২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মনোজগতে দুর্বৃত্তায়ন

মনোজগতে দুর্বৃত্তায়ন। - ছবি : সংগৃহীত

হাল আমলে ভাটি বাংলা অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশ এতটাই নৈতিকতা বিবর্জিত হয়ে পড়েছে যে, প্রকৃত চিত্র প্রকাশে মন ভারাক্রান্ত হয়। শুধু মনোকষ্ট বাড়ে না; অসহায়ত্বের বোধ তীব্র হয়। গত তিন দশকে প্রায় সবার মনোজগত দুর্বৃত্তায়নে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে গত ১৫ বছরে ক্ষমতাসীনদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় সারা দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। দিন চারেক আগে ছোট্ট একটি ঘটনার মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করি। ঘটনার বিশ্লেষণে এ উপলব্ধি মনে উঁকি দেয়, আমরা কী অধঃপাতের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি। প্রিয় পাঠক, নিজের সাথে ঘটে যাওয়া অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাটি শেয়ার করছি এ জন্য, আপনারা অনেকে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন।

২২ জুলাই, শনিবার। সকাল ১০টা। কর্মস্থলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। হাতে সময় কম। কিশোর ছেলেকে ৫০০ টাকা দিয়ে দোকানে পাঠাই কিছু সদাই আনতে। সাথে ওর মা তার উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ আনতে বলেন। ছেলে যথারীতি বাবার আদিষ্ট সদাই কিনে মায়ের ওষুধ আনতে পরিচিত এক ওষুধের দোকানে যায়। নির্দিষ্ট ওষুধ নিয়ে দাম দিয়ে বাসায় আসে। যথারীতি ছেলে বেঁচে যাওয়া টাকা ফিরেয়ে দেয়। হিসাব কষে দেখি, পণ্য কিনতে যে ব্যয় হওয়ার কথা তার সাথে ফেরত দেয়া টাকার গরমিল। জিজ্ঞাসা করলে জানায়- ওষুধের দাম এত। যেহেতু নিয়মিত ওই ওষুধ কিনতে হয় তাই বললাম; এর দাম এত হওয়ার কথা না। ছেলে করুণ কণ্ঠে জানায়, দোকানদার যে এত টাকা রাখলেন। মনের খটকা দূর করতে নিজে গিয়ে দোকানিকে জিজ্ঞাসা করি। উত্তর শুনে টাসকি খাওয়ার অবস্থা। বললেন, ওষুধের দামটা তার ঠিক জানা ছিল না।

মাছ কিংবা কাঁচাবাজারে পণ্য কিনতে ক্রেতাদের যে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়; ওষুধ কিনতে সেই ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয় না। ওষুধের দাম দৈনিক ওঠা-নামা করে না। ফিক্সড প্রাইজ। অবাক কাণ্ড এই যে, ৩০ বছর ধরে ওই ওষুধ বিক্রেতা ব্যবসা করছেন। তার ভুল হওয়ার প্রশ্নই আসে না।

ওষুধ বিক্রেতার জবাব শুনে নিজের তরুণ বয়সের একটি ঘটনা মনে পড়ে। আমাদের অঞ্চলটি পদ্মা-যমুনা তীরবর্তী বন্দর এলাকা। প্রতি শনিবার লাখো মানুষের হাট বসে। এক আধপাগল লেবুচাষি তখনই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লেবু উৎপাদন করতেন। মৌসুমে তিনি প্রতি হাটবার ঝুড়ি ঝুড়ি লেবু আনতেন। সুনামের কারণে ক্রেতার ভিড় লেগে থাকত। কেউ তিন-চার হালির কম লেবু কিনতেন না। মজার ব্যাপার হলো, প্রত্যেক ক্রেতা কেনার সময় ভুলোমনের চাষির লেবু গুনে নিতেন। এর মাহাত্ম্য আর কিছু নয়; লেবুচাষি সবাইকে এক-দু’টি কম দিতেন। এক রসিক ক্রেতা একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলেন তুমি যে কম দাও; কই একদিনও তো বেশি দাও না? জবাবে ওই চাষি বললেন, পাগল হলেও এত পাগল হইনি!

বুঝতে অসুবিধা হয় না, ওষুধ ব্যবসায়ী যে বর্ধিত ঢাকায় একটি তিনতলা বাড়ির মালিক হয়েছেন; মানে বাড়িওয়ালা- সেটি গড়েছেন ঠগবাজির পয়সায়। তার কাছের মানুষের সাথে আলাপকালে জেনেছি; অনেক গ্রাহকের সাথে অতি মুনাফার লোভে এমন কম্ম (অপকর্ম) হরহামেশা করেন তিনি। এটি অভ্যাসে (পড়তে হবে বদভ্যাস) পরিণত হয়েছে।
ওই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর খাসলত জেনে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া অন্যায় হবে না যে, তার মনোজগতে গেড়ে বসেছে দুর্বৃত্তায়ন।

এ ঘটনার পর খেয়াল করে দেখিছি, আমার কিশোর ছেলেটির সাথে একই আচরণ করেন মহল্লার মুদি দোকানিও। মানে তিনিও ঠগবাজ। যেমন- দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় দেশের বাজার-ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় নিজেদের মর্জিমাফিক সব জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেয়। বর্তমান সরকার ব্যবসায়ীবান্ধব হওয়ায় এ কর্ম (অপকর্ম) করে তারা অনায়াসে পার পেয়ে যাচ্ছেন। কেউ টিকিটিও ছুঁতে পারেন না। তাই তো দুর্জনরা বলাবলি করছেন, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ঘটা করে সম্মেলন ডেকে বর্তমান সরকারকে ফের ক্ষমতায় বসাতে পেরেশান। এ জন্য যা যা করা দরকার, তা করার ঘোষণা দিয়েছেন। ঘোষণার সময় বুক চিতিয়ে, গলা ফুলিয়ে নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যরে জানান দিয়েছেন। এই জানান দেয়া যে, মতলবি তা না বললেও চলে। কে না জানে, একটি দুর্বল জনসমর্থনহীন সরকার থাকলে লুটপাটের মওকা মেলে। কায়কারবার চলে ফ্রি স্টাইলে। ব্যবসায়ীদের এ কায়দা-কানুন রপ্ত আছে, কিভাবে অন্যের জমি কৌশলে দখলে নিতে হয়। সাধারণ গ্রাহকের জমা রাখা হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে কিভাবে লোপাট করা যায়। ব্যাংক লুটের কলাকৌশল তাদের চেয়ে বেশি জানেন দুনিয়ায় আর কে আছেন। তাদের টেক্কা দেয়ার সাধ্যি কারো নেই, এটি হলফ করে বলা যায়।

তাদেরই একজন ক্ষুদ্র ভ্রাতা ওষুধ কারবারির কাণ্ড নিয়ে কিছুটা সময় ভাবনায় তলিয়ে যাই। যতই ভাবতে থাকি; মন খারাপের পরিমাণ তত বাড়তে থাকে। একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, আমাদের সমাজ কোন অলক্ষে এতটা নৈতিকতা-বিবর্জিত হয়ে পড়ল? প্রসঙ্গত, আমাদের স্মরণে থাকার কথা, নিকট অতীতে দেশের প্রাইমারি শিক্ষকদের সততা ছিল প্রবাদপ্রতিম। কিন্তু উপবৃত্তি চালু হওয়ার পর সেই সততায় শুধু চিড় ধরেনি ধপাস করে ধসে পড়েছে। এ ছাড়া বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধি সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অর্থ নয়ছয় করেন সংবাদমাধ্যমে প্রতিনিয়ত খবর হয়।

কেন সমাজের তৃণমূল থেকে উপরতলা সর্বত্র দুর্নীতির কড়ালগ্রাস? এর তত্ত্ব তালাশ করা প্রয়োজন। দার্শনিক উত্তর পাওয়াটাও জরুরি বৈকি। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজিক পরিমণ্ডলে ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের’ শাশ্বত নীতি থেকে ক্ষমতাসীনরা দূরে সরে গেছেন। দুষ্টের দমনের পরিবর্তে লুণ্ঠনজীবীদের মদদ দেয়া শ্রেয় মনে করা হচ্ছে। দু’টি নমুনা দিই- এক. ‘’বিদ্যুৎ খাতের ‘লুটেরা মডেল’ চিহ্নিত করায় দু’জন সরকারি কর্মকর্তার ‘পুরস্কার’ হলো সাময়িক বরখাস্ত। পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রধান এবং একজন পরিচালককে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে সরকার। আইএমইডির বরখাস্ত হওয়া প্রধান অতিরিক্ত সচিব এস এম হামিদুল হককে বরখাস্ত করা হয় বৃহস্পতিবার এবং পরিচালক উপ সচিব মাহিদুর রহমানকে বরখাস্ত করা হয় তার দু’দিন আগে। এর আগে তাদের দু’জনকেই দায়িত্ব থেকে অপসারণ করে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি (কার্যত দফতরবিহীন) করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়। তাদের সাময়িক বরখাস্তের আদেশে বলা হয়েছে, এটি ‘অসদাচরণের’ অভিযোগে নেয়া বিভাগীয় ব্যবস্থার অংশ। কিন্তু অসদাচরণের কোনো বিবরণ সরকারি প্রজ্ঞাপনে নেই। তবে আমরা অনুমান করতে পারি- তারা তাদের ওপর অর্পিত রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পেশাদারি ও নিষ্ঠার সাথে সম্পন্ন করেছেন, সরকারের রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতি, কিংবা অন্য কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ বিবেচনায় তাতে তথ্য লুকানো বা কল্পকাহিনী রচনা করেননি। বস্তুত রাষ্ট্রীয় স্বার্থের প্রতি আনুগত্যের কারণে শতভাগ ‘বিদ্যুতায়িত দেশে’ বিদ্যুৎ খাতের ক্যাপাসিটি চার্জ যে একটি ‘লুটেরা মডেল’, সেই সত্য তুলে ধরেছেন।” (প্রথম আলো, অনলাইন সংস্করণ, ২২ জুলাই, ২০২৩)।

দ্বিতীয়টি খুব আলোচিত ঘটনা। মো: শরীফ উদ্দিন ছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপসহকারী পরিচালক। প্রভাবশালীদের দুর্নীতি উন্মোচনের অপরাধে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয় বলে অভিযোগ জোরালো। চাকরি হারিয়ে সাবেক এই দুদক কর্মকর্তা সংসার চালাতে কিছু দিন কনফেকশনারি দোকানিও হয়েছিলেন। এসব ঘটনা দেখে চলতি হাওয়াপন্থীরা বলে সততা ধুয়ে পানি খেলে তো পেটের জ্বালা মেটানো যাবে না! তাই প্রায় সবাই শঠতার তরিকা ধরেছেন।

দেশে দুর্নীতির সর্বগ্রাসী চিত্র প্রায় প্রতিদিন পাওয়া যাবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে। একটি সাধারণ বালিশের দাম যখন ধরা হয় সাড়ে ছয় হাজার টাকা। পর্দার মূল্য যখন লাখ টাকা হয়ে যায়। সেসব ভাউচার অনায়াসে অনুমোদনের ব্যবস্থাও হয়। প্রকৃত বাস্তবতায় দেশে এখন ক্ষমতার শীর্ষ মহল থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সর্বত্র দুর্নীতির সাধারণীকরণ হয়েছে।
কিন্তু একটা সমাজ কেন এত দ্রুত ধসে পড়ল? আসলে মানুষের মধ্যে আদর্শিক চেতনার চেয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ, লাভ-ক্ষতি এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অনুভূতি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এই যে ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির প্রাধান্য সব জায়গায় জেঁকে বসেছে, এ কারণে আমরা স্বার্থপর এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে গেছি। তাই তো ‘সুখের লাগিয়া সব কিছু করতে প্রস্তুত’। আর অর্থই যেখানে সুখের একমাত্র চাবিকাঠি সেখানে মনোজগতে দুর্বৃত্তায়ন হওয়াই পরিণতি। চলতি হাওয়ার বাইরে যারা; তারা এ সমাজে অচল টাকা। ফেলে দিতে না পারলে লুকিয়ে রাখতে হয়। যার জন্য রাষ্ট্রের সৎ কর্মকর্তাদের পুরস্কার সাময়িক বহিষ্কার কিংবা চাকরিচ্যুতি। তাদের ছেঁটে ফেলতে না পারলে লুকিয়ে রাখতে হয়, যাতে ক্ষমতাধরদের কর্মকাণ্ড চলতে পারে অবাধে।


আরো সংবাদ



premium cement
বার্লিনে ফিলিস্তিনিপন্থী ক্যাম্প ভেঙে দিয়েছে জার্মান পুলিশ সেভ দ্য চিলড্রেনে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ বনশ্রীতে কিশোরী গৃহকর্মীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার সৌদি আরবে আরব ও ইইউ কূটনীতিকদের গাজা নিয়ে আলোচনা ইউক্রেনকে দ্রুত প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র দিতে যাচ্ছে পেন্টাগন ডিএমপির অভিযানে গ্রেফতার ৩৯ মিয়ানমারের জাতীয় গ্রন্থাগারে বাংলাদেশ দূতাবাসের বই অনুদান ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশী প্রভুদের দাসত্ব করছে : কাদের ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশু সুলতান মাহমুদকে বাঁচাতে সাহায্যের আবেদন গাজার নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলি হামলায় নিহত ১৫ মুজিবনগরে ২ চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষ, আহত ১৩

সকল