২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সমকালীন প্রসঙ্গ

বেহায়া-বেশরম-বেতমিজির গুপ্ত কথা

বেহায়া-বেশরম-বেতমিজির গুপ্ত কথা - নয়া দিগন্ত

লজ্জার সঙ্গে শরমের কি সম্পর্ক তা বর্ণনার পূর্বে আমার নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলে নিই। সেবার এক লোক আমাকে এমনভাবে মুগ্ধ করে ফেললেন যে আমি তার প্রেমে দিউয়ানা হয়ে গেলাম। ভদ্রলোক বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করতেন এবং পাশাপাশি বিদেশ থেকে কম্পিউটার সামগ্রী আমদানি করতেন। মানুষকে বোকা বানানোর অদ্ভুত কৌশল তিনি এমনভাবে রপ্ত করেছিলেন যে তার খপ্পরে পড়লে আপনি তার দ্বারা বারবার প্রতারিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরও লোকটির প্রভাবমুক্ত থাকতে পারবেন না। আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে তিনি আমার সঙ্গে যা করেছিলেন তা যেমন আমি ভুলতে পারছি না তেমনি তার কর্মকাণ্ডের মধ্যে আজকের শিরোনামের প্রতিটি শব্দ কিভাবে অদ্ভুত রসায়ন সৃষ্টি করেছিল তাও আপনাদের না বলে থাকতে পারছি না।

আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন ব্যবসায়ী হিসেবে কিছু কাঁচা টাকা সবে আমার পকেটে ঢুকেছে। ফলে অন্যসব বেকুবের মতো আমারও মনে হতে থাকলো যে টাকা উপার্জনের চেয়ে সফলতা আর কিছুই নেই এবং কড়কড়ে টাকার বান্ডিলের মধ্যে যে সুখ অথবা আনন্দ তা জগৎ সংসারের অন্য কোনো কিছুর সঙ্গেই তুলনীয় নয়। নতুন পানির মাছ যেভাবে কারণে অকারণে লাফ মারে তদ্রƒপ নতুন টাকাওয়ালারাও এমনভাবে লাফাতে থাকে যেন আশপাশের সবাই টের পেয়ে যায় যে লোকটির টাকা হয়েছে। দ্বিতীয়ত এরা চায়, লোকজন তাদের কাছে আসুক এবং তাদের টাকা কামাই নিয়ে প্রশংসার ফুলঝুরি ছুটিয়ে দিক। নতুন টাকাওয়ালাদের দাঁতাভাঙ্গা শিক্ষা দেয়ার জন্য কিছু লোক সবসময়ই মুখিয়ে থাকে যারা ছলাকলার ডালি সাজিয়ে টাকাওয়ালার মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে নগদ-নারায়ণ হাসিলের সব পদ্ধতির গুরু হিসেবে একের পর এক সফলতার রেকর্ড তৈরি করে নিত্যনতুন শিকারের খোঁজে জনারণ্যে টহল দিতে থাকে।

আমি যার কথা বলব তিনি কবে কোথায় আমায় প্রথম দেখেছিলেন তা বলতে পারব না। তবে আমাদের প্রথম সাক্ষাতে তিনি এমন কিছু বললেন এবং চোখেমুখে এমন একটা ভাব ফুটিয়ে তুললেন যা দেখে আমার মনে হলো, জগৎ সংসারে তার মতো আপন আমার কেউ নেই। দ্বিতীয়ত তাকে সাহায্য করার জন্যই বোধ হয় আল্লাহ দুনিয়াতে আমাকে পাঠিয়েছেন। তার সঙ্গে পরিচয়ের কয়েক দিন পর তিনি খবর পাঠালেন যে তিনি ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমি দেখতে গেলাম। তার স্ত্রী-কন্যা এবং ভাইবোনেরা সবাই এমনভাবে ছুটে এলেন যা দেখে মনে হলো, আমি সেই পরিবারের অঘোষিত অভিভাবক। তাদের আন্তরিকতায় আমার চোখ অশ্রু ভারাক্রান্ত হলো। তারপর লোকটি চোখেমুখে রাজ্যের লজ্জা-শরম-দ্বিধা-সংকোচ ফুটিয়ে তুলে কি যেন বলতে চাইলেন। কিন্তু অসুস্থতাজনিত কারণে বলতে পারলেন না- বরং বলতে গিয়ে প্রায় জ্ঞান হারানোর পর্যায়ে পৌঁছে গেলেন।

লোকটির স্ত্রী তাকে থামালেন এবং বহু কষ্টে আমায় জানালেন যে সিঙ্গাপুর থেকে বড় একটি কম্পিউটারের চালান বন্দরে এসে আটকে আছে। দুই একদিনের মধ্যে ছাড়াতে না পারলে নিলাম হয়ে যাবে। অসুস্থ মানুষটি সেই কথা স্মরণ করলেই জ্ঞান হারানোর পর্যায়ে চলে যান। ভদ্র মহিলার আকুতি শুনে আমার দয়ার সাগরে ঢেউ চলে এলো। কড়কড়ে নতুন টাকার বান্ডিলগুলো আমাকে কামড়াতে লাগল। আমি অফিসে ফিরে অনতিবিলম্বে বিরাট অঙ্কের একটি টাকার ব্যাগ ভদ্রলোকের বাসায় পাঠিয়ে দিলাম। তিনি কৃতজ্ঞতার চিঠি দিয়ে জানালেন যে মাল ছাড়ানোর এক সপ্তাহ পর আমার টাকা ফেরত দেবেন।

উল্লিখিত ঘটনার পর সপ্তাহ গেল, মাস গেল, কিন্তু লোকটির কোনো হদিস মিলল না। আমি ফোন করলাম, লোক পাঠালাম কিন্তু সেই দেবতার মতো মানুষটির নিকট থেকে সাড়া পেলাম না। আমার নতুন টাকার গরম আমাকে ক্রোধান্বিত করল। আমি লোকটিকে শায়েস্তা করার জন্য যখন সাত-পাঁচ ভাবছিলাম ঠিক সেই সময়ে একটি জনাকীর্ণ সড়কে আমি তাকে পেয়ে গেলাম। এত দিন ধরে আমি যে ক্রোধ এবং প্রতিশোধ লালন করছিলাম তা চরিতার্থ করার মোক্ষম সুযোগ যখন পেয়ে গেলাম তখন একরাশ লজ্জা এবং এক বস্তা শরম আমাকে গ্রাস করল। আমি লোকটির মুখোমুখি হওয়ার পরিবর্তে নিজের মুখ লুকিয়ে এমনভাবে সটকে পড়লাম যেন দেনাদার আমাকে দেখতে না পান। এই ঘটনার কয়েক দিন পর আমি রমনা থানায় মামলা দিলাম। লোকটি তার স্ত্রীকে নিয়ে সোজা আমার বাসায় এলেন। তার বেহায়াপনায় আমার শরমের মাত্রা বেড়ে গেল এবং উল্টো চা নাস্তা খাইয়ে তাদের বিদায় করার পর স্ত্রী মহোদয়ার নিকট নিজের নির্বুদ্ধিতার নতুন নতুন যেসব প্রশংসা শুনলাম তাতে আমার কান মোবারক পুলকিত হয়ে উঠল।

লজ্জা-শরম ও বেহায়াপনার উল্লিখিত উদাহরণের মনস্তাত্ত্বিক এবং দার্শনিক ব্যাখ্যা দিতে গেলে মহাভারত রচনা হয়ে যাবে। সুতরাং তথ্যগত ব্যাখ্যা বিবৃতি বাদ দিয়ে আগে বলে নিই যে, কেন আজকের শিরোনামটি নিয়ে নিবদ্ধ লিখার প্রয়োজন বোধ করছি। আমার মনে হচ্ছে, দেশের চলমান সমস্যা- বিশেষত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক, পারিবারিক ও শিল্প সাহিত্য-সংস্কৃতির যে অধঃপতন শুরু হয়েছে তার মূলে রয়েছে মানুষের লজ্জাহীনতা- বেশরম কর্মকাণ্ড এবং ক্রমশ আদব হারিয়ে বেয়াদবে পরিণত হওয়া। আজ চোরের কোনো লজ্জা শরম নেই- বরং ক্ষেত্র বিশেষ চোরেরা মানুষের আগ্রহের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। দল বেঁধে মানুষ চোর দেখতে আসে এবং চোর হাসিমুখে তার চুরির গল্প মানুষকে শুনিয়ে নিজের চৌর্যবৃত্তির পরিপক্কতা ও সফলতার জন্য গর্ব অনুভব করতে থাকে। গাইবান্ধা অঞ্চলের এক ভবঘুরে ছিচকে চোর ছিদ্দিকের চুরির ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর দেখলাম তার নিজের এলাকার কোনো একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে তাকে বিশেষ অতিথি অথবা প্রধান অতিথি জাতীয় কিছু একটা করা হয়েছে।

