়ন বাবদ ১৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলার দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। চলতি বছর মার্কিন সামরিক অর্থায়নে ইসরাইলে বরাদ্দ ৩৮০ কোটি ডলার। ইসরাইলের আগ্রাসী প্রজেক্টের সাথে যুক্তরাষ্ট্র কতটা একাত্ম সেটি বুঝা যায় প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বক্তব্য থেকে। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থ দেয়, সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। ইসরাইল নামে কোনো রাষ্ট্র না থাকলে সেরূপ একটি রাষ্ট্রকে নির্মাণ করতে হতো।’ এখন যুক্তরাষ্ট্র সে বিনিয়োগকে দিন দিন বাড়িয়ে চলেছে। ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধের নিন্দা জানিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়া ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। দক্ষিণ আমেরিকার আরো দু’টি দেশ কলম্বিয়া ও চিলি নিজেদের দূতকে ইসরাইল থেকে সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু বড়ই লজ্জার বিষয় ও সে সাথে অতি ধিক্কার জানানো বিষয় হলো, তুরস্ক, জর্দান, বাহরাইন, সুদান, মরক্কো, ওমান ও আরব আমিরাত ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি এবং দূতদেরও সরিয়ে আনেনি। এ থেকে বোঝা যায়, ফিলিস্তিনিদের প্রতি যে গণহত্যা চলছে; সেটি নিন্দা করার যে বিবেক ও মানবতার প্রয়োজন হয় তা এসব দেশের শাসকদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই। তাই যে মানবতা বলিভিয়ার শাসকের মধ্যে দেখা যায় সেটি তুরস্ক, জর্দান, বাহরাইন, সুদান, মরক্কো, ওমান ও আরব আমিরাতের শাসকদের মধ্যে বেঁচে নেই (ডা: ফিরোজ মাহবুব কামাল)।

তুরস্কের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুলের মন্তব্য বেশ প্রণিধানযোগ্য- ‘ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইসরাইলের লাগাতার দখল হামলা, আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে পশ্চিমতীরে অবৈধ বসতি স্থাপন, জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব অমান্য করা, আন্তর্জাতিক আইন ও মূল্যবোধকে অস্বীকার করে যাওয়া এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন নিরবচ্ছিন্নভাবে লঙ্ঘন করে যাওয়া আজকের এ পরিস্থিতি তৈরি করার পেছনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে বলে আমি মনে করছি। এর বাইরে গাজা ভূখণ্ডে দীর্ঘদিন ধরে ২৩ লাখ ফিলিস্তিনি বাসিন্দাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে পশ্চিমা বিশ্বের পাশাপাশি আরববিশ্ব চুপ থাকায় পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। এতে ফিলিস্তিনের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গত পাঁচ দশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটি টেকসই শান্তিপ্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফিলিস্তিন ও ইসরাইল নামের দু’টি সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে দেশ দুটির সহাবস্থান নিশ্চিত করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্ব সর্বতোভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সেই ব্যর্থতার কারণে আজকে পুরো ফিলিস্তিন অঞ্চলে মানবিক পরিস্থিতি শোচনীয় পর্যায়ে। আজকে গাজায় ফিলিস্তিনি শিশুরা ইসরাইলি বোমায় নিহত হওয়ার আশঙ্কায় আগেভাগে মা-বাবাকে বিদায় জানিয়ে চিঠি লিখে পকেটে রেখে দিচ্ছে। এটি আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা পুরো বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইসরাইল যে কৌশলে গাজায় হামলা চালাচ্ছে, সেটি অবশ্য আন্তর্জাতিক যুদ্ধ আইন লঙ্ঘন করছে। সাধারণ গাজাবাসীকে বিদ্যুৎ, পানি, খাবার, জরুরি ওষুধ পাওয়ার সব সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে রাখা হচ্ছে। হাসপাতাল, মসজিদ, গির্জা, স্কুল, শরণার্থী শিবিরের মতো জায়গায় বোমা ফেলা হচ্ছে। এটি জেনেভা কনভেনশন ও এর সম্পূরক প্রটোকলগুলোর সম্পূর্ণ বিরোধী। গাজায় ইসরাইলের এ অসম হামলা নিঃসন্দেহে যুদ্ধাপরাধ ছাড়া আর কিছু নয় এবং ইতিহাস এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতি বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদী সরকারের উত্থান ঘটাচ্ছে (প্রথম আলো, ১৮ নভেম্বর-২০২৩)।
ফিলিস্তিনি জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার ইসরাইলি প্রকল্প কতটুকু সফল হয় তা আল্লাহ-ই ভালো জানেন। তবে ইসরাইলি বর্বরতায় আরব ও অনারব জনগণের মধ্যে হামাসের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। আরবসহ গোটা বিশ্বে ফিলিস্তিনের জনগণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বোমার আঘাতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তাদের স্বপ্নের মৃত্যু হবে না। আগামী দিনে ইসরাইলকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।

লেখক : অতিথি অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম


আরো সংবাদ



premium cement