০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`


উৎসের উচ্চারণ

বিজ্ঞান চাই, বিজ্ঞানবাদ নয়

বিজ্ঞান চাই, বিজ্ঞানবাদ নয় - নয়া দিগন্ত

বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে সিস্টেম ও পদ্ধতি। যা সব বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ভিত্তি। পর্যবেক্ষণের জন্য, অনুমান তৈরির জন্য, পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা তথ্য সংগ্রহের জন্য এবং প্রমাণে উপনীত হওয়ার জন্য এর ওপর মানবজাতির নির্ভরতা রয়েছে। একে অবলম্বন করে অগ্রসর হয় বৈজ্ঞানিক তদন্ত ও প্রক্রিয়া। বিজ্ঞান প্রাকৃতিক জগতের আচরণকে বর্ণনা করে। নিউটনের গতি সূত্র, মহাকর্ষ সূত্র এবং তাপগতিবিদ্যার সূত্র এরই নমুনা।

কোনো ঘটনাকে বুঝা ও তার মর্মে উপনীত হওয়ার পথে সে হাইপোথিসিস বা পরীক্ষাযোগ্য ব্যাখ্যা হাজির করে। এসব ব্যাখ্যা তৈরি হয় প্রাকৃতিক জগতের কিছু দিকের প্রামাণ্য একটি অংশের ওপর ভিত্তি করে। যা কেবল অনুমান নয়; বরং বস্তুগত ক্ষেত্রে সত্য উন্মোচনের সম্ভাব্য পথের প্রস্তাব।

পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূতত্ত্বসহ বিজ্ঞানের বিচিত্র শাখা ও শৃঙ্খলা প্রাকৃতিক আবিষ্কার ও উন্মোচনের এমন বিপ্লব ঘটিয়েছে, যা অতীতে ছিল অচিন্তনীয়। রসায়ন বিজ্ঞান পরমাণু ও অণুগুলোর উপলব্ধির স্তরকে দিয়েছে বিপুল উচ্চতা। অণু-পরমাণুর শক্তিকে কাজে লাগানোর প্রশ্নে সে বিস্ময়কর অগ্রগতি নিশ্চিত করেছে। কোষতত্ত্ব জীবজগতকে বুঝার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছে।
জিন ও বংশগতির অধ্যয়ন নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। জেনেটিক তথ্য বহন করে যে ডিএনএ, তার ওপর মানুষের অবগতি নতুন আলোক বিস্তার করেছে। তাপগতি বিদ্যার আইন, বিশেষ করে শক্তির সংরক্ষণ, বিভিন্ন সিস্টেমে শক্তি স্থানান্তর ও রূপান্তরসমূহকে ব্যাখ্যা করছে। ভূতত্ত্ব পৃথিবীর গঠন ও প্রক্রিয়াগুলো অন্বেষণ করে আমাদের দৃষ্টিবান করছে, প্লেট টেকটোনিক্স, ক্ষয় ও ভূতাত্ত্বিক সময় স্কেল সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি সরবরাহ করছে। জ্যোতির্বিদ্যা সৌরজগৎ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি ও বিশাল মহাবিশ্ব পরীক্ষা করে নিত্যনতুন তথ্য ও সত্য হাজির করছে। পরিবেশ বিজ্ঞান বাস্তুবিদ্যা ও প্রাকৃতিক বিশ্বের ওপর মানুষের কার্যকলাপের প্রভাব অধ্যয়ন করছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে।

গণিত কাজ করছে বিজ্ঞানের ভাষা হিসেবে, সে প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যা করছে, বর্ণনার মডেল হাজির করছে। সমীকরণ, পরিসংখ্যান ও গাণিতিক মডেলগুলো বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে দিচ্ছে দৃষ্টি ও সৃষ্টিশক্তি। বিজ্ঞানের হাত দিয়ে দুনিয়া বদলে গেছে প্রবল ও গভীর অর্থে। যার চোখ আছে, সে একে অবহেলা করতে পারে না একটুও।

অগ্রগতির এই প্রবল সবল বাস্তবতায় বিজ্ঞানের ধ্বংসাত্মক ব্যবহারের মতো বিষয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আমাদের সামনে হাজির। জলবায়ু পরিবর্তন, স্বাস্থ্যসেবা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো জটিল সমস্যাগুলো গুরুতর চরিত্র লাভ করছে। এসবের মোকাবেলার জন্য বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার পারস্পরিক সহযোগিতা ও তাতে মৌলিক অবদান রাখার গুরুত্ব সুস্পষ্ট।
বিগত চার শতকে বিজ্ঞানচর্চা ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির এই মহাযাত্রায় মুসলিম দুনিয়া খুব কমই ভূমিকা রাখছে। এতে সত্যিকার প্রেরণা ও অগ্রগতির দক্ষতাকে আমন্ত্রণ ও লালন করা জরুরি ছিল। কিন্তু মুসলিম দুনিয়ায় খুব অল্পই ঘটেছে এই ঘটনা। উল্টো বরং এখানে আধুনিকতা হয়ে উঠেছে পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণের এমন এক ধারা, যা আমাদের কোনো অসুখের চিকিৎসা নয়; বরং সে নিজেই হয়ে উঠেছে এক অসুখ। ব্যক্তিবাদ, পুঁজিবাদ, জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম, নারীবাদ, মনোবিকারবাদ, ম্যাকেয়াভেলিবাদ ইত্যাদির সবচেয়ে খারাপ রূপ এখানে লক্ষ করা যায়। বিজ্ঞানও সত্যিকার চর্চার পরিসর পায়নি আমাদের শিক্ষায়, সমাজে।

বিজ্ঞান চর্চা ও তাতে মৌলিক অবদান রাখার বাস্তবসম্মত প্রচেষ্টার বদলে এখানে একটি অংশের মধ্যে বিস্তার লাভ করেছে তথাকথিত বিজ্ঞানবাদ। বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানবাদ এক জিনিস নয়। বিজ্ঞানবাদ কোনো আদর্শ প্রবণতা নয়। বিজ্ঞানবাদের দাবি হলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি জ্ঞানার্জনের একমাত্র বৈধ উপায় এবং মানবজীবনের সব ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ করা উচিত। যদিও নিঃসন্দেহে বিশ্বজগতকে বোঝার জন্য বিজ্ঞান শক্তিশালী এবং মূল্যবান হাতিয়ার। কিন্তু একটি আদর্শ বা বিশ্বদর্শন হিসেবে বিজ্ঞানবাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিভিন্ন ত্রুটি, দুর্বলতা ও সঙ্কট রয়েছে। যেমন-

১. উপেক্ষাধর্মিতা ও একরৈখিকতা : বিজ্ঞানবাদ জটিল ঘটনাগুলোকে তার সহজতম উপাদানগুলোতে সীমায়িত করে ফেলে। বাস্তবতার জটিল ও সামগ্রিক প্রকৃতিকে অনেক সময় উপেক্ষা করে। এটি অধিকমাত্রায় সরলীকরণে পরিণত হয়। যা বহুমাত্রিক ও জটিল বিষয়গুলোকে একটি সীমিত উপলব্ধিতে বন্দী করার জন্য একরোখা আচরণ করে।

২. বিষয়গত অভিজ্ঞতার অবহেলা : বিজ্ঞান অনেক সময় মানুষের অস্তিত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গত অভিজ্ঞতা, আবেগ ও মূল্যবোধগুলোকে বাতিল করে, উপেক্ষা করে। অর্থ, উদ্দেশ্য ও নৈতিকতা প্রশ্নে অর্থপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি দিতে তার ব্যর্থতা এড়ানো কঠিন।
৩. অভিজ্ঞতাবাদের ওপর অত্যধিক জোর : এটি ঠিক যে, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের জন্য অভিজ্ঞতামূলক প্রমাণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিজ্ঞানবাদ অনেক সময় দার্শনিক, নৈতিক বা ঐতিহাসিকতার মতো জ্ঞানের অন্যান্য রূপগুলোকে বাদ দিতে চায়, সে মূলত অভিজ্ঞতামূলক তথ্যের গুরুত্বকে অত্যধিক জোর দেয়।

৪. জ্ঞানতাত্ত্বিক ঔদ্ধত্য : বিজ্ঞানবাদ যেহেতু অনুসন্ধানমূলক জ্ঞানের একমাত্র ফর্ম হিসেবে নিজেকেই দেখে, তাই বৈজ্ঞানিক নয়, এমন ফর্মগুলোকে সে প্রত্যাখ্যান করে। দর্শন, শিল্প ও মানবিকের মতো ক্ষেত্রগুলোকে ক্ষুদ্রতম করে ছাড়ে। প্রত্যাখ্যানের এই মনোভাব জ্ঞানের আন্তঃবিভাগীয় সহযোগিতাকে বাধাগ্রস্ত করে। জটিল বিষয়গুলো সম্পর্কে আমাদের বোঝার জগতকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে।

৫. নৈতিক শূন্যতা : বিজ্ঞানবাদের হাতে মানব আচরণের নির্দেশনার জন্য কোনো ব্যাপক নৈতিক কাঠামো নেই। মূল্যবোধ ও নৈতিক প্রশ্নগুলোর সমাধান করার ক্ষেত্রে সে অপ্রস্তুত। ফলে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিগুলোকে কোনো নৈতিক মানদণ্ডে ব্যবহার করা উচিত, সেই নির্দেশনা সে দিতে পারে না। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার তাই ধ্বংসের বাহন হয়ে উঠেছে। বিশ্ব ধ্বংসের প্রতিযোগিতা চলছে প্রাচ্য-প্রতীচ্যে, ধ্বংসাত্মক অস্ত্র প্রতিযোগিতা যেকোনো মুহূর্তে মানবতার সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে।

৬. মানুষের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অসম্পূর্ণ বোধ : বিজ্ঞান কীভাবে একমাত্র মানদণ্ড হতে পারে, যেখানে সে মানুষের আবেগ, নান্দনিকতা ও সাংস্কৃতিক অনুশীলনসহ মানুষের অভিজ্ঞতার সমৃদ্ধ এবং বিচিত্র উপাদানগুলোকে ধারণের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। কেবল পরিমাপ ও অভিজ্ঞতা মূলত তথ্য দিয়ে সে এই মাত্রাগুলোর সাথে উচিত উপায়ে মিলিত হতে পারে না। কিন্তু এই মাত্রগুলো বিকলাঙ্গ হলে জীবন ও সভ্যতা বিকলাঙ্গ হতে বাধ্য।

৭. বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা উপেক্ষা করা : বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে উদাসীন। এই সীমাবদ্ধতা এত ব্যাপক যে, অস্তিত্ব সম্পর্কিত গুরুতর বহু প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না বিজ্ঞান। অভিজ্ঞতামূলক প্রমাণের ওপর একক নির্ভরশীলতা তাকে অতীন্দ্রিয় সত্য থেকে বঞ্চিত রাখে। এই নির্ভরতা থেকে যে গবেষণা হয়, তাতে থেকে যায় এককেন্দ্রিকতা ও বস্তুগত পক্ষপাত।
৮. বৈজ্ঞানিক মতবাদের ঝুঁকি : চরম পর্যায়ে উপনীত বিজ্ঞানবাদ বাজে রকমের গোঁড়ামি হয়ে উঠে। সে নিজের জন্য বিজ্ঞান ছাড়া আর কিছুরই জায়গা রাখে না। ফলে এমন সব বিশ্বাস, সত্যবোধ, অন্তর্দৃষ্টি ও প্রজ্ঞাকে সে জীবনের বাইরে ছুড়ে ফেলতে চায়, যাকে পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করতে পারছে না। এটি সৃজনশীলতা ও বিশ্বাসের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এক রকম মৌলবাদ ও দমনবাদ।
৯. বিজ্ঞানের ভবিষ্যদ্বাণীমূলক শক্তির ওভারসেলিং : বিজ্ঞান ভবিষ্যদ্বাণী করে এবং মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারে। প্রাকৃতিক নানা ক্ষেত্রে তার যথার্থতাও প্রমাণিত। এর ভেতর থেকে বিজ্ঞানবাদ দাম্ভিক হয়ে উঠে। সে মানব অস্তিত্বের সব দিক বিশ্লেষণ করতে চায়, তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে চায়, তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। বৈজ্ঞানিক ক্ষমতাকে অবাস্তব আত্মবিশ্বাসের দিকে নিয়ে যায় বিজ্ঞানবাদ। যা অনুসারীদের গোঁড়া অহমিকায় প্রতিক্রিয়াশীল করে তোলে।

১০. মূল্যবোধ ও জ্ঞানের অপর্যাপ্ত বিবেচনা : বৈজ্ঞানিকতা অনেক সময় মূল্যবোধ, নৈতিকতা এবং সাংস্কৃতিক নিয়মের ইস্যুগুলোর সমাধানে ব্যর্থ হয়। সে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ এবং নৈতিক কাঠামোর গুরুত্বকে উপেক্ষা করে বসে। আবার কখনো কখনো সে বৈজ্ঞানিক নীতি দর্শনের গুরুত্বকে উপেক্ষা করে। ফলে সে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের অন্তর্নিহিত সত্যকে বুঝতে চায় না। এই প্রবণতা বৈজ্ঞানিক অনুমানের পদ্ধতিতে নিহিত সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটিকে স্পষ্ট করে, দেখিয়ে দেয়।
১১. সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব : বিজ্ঞানের নেতিবাচক সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবও রয়েছে। মেধাস্বত্ব ও জ্ঞানের ওপর নিয়ন্ত্রণের সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্প বিজ্ঞানকে কাজে লাগায়। জ্ঞানকে পণ্য বানায়, বিমানবিক প্রয়াসে বিজ্ঞানের ব্যবহার বাড়ায়। বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান ও বিজ্ঞানীদের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটে এবং তা মানববৈরী সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদকে শক্তিশালী করে। সে প্রান্তিক কণ্ঠ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে অবহেলা করে। ভুলে যায় নিজের আওয়াজ ও বিবেচনা ছাড়া অন্য কোথাও সত্য থাকতে পারে।

লেখক : কবি, গবেষক
71.alhafij@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
হিলি বন্দর দিয়ে ১৪ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর ওপর : মন্ত্রী রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলায় ওআইসি’র সহযোগিতা চেয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টর্চার সেলে শিশু-বৃদ্ধদের পেটাতেন মিল্টন : হারুন গাজা ত্যাগ করবে না ইউএনআরডব্লিউএ শৈলকুপায় সাংবাদিক মফিজুলের ওপর হামলা : প্রেসক্লাবের উদ্যোগে মানববন্ধন বিএনপির ভাবনায় ক্লান্ত ওবায়দুল কাদের : রিজভী অনলাইন জুয়ায় ২০ লাখ টাকা হেরে যুবকের আত্মহত্যা আল-জাজিরার অফিসে ইসরাইলি পুলিশের হানা মালয়েশিয়ায় কাল বৃহত্তম আন্তর্জাতিক ধর্মীয় সম্মেলন রাস্তা প্রশস্ত করতে কাটা হবে ৮৫৬টি গাছ

সকল