চোরদের কথা বাদ দিয়ে যদি ডাকাত-লুটেরা-ধর্ষক কিংবা ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজ প্রভৃতি মন্দ চরিত্রের লোকজনদের কথা বলতে যাই তবে বেশ গর্বের সঙ্গে বলতে পারি যে আমাদের দেশকাল-সমাজ এখন ওইসব শ্রেণী-পেশার লোকজনদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। গডফাদার বই পড়ে আমরা যেমন লেখক স্যারিও পুজোর প্রশংসা করি কিংবা গডফাদার সিনেমায় অনবদ্য অভিনয়ের জন্য যেমন সার্লো ব্রান্ডোর ভক্ত হয়ে যাই ঠিক তদ্রƒপ আমাদের সমাজের অপরাধের রাধাচক্রের কলাকুশলীদের দেখলে আমাদের মধ্যে সেই রোমাঞ্চকর অনুভূতি তৈরি হয়ে যেমনটি সার্লো ব্রান্ডোকে দেখলে হয়ে থাকে। একইভাবে পাইরেটস অব ক্যারিবিয়ান সিনেমায় ভূমধ্য সাগরের ডাকাত চরিত্রে অভিনয় করে হলিউড তারকা জনি ডেপ যেভাবে জনপ্রিয়তার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছেছেন ঠিক অনুরূপভাবে ব্যাংক-বীমা-শেয়ার মার্কেট ডাকাত ও লুটেররাও আমাদের সমাজের বহু নরনারীর স্বপ্নের পুরুষে পরিণত হয়ে গিয়েছে।

আমরা একটা সময় দস্যুরাণী ফুলনের গল্প শুনতাম। ভারতের উত্তর প্রদেশের চম্বল ও যমুনা নদীকে বেষ্টনকারী বেহড় বা জঙ্গলে দস্যুরাণী ফুলনের ডাকাতির পাশাপাশি ফুসুমা নাইনের কাহিনীও আমাদেরকে দারুণভাবে রোমাঞ্চিত করত। তাদের ডাকাতির পেশা অনেকটা দস্যু বনহুর কিংবা রবিন হুড প্রকৃতির ছিল। অধিকন্তু ভারতের অর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, দারিদ্র্য-জাতিভেদ প্রভৃতি কারণে ফুলন কিংবা ফুসমা নাইনরা যখন অস্ত্র হাতে বনে বাদাড়ে ঢুকে পড়েছিল তখন সাধারণ মানুষের একধরনের অনুভূতি তাদের পক্ষে ছিল। অন্যদিকে মুম্বাই অন্ধকার জগতের ডন হাজি মাস্তান কিংবা পরবর্তীকালে দাউদ ইব্রাহিমের প্রতিও নানা কারণে সাধারণ মানুষের একধরনের দুর্বলতা ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রশক্তি কোনো দিন জনগণের দুর্বলতা ও আবেগকে পাত্তা দেয়নি। বরং আইনের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে ভারতের অরণ্য এবং নগরী দস্যুমুক্ত করেছে- আর এই কারণে পৃথিবীর বুকে ভারত একের পর এক সভ্যতার নতুন মাইলস্টোন তৈরি করে যাচ্ছে। আর অন্যদিকে আমরা কী করছি।

আমাদের দেশে চোর-ডাকাত-গুন্ডা বদমাশ-ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজ-লুটেরা মিথ্যাবাদীরা এতটা বেপরোয়া-নির্লজ্জ বেহায়া এবং বেয়াদবে পরিণত হয়ে পড়েছে যার কারণে জনগণ ও রাষ্ট্রশক্তি তাদের প্রতিহত করার পরিবর্তে ওদের কবলে পড়ে ত্রাহি ত্রাহি আর্ত চিৎকার শুরু করেছে। আমাদের দেশের পিকে হালদার বুক ফুলিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে গিয়ে বন্দী হয়। আমাদের টাকা লুটেরারা ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর-দিল্লী-বোম্বে-দুবাই সরকারের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে। আমাদের দেশের চোর ডাকাতরা লন্ডন-আমেরিকা-কানাডা-অস্ট্রেলিয়া-সুইজারল্যান্ড কিংবা ইতালির পুরো সামাজিক অবকাঠামোকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। ফলে আমরা ছিদ্দিক চোররা ময়মুরুব্বীদের জন্য গর্ব করব নাকি লজ্জায় গলায় দড়ি দেব, তা ভাবার মতো সময়ও পাচ্ছি না। কারণ ওরা ওদের কর্মকাণ্ড দ্বারা আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে এতটা প্রভাবিত করে ফেলেছে যার কারণে লজ্জা-শরম-হায়ার পরিবর্তে বেহায়াপনা-বেশরমি খাসলত এবং বেয়াদবীর স্বর্গরাজ্যের অধিবাসীরূপে আমাদের অনেকে রীতিমতো গর্ব প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি।

আমরা আজকের আলোচনার একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। এবার শিরোনাম সম্পর্কে কিছু তথ্যগত বক্তব্য দিয়ে নিবন্ধের ইতি টানব। আলোচনার শুরুতে বলেছিলাম যে লজ্জা ও শরমের মধ্যে পার্থক্য কি। মানুষ যখন কোনো বস্তুগত বিষয় নিয়ে বিব্রতবোধ করে তখন সেটাকে লজ্জা বলা হয়। লজ্জার বিষয়ের সঙ্গে সামাজিক-পারিপার্শ্বিক বিষয়াদি জড়িত। অন্যদিকে শরম শব্দটি সাধারণ ইন্দ্রিয়গত এবং একান্ত ব্যক্তিগত। শরমের প্রতিক্রিয়া মানুষের মন ও মস্তিষ্কে আঘাত করে আর লজ্জার বিষয়টি প্রথমত শরীর তারপর পঞ্চম ইন্দ্রিয়কে কলুষিত করে।

মানুষ যখন লজ্জা-শরমের তোয়াক্কা না করে তখন মধ্যে মধ্যে বেহায়াপনার উপসর্গগুলো প্রকট হয়ে ওঠে। হায়া শব্দের বিপরীতে সবাই বেহায়া শব্দটি ব্যবহার করে। হিন্দি ও উর্দু ভাষায় হায়া ও বেহায়া শব্দ যেভাবে ব্যবহৃত হয় ঠিক ওভাবে শরম ও বেশরম ব্যবহৃত হয় না। আবার আমাদের দেশে লজ্জা ও শরমকে যেভাবে একত্র করে ফেলা হয় ব্যুৎপত্তিগতভাবে তা কোনোমতেই ঠিক নয়। তবে লজ্জা-শরম-হায়ার অভাবে মানুষ দিন দিন বেয়াদব হয়ে ওঠে এবং বেয়াদবীর কারণে তমিজ বা শিষ্টাচার তাদের চরিত্র থেকে চলে যায়। এ অবস্থায় বেয়াদবের প্রধান অলংকার হয় বেতমিজি আচরণ যা একসময় উদ্ধত অহংকারে রূপ নেয়। আর অহংকার মানুষকে ক্রমশ শিরক বা অংশীবাদের দিকে নিয়ে যায় অর্থাৎ মানুষ একসময় নিজেকে আল্লাহর সমপর্যায়ের ভাবতে শুরু করে এবং সরাসরি আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যেদিন খোদাদ্রোহী হয়ে পড়ে। সেদিন সমস্ত প্রকৃতি একসঙ্গে বেহায়া-বেশরম-বেতমিজ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement