২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সমকালীন প্রসঙ্গ

আসমানি ফয়সালার রাজনীতি!

আসমানি ফয়সালার রাজনীতি! - নয়া দিগন্ত

রাজনীতির কবলে পড়ে মজলুমদের আহাজারি যে কতটা নির্মম হতে পারে, তা যদি কেউ দেখতে চান তবে এই মুহূর্তে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা ঘুরে আসতে পারেন। গাজার সাথে বাংলাদেশের মজলুমদের মিল-অমিল নিয়ে অবশ্যই আলোচনা করব- তবে তার আগে স্বৈরাচারী জালিম বাদশাহদের উত্থান ও পতন নিয়ে সংক্ষেপে দু’কথা বলে নিই।

যারা ধর্ম-কর্ম বিশ্বাস করেন তাদের কাছে পবিত্র কালামে রব্বানি আল-কুরআনের বহু কাহিনীর মধ্যে কর্তৃত্ববাদী জুলুমবাজদের উত্থান-পতনের কার্যকারণ ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ যেসব ঘটনা বর্ণনা করেছেন, তা যদি কেউ অনুধাবন করার চেষ্টা করেন তবে আমি নিশ্চিত, চলমান ও ঘটমান অশান্তি নিয়ে কেউ হতাশার সাগরে হাবুডুবু খাবেন না। কুরআন- ওল্ড টেস্টামেন্ট ও তাওরাতে বর্ণিত অনেক কাহিনী প্রায় সমভাবে ইতিহাসে স্বীকৃতি পেয়েছে। ধর্মীয় কাহিনী যারা বিশ্বাস করেন না তারা যদি বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসবিদ, দার্শনিক-কবি ও সাহিত্যিকদের বর্ণনাগুলো পর্যালোচনা করেন তবে জুলুমবাজদের শ্রেণী-চরিত্রে কোনো পার্থক্য দেখতে পাবেন না।

ধর্মগ্রন্থের নবী-রাসূল-অত্যাচারী শাসক ও সম্প্রদায়, অত্যাচারিত বা মজলুম জনগোষ্ঠীর কাহিনীর সাথে যদি মহাভারত-রামায়ণ-ইলিয়ড-ওডিসির কাহিনীগুলো মেলান তবে দেখতে পাবেন, মানবচরিত্রের রসায়ন প্রায় হুবহু মিলে গেছে। হিটলারের ইহুদিবিদ্বেষ ও সেকসপিয়রের মার্চেন্ট অব ভেনিসে বর্ণিত ইহুদিবিদ্বেষের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। হজরত দাউদ আ:-এর পূর্বসূরি তালুত-জালুতের জমানার বনি ইসরাইলিদের দুঃখ-কষ্ট-বেদনার সাথে যেমন হজরত মুসা আ:-এর জমানার ফেরাউন দ্বিতীয় রামসিসের শাসনাধীন ক্রীত দাস-দাসী বনি ইসরাইলিদের দুঃখ-কষ্টের কোনো পার্থক্য পাবেন না- তদ্রƒপ ইবনে খালদুন-মার্কোপলো কিংবা হেরাডোটাস বর্ণিত ইতিহাসের অত্যাচারিত জাতি-গোষ্ঠীর আর্ত-চিৎকারের মধ্যে কোনো অমিল নেই।

আল্লাহর রাসূল সা:-এর জমানার মজলুম সাহাবায়ে কেরামের জীবনে যে দুর্ভোগ-দুর্দশা ছিল ঠিক তদ্রƒপ দুর্ভোগ-দুর্দশা আমাদের বাংলায় শুরু হয়েছিল রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর। বাংলার শত বছরের অরাজকতা ও আরবের আইয়ামে জাহেলিয়াতের শত বছরের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বাগদাদে খলিফা আল মনসুরের ক্ষমতা লাভ- আব্বাসীয় বংশের উত্থানের সাথে সুবে-বাংলার পাল বংশের উত্থানের মিল রেখে কেউ যদি মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনি মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশার সাথে বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতের মজলুমদের বেদনাকে তুলনা করতে চান, তবে সেই দায়দায়িত্ব নিশ্চয়ই কেউ আমার ওপর দেবেন না।

উল্লিখিত বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমরা যদি প্রশ্ন করি, কেন হাজার বছরের মানব ইতিহাসে বারবার একই ঘটনা ঘটে? কেন লক্ষ কোটি মানুষ স্থান-কাল-পাত্রভেদে নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী অত্যাচারী শাসকদের মৃত্যু কামনায় আল্লাহর দরবারে আত্মসমর্পণ করেন এবং আসমান থেকে অলৌকিক সাহায্য কামনা করেন যাতে করে জাহেলি শাসনের অবসান ঘটে? কেন মানুষ শত শত বছর ধরে একজন ভালো নেতার জন্য অনবরত প্রার্থনা করতে থাকেন এবং আল্লাহ কর্তৃক নেতা পাওয়ার পর সদলবলে নেতার অবাধ্য হয়ে পড়েন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে নেতাকে খুন করে ফেলেন? কিভাবে খোদায়ি গজব জাহেলদেরকে পাকড়াও করে এবং অলৌকিক সাহায্য বান্দাদের জন্য ফরজ হয়ে যায়? এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত লিখতে গেলে রীতিমতো মহাভারত রচিত হয়ে যাবে। সুতরাং নিবন্ধের পরিধি না বাড়িয়ে যথাসম্ভব সংক্ষেপে আজকের শিরোনামের যথার্থতা আলোচনার চেষ্টা করব ইনশা আল্লাহ!

মহান আল্লাহ তাঁর অপূর্ব সৃষ্টিকৌশল ও প্রকৌশলবিদ্যার সর্বোচ্চ নান্দনিকতা দিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন। অন্য দিকে, তার সৃষ্ট-মহাজগৎ পরিচালনার জন্য আইন-কানুন, পাহারাদার, প্রকৌশলী, সফটওয়্যার-হার্ডওয়্যার ইত্যাদি সব কিছু তৈরি করেছেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচালন ও সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ-যন্ত্রপাতি-যন্ত্রাংশ এবং জ্বালানি ও পানি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে এমনভাবে মজুদ করে রেখেছেন যা কিয়ামত পর্যন্ত স্বাভাবিক গতিতে ও প্রাকৃতিক নিয়মে পরিচালিত হবে। সূর্যের অভ্যন্তরে সৌরঝড়, পৃথিবীর ঘূর্ণিঝড়, মহাকাশের ব্লাকহোল কিংবা মহাসাগরের চৌম্বক শক্তি ইত্যাদি সব কিছুর প্রয়োজন এবং আয়োজন এতটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে করেছেন যে, পৃথিবীর কারো পক্ষে কিয়ামত পর্যন্ত চেষ্টা করেও আল্লাহর প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানো সম্ভব নয়।

মহাবিশ্বের অতি অতি এবং খুবই নগণ্য ও ক্ষুদ্রকায় একটি গ্রহের নাম পৃথিবী। আবার পৃথিবীর আকাশ-বাতাস-কক্ষপথ-ভূ-অভ্যন্তর ও সমুদ্রের তলদেশের তুলনায় ভূ-পৃষ্ঠ এবং জলভাগের উপরিভাগের গুরুত্ব খুবই নগণ্য। আবার জলভাগের অজেয় সমুদ্র-মহাসমুদ্রের তুলনায় বিজিত জলরাশির গুরুত্ব ও পরিধি সীমিত। অনুরূপভাবে স্থলভাগের গহিন অরণ্য, দুর্ভেদ্য পাহাড়-পর্বত, মরুভূমি এবং মেরু অঞ্চলের বরফাচ্ছাদিত অংশের তুলনায় নরম মাটির শস্য শ্যামল স্থলভাগের গুরুত্ব সার্বিক বিবেচনায় অতি নগণ্য। আর সেই নগণ্য অঞ্চলের বাসিন্দা আশরাফুল মাখলুকাতের রাজনীতির নষ্টামি ও জাল-জালিয়াতি যে কতটা গুরুত্বহীন তা আমরা সবাই বুঝতে পারি চূড়ান্ত পতনের পর। হিটলার, মুসোলিনি, ফেরাউন, হামান, হালাকু, চেঙ্গিসদের গুরুত্ব যে একজন দ্বীনহীন-নিঃস্ব ফকিরের চেয়েও নিম্নপর্যায়ের তা আমরা বুঝতে পারি তাদের পতনের পর। অন্য দিকে তারা যদি তাদের নির্মম পরিণতির দুর্ভোগ-দুর্দশা সম্পর্কে ধারণা করতে পারতেন তবে রাজক্ষমতার পরিবর্তে মেথর-নাপিত-ধোপা ইত্যাদির কর্মকে নিজেদের বেঁচে থাকার অবলম্বন বানাতেন। এমনকি মৃত্যুর আগে তাদের যদি বেঁচে থাকার সুযোগ দেয়া হতো সে ক্ষেত্রে ভয়াবহ মৃত্যু আতঙ্ক থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা মানুষের পরিবর্তে ময়লা আবর্জনার কিড়া হয়ে বেঁচে থাকতে চাইতেন। এখন প্রশ্ন হলো- কিছু মানুষ কেন অত্যাচারী জাহেল শাসক হওয়ার জন্য সর্বনাশের দিকে পা বাড়ায় এবং জনগণ কেন অত্যাচারের শিকারে পরিণত হয়।’

আপনি যদি উল্লিখিত প্রশ্নের জবাব জানতে চান তবে প্রথমেই জানতে হবে, এই পৃথিবী তথা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র প্রকৃতির আইন বাধ্যতামূলক। কিন্তু মানুষের মন-মস্তিষ্ক ও শরীরের একাংশের ওপর মানুষের ইচ্ছাশক্তির স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। যেখানে মানুষের স্বাধীনতা রয়েছে সেখানে স্বাধীনতার সম্মান রক্ষার যোগ্যতা যা মানুষের না থাকলে তার দ্বারা তার অধিক্ষেত্রে ক্রমাগত প্রকৃতির আইন লঙ্ঘিত হতে থাকে। কোনো ব্যক্তি যদি প্রকৃতির আইন ভঙ্গ করেন তবে তাকে সংশোধন করা-নিয়ন্ত্রণ করা- শাস্তি দেয়া থেকে শুরু করে প্রয়োজন হলে নির্মূল করা অন্যান্য মানুষের জন্য অবশ্যকর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহর খলিফারূপে মানুষ যখন সেই দায়িত্ব পালন না করে জুলুমবাজের খলিফারূপে চুপ থাকে অথবা জুলুমের ভাগীদার হয়, তবে তার জন্য মজলুম হওয়া অত্যাচারিত-অপমানিত ও লাঞ্ছিত হওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

মানুষ যখন উল্লিখিত বলয় থেকে বের হওয়ার জন্য চেষ্টা করে এবং নিজেদের ভুলভ্রান্তির জন্য অনুশোচনা করে খোদায়ী নিয়মের অধীন হওয়ার জন্য লড়াই সংগ্রাম করে, তখন প্রকৃতির সব সাহায্যকারী শক্তি মজলুমের পক্ষে দাঁড়িয়ে যায় এবং একের পর এক অলৌকিক ও অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটার মাধ্যমে জমিনের রাজনীতি আসমানি ফয়সালার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়ে যায়।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement