২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


র‌্যাগিংয়ের নামে নির্যাতন ও ছাত্ররাজনীতি

র‌্যাগিংয়ের নামে নির্যাতন ও ছাত্ররাজনীতি - নয়া দিগন্ত

গত ১২ অক্টোবর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিং নিয়ে আপত্তি করায় পিটিয়ে এক ছাত্রের হাত ভেঙে দিয়েছে সহপাঠীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের একটি কক্ষে আটকে রাতভর নির্যাতন চালানো হয় মুকুল আহমেদ নামে ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ওই ছাত্রের ওপর।

১৪ অক্টোবর খবরটি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ পায়। এ খবর পড়ে নিদারুণ মর্মাহত হন আমাদের পরিচিত একজন জ্যেষ্ঠ নাগরিক। নিশ্চয়ই তার মতো অনেকেই কষ্ট পেয়েছেন, ব্যথিত হয়েছেন এবং শঙ্কিত ও আতঙ্কিত হয়েছেন। যারা সন্তানকে লেখাপড়া করতে উচ্চ শিক্ষালয়ে পাঠান তাদের দুশ্চিন্তা আরো বেশি। সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেকে দিশেহারা বোধ করেন, হতাশায় মুহ্যমান হয়ে পড়েন। কিন্তু কিছুই করার নেই তাদের। তবে আমাদের পরিচিত সেই জ্যেষ্ঠ নাগরিক ফোন করে অনুরোধ করে বলেন, সম্ভব হলে বিষয়টি নিয়ে লিখবেন। প্রতিকারের আশা কম, নিজেই সে কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যদি কোনোভাবে কিছু কাজ হয়!

নির্যাতিত শিক্ষার্থী মুকুল আহমেদ নরসিংদীর একটি নিতান্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বাবা এক কাঠমিস্ত্রির সহকারী। আট সন্তানসহ তার বড় পরিবার। সেই পরিবারের ছেলে মুকুলের জীবন-সংগ্রাম কতটা তীব্র, কতটা দুরূহ বোঝা কষ্টকর নয়। ছোট বোন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। মুকুল ছাত্র পড়িয়ে নিজের ও ছোট বোনের লেখাপড়ার খরচ চালায়। জীবনের সাথে এ যে কত বড় লড়াই, কত বড় বীরত্ব, সেটি সচ্ছল পরিবারের সব পেয়ে বেড়ে ওঠা ফার্মের মোরগরা বোঝে না। বোঝে না বলেই তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। বুয়েটের মেধাবী ছাত্রকে রাতভর পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে, কাউকে মেরে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে পারে। আমরা শুধু বিস্মিত হয়ে ভাবি, এদের শরীর কী দিয়ে তৈরি? এতটুকু দয়ামায়া, মমত্ব, করুণা কিছুই নেই? এরা কি কোনো পরিবারের আবহে বড় হয়নি? বাবা-মা, ভাইবোনের কোনো সাহচর্য, স্নেহ, ভালোবাসা, মানুষকে ভালোবাসার শিক্ষা, জীবনের মূল্য বোঝার মতো জ্ঞান- কিছুই যদি না থাকে, তাহলে এরা কি মানুষ পদবাচ্য?

রাষ্ট্রের আইন-কানুন এদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, সেটি তারা জানে। জানে বলেই তারা বেপরোয়া। বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে যে রাতে খুন করা হয় সে রাতে ক্যাম্পাসের পুলিশ, বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও আবরারের শিক্ষক, হলের বন্ধু, সহপাঠী অনেকেই ব্যাপারটি জানত। আর সবার কথা বাদ দেই, পুলিশ ও শিক্ষকরা কেন এগিয়ে গেলেন না? জবাবটা এখানেই আছে। যারা খুনটা করেছে তারা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দায়মুক্তি পাওয়া। এদেরকে কিছু বলতে যাওয়া মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা। আগে এমন কর্তব্য পালন করতে গিয়ে অনেককেই বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে। দৃষ্টান্ত আছে। কাউকে বদলি হতে হয়েছে, কারো পদোন্নতি আটকে গেছে, কেউ বা শারীরিক ও মানসিক হেনস্তার মুখে পড়েছেন।
আরেকটি উপায় ছিল- সারা দেশের মানুষের একযোগে এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। সেটি হয়নি। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্বলতা আছে; গণমাধ্যমের ভীতি ও শঙ্কার কারণ আছে। আছে দলবাজি সমস্যাও।

মুকুলের হাত কারা ভেঙেছে সেটিও সবার জানা। এক মুকুলের ঘটনা তো নয়, সারা দেশে এমন হাজার হাজার শিক্ষার্থী প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে শারীরিক অথবা মানসিক নির্যাতন অর্থাৎ র্যাগিংয়ের শিকার হচ্ছেন। কখনো সিনিয়রকে সালাম না দেয়ায়, মুখে মুখে কথা বলায়, দলের মিছিলে না যাওয়ায়, সিনিয়র ভাইয়ের খেদমত ঠিকমতো না করায় এবং এমনই হাজারটা কারণে। আর রাজনৈতিক ভিন্নমত তো আছেই।
আমরা বিভিন্ন সময়ে জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত কয়েকটি খবরের শিরোনাম দেখে নিতে পারি :
বুয়েট ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ
সিলেট এমসি কলেজে ধর্ষণ : দুই বছরেও শুরু হয়নি সাক্ষ্যগ্রহণ
ফুলপরীকে নির্যাতন : সানজিদাসহ পাঁচজনকে বহিষ্কার ইবির
ফাঁদে ফেলে ছয় নারী ধর্ষণ ছাত্রলীগ নেতার, ভিডিও ইন্টারনেটে
হাসপাতালে কিশোরীকে ধর্ষণ করল ছাত্রলীগ নেতা
ধর্ষণের অভিযোগে এবার ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ নেতা গ্রেফতার
লালমনিরহাটে হিন্দু গৃহবধূকে ধর্ষণের অভিযোগ ছাত্রলীগের নেতার উপর
ধর্ষণকাণ্ডে কেন বারবার ছাত্রলীগ?

গুগলে সার্চ দিলে অথবা গত ১৫ বছরের দৈনিক পত্রিকার পাতা খুললে এ ধরনের হাজারো ঘটনার খবর পাওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে লাখ লাখ ঘটনা। ধর্ষণ যেন কিছু শিক্ষার্থীর নেশায় পরিণত হয়েছে। ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদযাপন করে একজন দু’জন নয়, পুরো বিশ^বিদ্যালয় শাখার নেতাকর্মীরা। সেই কাহিনী আন্তর্জাতিক খবর হয়েছে।
দেশের ও বিদেশের সবাই জানেন, বাংলাদেশে কেমনতর ভীতির পরিবেশ বিরাজ করছে। স্থানীয় সাংবাদিকরা বিশেষ বিশেষ দল ও সংগঠনের অপকর্মের খবর প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন, এটিও সবার জানা। আবার পত্রিকার সদর অফিসে কিভাবে সেলফ সেন্সরশিপ মেনে চলতে বাধ্য হন সাংবাদিকরা সেটিও অজানা নয়। এসব কারণে বেশির ভাগ খবরই থেকে যায় অপ্রকাশিত এবং সবার অগোচরে। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুনসহ এমন অপরাধ নেই যার সাথে শিক্ষার্থীদের নাম জড়িয়ে পড়ছে না।

অথচ বাংলাদেশে ছাত্রদের বিরাট সুনাম ছিল ভাষা আন্দোলন, সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে। একটি আদর্শিক প্রেরণা ছিল দেশের জন্য, মানুষের জন্য। সেই দিন চলে গেছে। এখন ছাত্ররাজনীতি পাল্টে গেছে। এটি আর মানুষের সমীহা টানে না। ছাত্ররাজনীতির সাম্প্রতিক প্রবণতা বিষয়ে আমাদের চোখে দেখা অভিজ্ঞতার কথা বলাই যায়। কিন্তু তার দরকার দেখি না। কারণ, কম হলেও দেশের ছাত্ররাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে কিছু গবেষণা হয়েছে। আমরা স্মরণ করতে পারি ‘সোসাইটি অ্যান্ড চেঞ্জ’ নামে সামাজিক পরিবর্তন-বিষয়ক ত্রৈমাসিক সাময়িকীর অক্টোবর-ডিসেম্বর-২০১১ সংখ্যায় প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রের কথা। নিবন্ধটি লিখেছিলেন চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের তখনকার অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসার মো: এনায়েতুল্লাহ পাটোয়ারী। ‘রিসেন্ট ট্রেন্ড অব স্টুডেন্ট পলিটিক্স অব বাংলাদেশ’ (বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির সাম্প্রতিক প্রবণতা) শিরোনামের সেই নিবন্ধে গবেষক বলছেন, “At present it is said that there is no idealism in student politics. Student leaders make money from extortion, from selling tender; they control dormitories of the students, the canteens. The majority of the student leaders are no longer students but ÔgangstersÕ- make money from their influence within the campuses.
Recently Principals of different colleges were harassed for not fulfilling admission quota.”

“বলা হয়ে থাকে যে, বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির কোনো আদর্শ নেই। ছাত্রনেতারা চাঁদাবাজি, টেন্ডার বিক্রি করে টাকা বানান; তারা ছাত্রাবাস ও ক্যান্টিন নিয়ন্ত্রণ করেন। বেশির ভাগ ছাত্রনেতা এখন আর ছাত্র নন; বরং তারা হলেন ‘গ্যাংস্টার’-যারা ক্যাম্পাসে তাদের প্রভাব খাটিয়ে অর্থ উপার্জন করেন। সম্প্রতি তাদের কোটা পূরণ না করায় বিভিন্ন কলেজের প্রিন্সিপালকে হয়রানি করা হয়েছে।” গবেষক আরো লিখেছেন, ‘A number of V.C, Provost, Proctor and teachers became under physical attack when they could not materialize student leaders, illegal demands. During one and a half year (from January 2009 to August-2010) at least 11 teachers were harassed in Dhaka University campus. Three teachers of Barisal B. M College were physically assault by Chattra League workers.’

‘ছাত্রনেতাদের অবৈধ দাবি পূরণ করতে না পারায় বেশ কয়েকজন ভিসি, প্রভোস্ট, প্রোক্টর ও শিক্ষক শারীরিক হামলার শিকার হন। দেড় বছরের সময়কালে (জানুয়ারি ২০০৯ থেকে আগস্ট ২০১০) ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অন্তত ১১ জন শিক্ষককে হেনস্তা করা হয়েছে। বরিশাল বিএম কলেজে ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে তিনজন শিক্ষক শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছেন।’

‘একটি জাতির ভবিষ্যৎ লেখা হয় তার শিক্ষায়তনের শ্রেণিকক্ষে’-এই মহাবাণী উল্লেখ করে গবেষণাপত্রে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে বিদ্যমান অবস্থায় গভীর হতাশা ব্যক্ত করা হয়। অবশ্য স্বীকার করতেই হবে যে, ছাত্রলীগ একাই অপকর্ম করে এমন নয়। আওয়ামী লীগের আগে যেসব দল ক্ষমতায় ছিল তাদের ছাত্রসংগঠনও খুব পিছিয়ে ছিল না। তবে প্রফেসর পাটোয়ারীর ওই গবেষণা প্রকাশ পায় আজ থেকে ১২ বছর আগে ২০১১ সালে। পরের ১২ বছরে পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটেছে যে, ভয়াবহ বললেও সম্ভবত কম বলা হবে। যেন পুরো দেশটাই কোনো বহিরাগত দুর্ধর্ষ খুনে দখলদার গুণ্ডাবাহিনীর হাতে চলে গেছে। তারা খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, লুণ্ঠন, নির্যাতন সবই চালিয়ে যাচ্ছে নির্বিচারে ও অবাধে। গোটা জাতি তাদের হাতে জিম্মি।

কিন্তু জনগণের মুখে পড়েছে বড় তালা। কিছু বলতে গেলে বুড়িগঙ্গায় চুবিয়ে মারার হুমকি পর্যন্ত আসে। গোটা জাতি তাই নিশ্চুপ। এ এক ঘোরতর অন্ধকার সময়। এই দুঃসময়ে নীরবতার অর্থ জাতিগতভাবে আত্মহত্যার নামান্তর। বর্তমান সরকারের সময়ে তো নয়ই, নিকট ভবিষ্যতেও এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনো উপায় কেউ বের করতে পারবেন কি না সন্দেহ।

mujta42@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement