৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


নিশ্চয়ই সেটা তারা করবে না

লেখক : সালাহউদ্দিন বাবর - ফাইল ছবি

কোনো সংস্থা বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির দায়িত্ব পালনকালে কথাবার্তায়, বাচনভঙ্গিমায়, দেহশৈলীতে এমন কিছু বলা বা প্রদর্শন করা ঠিক নয়, যা তার পূর্ববর্তী বক্তব্য, আচার-আচরণের সাথে খাপ খায় না। যদি তারা কখনো এমন কিছু করে ফেলেন, সেটি তাদের পদমর্যাদার, দায়িত্বের বরখেলাপ হতে পারে। এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি কিছু না বলে বক্ষ্যমাণ নিবন্ধ এগিয়ে নিয়ে যাই। সেখান থেকে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সমঝদাররা সব বুঝে নিতে সক্ষম হবেন বলে আশা করি।

আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সম্প্রতি একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিককে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেখানে এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেছেন, নির্দিষ্ট কয়েকটি রাজনৈতিক দল বর্তমান সরকার ও ইসির ব্যাপারে অনাস্থা প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, এক ধরনের অরাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হবে। অবশ্যই বিষয়টি রাজনৈতিক ইস্যু, তবে এখন এই বিষয়টি আসন্ন জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অংশগ্রহণমূলক শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সঙ্কট সৃষ্টি করতে পারে। এই রাজনৈতিক বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে নিষ্পত্তি করতে হবে। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কিছুই করার নেই। প্রশ্ন হতে পারে, ইসির কি সত্যিই কিছুই করার নেই! বোদ্ধা সমাজের কাছে এই প্রশ্ন রেখে দেয়া হলো।

এই বক্তব্যটি কিঞ্চিৎ ব্যবচ্ছেদ করা যেতে পারে। বিচার বিশ্লেষণ করে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছাটাই যৌক্তিক। প্রথমত সিইসি উল্লেখ করেছেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকাবস্থায় এবং এই ইসি বহাল থাকলে বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেবে না। তারা তথা সেই দলগুলো যে কথাটি উল্লেখ করেনি, সেটি হলো, অতীতে জাতীয় সংসদের যে দুটো নির্বাচন বর্তমান সরকার ও তদানীন্তন দুই কমিশন করিয়েছিল, সেগুলোর স্বরূপ কেমন ছিল? তা ছাড়া আউয়াল কমিশনের অধীনে যে কয়টি উপনির্বাচন ও সিটির নির্বাচন হয়েছে সেগুলোর শুদ্ধতা ও মান নিয়ে কিন্তু প্রশ্নের অন্ত নেই। সে পরিপ্রেক্ষিতে এটি অনুমান করা নিশ্চয় কঠিন নয়- এই সরকার ও তাদের গঠন করা ইসি মিলেমিশে কী ধরনের নির্বাচন করতে পারে। সে জন্য তাদের ওপর আস্থা স্থাপনের জায়গা কোথায়! তাছাড়া বিরোধী দল অনেক দিন থেকেই বর্তমান সরকার-কমিশন এই দুই সত্তার ব্যাপারে তাদের ‘নো কনফিডেন্স’ দিয়ে আসছে। এখন নতুন করে প্রতিপক্ষ শক্তির আর কিছু বলার কি দরকার আছে?

বর্তমান ইসি গঠনের ইতিহাস সবারই জানা। তথাপি সামান্য একটু স্পর্শ করা হয়তো অযৌক্তিক হবে না। যেমন ইতিহাস সৃষ্টিকারী সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আবরাহাম লিঙ্কন যে কথা বলেছিলেন, অব দ্যা পিপল, বাই দ্যা পিপল, ফর দ্যা পিপল’। এই ইসি বর্তমান সরকার দ্বারা গঠিত এবং কেবলই সরকারের জন্যই তারা নিবেদিত। আর কারো জন্যই কোনো স্থান ইসির হৃদয়ে নেই। তাছাড়া ইসি গঠনের যে বিধান তৈরি করা হয়েছিল সেটির জন্ম একান্তই আওয়ামী ঘরানায় এবং শুধু তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের নিমিত্তেই বরাবর কাজ করেছে। আর কারো জন্য নয়। মাননীয় সিইসি মহোদয় আপনি দিব্যি দিয়ে বলতে পারেন কি, আপনার প্রতি সরকারের স্নেহদৃষ্টি না থাকলে আপনার পক্ষে ইসির মধ্যমণি হওয়া সম্ভব ছিল? সে জন্য আপনাকে তথা ইসিকে নিয়ে সরকারের সাথে সমান্তরালভাবে পথ চলাটাই স্বাভাবিক। আর আপনি সেটিই করছেন বলে সবার অনুমান। সরকারের ও আপনাদের আদর্শগত বন্ধন কি অবিচ্ছেদ্য নয়। সে জন্য কারোরই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার কোনো সুযোগ নেই। যে কথা ইতোমধ্যেই বলে আসা হয়েছে। সেটি আবারো দ্বিরুক্তি করছি। আপনাদের দুই সত্তার এই অটুট বন্ধন কি আপনাদের পক্ষে ভালো নির্বাচন করানোর পক্ষে অন্তরায় নয়। এমন কিছু কল্পনা করাও কি মরীচিকার পেছনে ছোটার সমতুল্য নয়।

জিরো আলমকে শুধু হিরো আলম নয়, সরকারি প্রশাসন ও ইসির ‘মদদে’ কিভাবে সে একজন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছে। অবশ্যই দুই সত্তার সম্মিলিত প্রয়াসের ফল এটি। হিরো আলমের মতো একজন দুর্বল ব্যক্তি আপনাদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে এখন বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর যুবক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। পক্ষান্তরে বিশ্ববরেণ্য এক মনীষী প্রফেসর ইউনূসকে অপদস্থের শেষ সীমায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেলুকাস কি বিচিত্র এ দেশের প্রশাসন (!) বলা হয়, যে দেশে ঘি ও তেলের দাম এক হয় বা যেখানে সোনা আর তামার মূল্য বরাবর হয় সেখানে নাকি বাস করা খুবই দুঃসহ হয়ে ওঠে। আসলে এই জনপদের মানুষ এখন কোন সে ভূখণ্ডে বসবাস করছে- এ প্রশ্ন উঠতেই পারে।

জনাব সিইসি, দেশের মানুষ দেখছে আপনি ও আপনাদের পারিষদসহ সিসিটিভির সম্মুখে বসে অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে অপলকনেত্রে দূরের এক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন। মানুষ তা দেখে আপনাদের সাধুবাদ জানিয়েছে। তবে ঘরের পাশে সেই আর্শিনগর ছিল গুলশান। কিন্তু তারপরও আপনারা ‘চোখের আলোয় দেখেননি চোখের বাহিরে।’ এর পরও যদি ইসি জনগণকে বলেন তাদের ওপর অটুট আস্থা রাখতে। সেটা ‘ওভার টেক্সশেন’ হয়ে যায় না। এ কথাটা যদি একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, আপনারা জনগণের ওপর অটুট আস্থা রাখুন। সম্মিলিতভাবে জনগণের জন্য একটা ভালো পরিবেশ সৃষ্টি করুন। তাহলে দেখবেন নির্বাচনে ভোটারদের ‘চমৎকার পার্টিশিপেশন’এর মাধ্যমে একটি স্মরণীয় নির্বাচন হয়ে যাবে বাংলাদেশে। এটা সত্য নয় কি গুলশানে যা যা দেখা গেছে, তাতে বিশ্ব দরবারে দেশের মানুষের মাথা হেঁট হয়ে যায়নি। বিরল দৃষ্টান্ত কেবল আপনারা এখনো মাথা উঁচু করে রেখেছেন। যেমন ‘শৈবাল দীঘিরে বলে উচ্চ করি শির লিখে রেখ একটা ফোঁটা দিলেম শিশির।’ ঠিক ইসি এখন যেমন বলছে, গুলশানের ‘ক্ষত-বিক্ষত’ নির্বাচনের পর একটা ফল তো পাওয়া গেল!

যাই হোক, সেই সাক্ষাৎকারে সিইসি কি অকপটে স্বীকার করে নেননি, সরকার ও ইসির প্রতি সব বিরোধী দল ও জনগণের কোনো আস্থা নেই। এ কথা বলে কি প্রকারান্তরে ইসি-সরকারকে ব্র্যাকেট বন্দী করে ফেলা হয়নি। এমন অভিযোগ এখন সবার মুখে মুখে ফিরছে। এ কথা সত্য যে, এই ইসির ইতিহাস তেমন দীর্ঘ নয়। এতটুকু সময়েই তারা কিন্তু পক্ষপাতিত্বের বহু রেকর্ডই ভেঙে ফেলেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ ব্যক্তিদের নির্বাচনসহ অন্যান্য বিষয়ে দক্ষতা (!) পারঙ্গমতা (!) আসলেই তুলনাহীন। তাদের যে বিশেষণে ভূষিত করা হলো সেটা কি সত্য না অন্য কিছু! ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের যত সুকীর্তি সবই রেকর্ডভুক্ত আছে। সে ইতিহাস দেশবাসীর মুখস্থ। সে জন্য অতীত নিয়ে আর কথা না বাড়াই।

তবে সেই ইতিহাসের জের কিন্তু ক্রমাগতভাবে দেশ দশের সাথে একেবারে ঘনিষ্ঠভাবেই চলছে। সমস্যাটা এখানেই, সেই দুই ‘নির্বাচনী প্রহসন’ সামনে রেখে আগামীতে নতুন মোড়কে একই বা ভিন্ন ছাচে ফেলে একটা মকারির ভোট করার আয়োজন করার নির্ঘুম সময় কাটাচ্ছে কি সব কুশীলবরা। অতীতের সব নির্বাচনী প্রহসন নিয়ে যে স্মৃতিচারণ করা হয়েছে, সে অধ্যায়ে কেবল দেশের মানুষের অভিজ্ঞতা অনুভূতির বিষয়টি সংযুক্ত। কিন্তু দেশের বাইরেও যে এসব চাউর হয়ে গেছে সেটাও কারো অজানা নয়। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। কিছু দিন আগে সদ্য আগত নয়া জাপানি রাষ্ট্রদূত একটা কথা বলেছিলেন, আমি কখনো শুনিনি দিনের ভোট রাতে হয়। ঢাকায় এসে এমন কথা প্রথম শোনার দুর্ভাগ্য হলো। যাই হোক আমাদের নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই এখন দিনের ভোট দিনেই আয়োজন করাকে দুঃস্বপ্ন বলে মনে করে। এই ভূখণ্ডে এমন হয়েছে যে, ভোটকেন্দ্রে জনধিক্যকে কেউ নির্বাচনের নিথর নিশ্চুপ পরিবেশকে খুবই উপযোগী বলে মনে করছেন। লোকসমাগম যাতে হতে না পারে তার অপূর্ব সে শৈলী অনুশীলন করা হয়েছিল। এখন সবারই শঙ্কা, আগামী নির্বাচনকে কোন কৌশলে হাস্যস্পদ করার ব্যবস্থা নেয়া হয় কি না!

অপর এক প্রশ্নের উত্তরে সিইসি বলেছেন, দেশের বিদ্যমান নির্বাচনী আইন অনুসরণ করা হবে। সেই সাথে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালনরত পুলিশ ও সাধারণ প্রশাসনের কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাছ থেকে এমন ‘সততা-নিষ্ঠার সাথে নিরপেক্ষ আচরণ আশা করেন।’ যাতে একটা স্বচ্ছ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করানো সম্ভব হয়। মাত্র কিছুকাল পূর্বে এক নির্বাচনের পর সিইসি কিছুটা হতাশার সুরে বলেছিলেন, সরকারের সহযোগিতা ব্যতিরেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ তৈরি হতে পারে না। এখন পূর্ব পরিস্থিতির কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনস্থ সকল প্রশাসন কি ইসিকে তার কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ তৈরি করে দেবে? সিইসির ১৫ মাসের অভিজ্ঞতাটা কেমন। তিনি সেটা ব্যক্ত করেছেন। কেউ যদি কোনো বিষয়ে মৌনতা অবলম্বন করে। সে ক্ষেত্রে কারো পক্ষেই তাকে ইতিবাচক বলে ধরে নেয়া যাবে কি।

সর্বশেষ গুলশানে সব সরকারি প্রশাসনের যে ভূমিকা লক্ষ্য করা গেছে- সিইসির যদি সৎ নিয়তও থাকে, সে ক্ষেত্রে প্রশাসনের সহযোগিতায় কোনো প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান কি সম্ভব? এ দিকে সরকারের প্রশাসন বিন্যাসের সর্বশেষ যে পদক্ষেপ সেটা লক্ষ করা হলে পরিষ্কার হয়ে উঠবে নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে তাদের মনের মতো করে সর্বস্তরের প্রশাসনকে সাজিয়ে নিচ্ছে। কোনো সন্দেহ নেই, এমন বিন্যাস অবশ্যই নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করবে। এসব কর্মকর্তার সব তৎপরতা ক্ষমতাসীনদের অনুকূলেই যাবে। সে ক্ষেত্রে এমন পাতানো নির্বাচনে সরকারের প্রতিপক্ষ শক্তির অংশগ্রহণের অর্থ হচ্ছে নিছক স্বেচ্ছা মৃত্যুবরণ। নিশ্চয়ই সেটি তারা করবে না। বিশ্ব তাতে অবাক হবে নিশ্চিত।

ndigantababar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement