০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`


উৎসের উচ্চারণ

ধর্মনিরপেক্ষতাকে যে জবাব দিতে হবে

ধর্মনিরপেক্ষতাকে যে জবাব দিতে হবে - নয়া দিগন্ত

যেকোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক মতাদর্শের মতো ধর্মনিরপেক্ষতাও একটি মতবাদ। ফলে এতে ত্রুটি ও দুর্বলতা থাকবে, এই সত্য স্বীকার করা উচিত প্রথমেই। তার সাথে দ্বন্দ্বে যাওয়ার ইচ্ছা আপনার না থাকলেও আপনার বহু অনুভূতির সাথে সে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়, যা তার অস্বাভাবিকতাকেই স্পষ্ট করে। এই অস্বাভাবিকতা বহু আত্মঘাত ও জখমের বিস্তার ঘটায়। ধর্মনিরপেক্ষতার তত্ত্বে ও প্রয়োগে নিহিত যে সঙ্কট ও দুর্বলতা বিস্তর। এর মধ্যে অনেক এমন, যাকে সে নিজেই ঢাকতে পারছে না, সেগুলোর দিকে তাকানো যেতেই পারে।

১. ধর্মীয় বৈষম্য: ধর্মনিরপেক্ষতা প্রায়ই ধর্মীয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈষম্যের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষরা ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ এবং স্বার্থকে ধর্মীয়দের চেয়েও অগ্রাধিকার দিচ্ছেন! ধর্মনিরপেক্ষতা সেক্ষেত্রে প্রকাশিত হচ্ছে গোড়া ও অসহিষ্ণু এক ধর্মের আকারে। যার বিরুদ্ধে তার উত্থান ও অবস্থান।

২. ধর্মীয় স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করা: ধর্ম যেন মানুষের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন না করে, এই তো সেক্যুলারিজমের দাবি। কিন্তু সেক্যুলারিজম নিজেই মানুষের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করছে। সে পাবলিক স্পেসে ধর্মীয় অনুশীলনে বাধা দিচ্ছে, পোশাক বা প্রতীকের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করছে। নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করছে, সীমিত করছে, ব্যাহত করছে। যা এক ধরনের বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জানান দেয়। প্রধানত এটা প্রকাশিত হচ্ছে ইসলামোফোবিয়ার আকারে।

৩. সাংস্কৃতিক ক্ষয়: ঐতিহ্যগতভাবে ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে যুক্ত সাংস্কৃতিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে সেক্যুলারিজম। সামাজিক সংহতি ভাঙছে এবং বিশেষ মূল্যবোধগুলোর বিকাশ ও অনুশীলনের ওপর আক্রমণ করছে, সামাজিক বহুত্ব ও অংশগ্রহণমূলক অবস্থান নানা ক্ষেত্রে বিধ্বস্ত করছে।

৪. ধর্মের ভূমিকা কোণঠাসা করা: ধর্মনিরপেক্ষতা জীবনে ও কর্মে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিতে চায়। এতে ধর্মীয় পবিত্রতা, এর মূল্যমান ও শিক্ষা থেকে মানুষের বঞ্চনা অবধারিত হয় বিভিন্ন স্তরে। ফলে জীবনসঙ্কটের ধাপে ধাপে ঐশী প্রজ্ঞার অনুপস্থিতি, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির অনুপস্থিতি ও ধর্মপ্রবর্তকদের মহীয়ান আদর্শের অনুপস্থিতি মানুষকে অধিকতরো সঙ্কটাপন্ন করে, প্রতিকারহীন সীমাবদ্ধতায় আরো বেশি আবদ্ধ করে। ধর্মনিরপেক্ষতা এ থেকে উত্তরণের পথ ক্রমেই কঠিন করে ফেলে। কারণ উত্তরণের জন্য যেসব দৃষ্টিভঙ্গি, অবদান ও আলোকমালা দরকার, ধর্মনিরপেক্ষরা সেগুলোর ভূমিকা সীমিত, দুর্বল ও ক্রিয়াহীন করে চলে প্রতিনিয়ত!

৫. রাষ্ট্রীয় নাস্তিকতা ও নিপীড়নযন্ত্র: চরমপন্থী ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রীয় নাস্তিকতায় পরিণত হতে পারে। যেখানে সরকার সক্রিয়ভাবে নাস্তিকতার প্রচার করে এবং ধর্মীয় অভিব্যক্তি দমন করে, যা বৈষম্য ও নিপীড়নের একটি ধরন হিসেবে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। অনেক সময় তা সরকারি, আধা সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও দমনমূলক আকার নেয়। সেনাবাহিনী, আদালত, বিশ্ববিদ্যালয়, মিডিয়া হাউজ ইত্যাদিতে তার রুদ্রমূর্তি প্রায়ই প্রকাশ পায়। বস্তুত মধ্যযুগের দমনমূলক গির্জার অপর প্রান্তে দমনমূলক সেক্যুলারিজম কম বিপজ্জনক নয়।
৬. নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি ঘৃণা: ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োগ প্রায়ই নির্দিষ্ট ধর্মের বিরুদ্ধে ঘৃণাচর্চার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী অগ্রাধিকারমূলক আচরণ পায়। নির্দিষ্ট ধর্ম বৈষম্যের সম্মুখীন হয়, ঘৃণার সম্মুখীন হয় এবং তার প্রতীক, পরিচয় ও অনুসরণকে নানা পরিসরে নিষিদ্ধ বা অচ্ছুত করার চেষ্টা চলে। তার অনুসরণকারীদের ওপর অসহনীয় বৈরিতা চাপিয়ে দেয়া হয়। তুরস্কের মতো দেশে দীর্ঘসময় ধরে ইসলামের সাথে এ আচরণ করেছে সেক্যুলারিজম, বাংলাদেশ বা মিসরের মতো জায়গায় তার চর্চা দৃশ্যমান।

৭. শিক্ষায় বৈরি বাস্তবতা: ধর্মনিরপেক্ষতা শিক্ষায় ধর্মের ভূমিকা নিয়ে বিরোধিতায় মুখর থাকছে। কেউ কেউ পাবলিক স্কুল থেকে ধর্মীয় শিক্ষা সম্পূর্ণ আলাদা করার জন্য তর্ক করে, যা ধর্মীয় ছাত্র পরিবার ও সমাজকে নানাভাবে ক্ষতির কবলে ফেলে।
৮. নৈতিক আপেক্ষিকতার প্রবণতা: ধর্মনিরপেক্ষতা নৈতিকতাকে আপেক্ষিক হিসেবে দেখাচ্ছে। এতে ন্যায়ভিত্তিক নৈতিক কাঠামোর অভাব তীব্র রূপ নেয়, যা নৈতিকতায় সুবিধাবাদ, নৈতিক দ্বিধা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতাকে উসকে দেয়।
৯. সামাজিক বিভাজন: সেক্যুলার প্রভাবিত সমাজে ধর্মনিরপেক্ষ এবং ধার্মিক বিভাজনকে বিশেষ মাত্রায় দেখা যায়। একটি শ্রেণীকে উপেক্ষা ও প্রত্যাখ্যানের বৃহত্তর আবেগের বিকাশ ঘটে। ফলে সামাজিক বিভাজন হয় ক্রমবর্ধমান, যা বিচ্ছিন্নতা এবং বর্জনের অনুভূতির ওপর সওয়ার হয়ে সামাজিক ভাঙন ডেকে নিয়ে আসে।

১০. নৈতিক ভিত্তির অভাব: ধর্মনিরপেক্ষতার শক্তিশালী কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই। এটি কেবলই আইনি ও রাজনৈতিক কাঠামোর ওপর নির্ভর করে, যা মূল্যবোধজাত এবং নৈতিক সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়।
১১. চরমপন্থার প্রণোদন: ধর্মনিরপেক্ষ সরকারগুলো ধর্মীয় সম্প্রদায়কে স্বীকার করে না এবং তাদের মূল্যবোধের প্রতি অবজ্ঞা করে, তাদের পরিচয় ও প্রতীককে বঞ্চিত করে বিপরীত প্রতিক্রিয়ার জমি তৈরি করে প্রায়ই। সেই ক্ষোভ, বঞ্চনার সেই অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়া আত্মপ্রকাশের স্বাভাবিক স্পেসও পায় না। ফলে তা প্রায়ই নিয়ম ও যুক্তিকে অবলম্বন করে না। এমনকি ধর্মীয় নির্দেশনাকে উপেক্ষা করেও সেই প্রতিক্রিয়ার চরমপন্থী প্রকাশ ঘটতে থাকে।

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা যুক্তি দেন, রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রগুলো থেকে ধর্মের একচ্ছত্র প্রভাব খেদানোর জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার বিকল্প নেই। ধর্মকে খেদিয়ে সেখানে ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের জায়গা করে দেয়া হবে। কিন্তু ধর্মকে কেন খেদাতে হবে? তার অপচর্চা হলে সেটার মোকাবেলা হতে পারে। কিন্তু ধর্মের রিপ্লেসমেন্ট কিভাবে হতে পারে? ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ এবং সেক্যুলারিজমের সঙ্কট ও বিপজ্জনক প্রবণতা সত্ত্বেও তার জন্য কেন ধর্মকে স্থান ছেড়ে দিতে হবে? ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে এ প্রশ্নের ন্যায়সঙ্গত জবাব দিতে হবে।

লেখক : কবি, গবেষক
71.alhafij@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement