৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


প্লাস-মাইনাস নিয়ে এখন রাজনীতি

প্লাস-মাইনাস নিয়ে এখন রাজনীতি। -

চলমান ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ রাজনীতির অঙ্গনে বড় দুই দল তাদের সর্বশেষ অবস্থান স্পষ্ট করেছে। গত ১২ জুলাই পৃথক দুই সমাবেশ থেকে এমন ঘোষণা এসেছে। আওয়ামী লীগ বলেছে, তাদের এক দফা শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হতে হবে, অন্যথা নয়। অর্থাৎ নির্বাচনের প্রশ্নে হাসিনাকে অবশ্যই প্লাস করতে হবে। তা না হলে নির্বাচন হবে না। পক্ষান্তরে বিএনপির শর্ত শেখ হাসিনাকে মাইনাস করলেই শুধু নির্বাচন। আসল কথা হচ্ছে, বর্তমান সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি আসবে না। শুধু বিএনপি নয়; তাদের মিত্র আরো ৪০-এর অধিক দল নির্বাচনে অংশ নেবে না। জামায়াতও পরিষ্কারভাবে বলে আসছে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। এসবের সমীকরণ হচ্ছে, আওয়ামী লীগের দাবি নির্বাচনের প্রশ্নে শেখ হাসিনাকে প্লাস করতে হবে। আর সব বিপক্ষ শক্তির শর্ত হচ্ছে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে শেখ হাসিনার সরকারকে মাইনাস করতে হবে। এখন উভয় পক্ষের দাবি ও শর্তের যোগফলটা হচ্ছে প্লাস আর মাইনাস। প্লাস-মাইনাস সমান-সমান মাইনাস।

উভয় পক্ষের এই প্লাস-মাইনাসের ফর্মুলা হয়তো অনিবার্য করতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় গ্রহণযোগ্য একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন কর্তৃপক্ষের অধীনেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের আয়োজন করা। আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের বাংলাদেশের নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় অংশ নেয়া প্রায় নিশ্চিত হতে চলেছে।

এমনটা যদি হয়ই, তবে কেউ মনে করতে পারেন এই রাজনৈতিক যুদ্ধে বিএনপিই জয়ী হলো। আর কেউ এমনও ভাবতে পারেন এই লড়াইয়ে আওয়ামী লীগ হেরে যায়নি। যারা এই দুই ধারায় বিভক্ত তাদের সবাই মনে করতে পারেন ঠিক আছে বাইরের মধ্যস্থতায় একটি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত হোক। তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের হাল ধরুক। নানা কারণে সেই কর্তৃপক্ষ কখনো কঠিন কখনো কোমল হবে। সেটি উভয় পক্ষই মনে করতে পারে। সেই অন্তর্বর্তীকালীন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সে মুহূর্তে ক্ষমতাসীন সরকারি দল তথা আওয়ামী লীগ কিছু স্পেস করে নিতে চাইবে। আবার অনেকেই মনে করে বিএনপিও সেই কর্তৃপক্ষের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। এমন কিছু ভাবা অযৌক্তিক নয়। তবে এ কথা ঠিক ইতঃপূর্বে সরকারবিরোধী আন্দোলনে তথা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে বিএনপি নেতাকর্মীদের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। বহু মূল্যই তাদের গুনতে হয়েছে। তারপরও এভাবে দুই পক্ষ যদি একটা অবস্থান তৈরি করে নিতে পারে তবে পরিস্থিতি এক স্থানে এসে দাঁড়াবে।

কিন্তু গোল বাধবে তৃতীয় পক্ষকে নিয়ে। সেই পক্ষ হচ্ছে আওয়ামী লীগ আমলে যারা গুম খুন হয়েছে যেসব পরিবার
নিগৃহীত নির্যাতিত হয়েছে। তাদের শোক দুঃখ কান্না বাদ-প্রতিবাদ কারো পক্ষে কি উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ থাকবে। অবশ্যই তখন বিএনপিকে এদের পাশে এসে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে হবে। তখন কিন্তু আওয়ামী লীগকে কারো পক্ষেই স্পেস দেয়ার সুযোগ থাকবে না। তা ছাড়া এই স্পেস পেয়ে তারা সেটি যদি সেফ এক্সিটের সময় পর্যন্ত নিয়ে যেতে চায় তখন যারাই রাষ্ট্রযন্ত্রের হাল ধরে থাকুক না কেন তাদের পক্ষে কি আওয়ামী লীগের এমন চাওয়া পূরণ করা সম্ভব হবে। দেশের আইনকানুন প্রয়োগের ক্ষেত্রটি সে সময় অনেক বিস্তৃত হবে। তা ছাড়া তখন কিন্তু আজকের মতো কেউই আইনের ঊর্ধ্বে থাকার সুযোগ পাবে না। এটা বাড়তি কথা নয়, একেবারেই বাস্তবতা। এ পরিস্থিতি এমন পরিণতিতে পৌঁছার সব সম্ভাবনাই বাস্তবে রূপ নেবে।

প্রকৃতপক্ষে, আগামীতে এমনই এক জটিল পরিস্থিতি সবাইকে মোকাবেলা করতে হবে। বিশেষ করে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারকে বিগত ১৫ বছর কোনো জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হয়নি। আগে তারা ছিল বেপরোয়া। যখন যা মন চেয়েছে তাই করেছে। কেবল দেখেছে নিজের স্বার্থে কোথাও কোনো ব্যত্যয় যেন না ঘটে। এমন অন্ধত্ব কখনো কোথাও কারো জন্যই মঙ্গল বয়ে আনেনি। নিকট ও দূর অতীতে তার ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। যখন জবাবদিহির সেই সময় উপস্থিত হবে তখন এ কথা মনে হতে পারে, ভাবিয়া করিও কাজ; করিয়া ভাবিও না।

আগেই বলা হয়েছে, কোনো পালাবদল ঘটলে অনেক কিছু সামনে চলে আসবে। বিশেষ করে ডুবন্ত মানুষ তো খড়কুটা ধরেও বাঁচার চেষ্টা করে। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সব কর্তৃপক্ষের দুয়ারেই ধরনা দেবে তাদের জন্য একটা দুয়ার খোলার জন্য। সেই মুহূর্তে কি কোনো কর্তৃপক্ষের জন্য যা ইচ্ছা করা সম্ভব হবে। ভারসাম্য বলে একটা বিষয় আছে। কারো পক্ষেই পরিস্থিতির কারণে কোনো অনুরোধ আবদার শোনা সহজ হবে না। ব্যক্তিবিশেষ বা কোনো গোষ্ঠী সবসময় তার পরিণতির কথা বেমালুম ভুলে যায়। অবশেষে তাকে বা তাদের অবশ্যই এ জন্য একটা চরম মূল্য দিতে হয়। আগামীতে তারা যে একটা সেফ এক্সিটের জন্য কাতরতা প্রকাশ করবে সে সময়ও কিন্তু আগেই ফুরিয়ে গেছে।

নিবন্ধে যে কথা বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ তখন সেফ এক্সিটের জন্য মিনতি জানাতে পারে, তবে বিপরীতে বিএনপির পক্ষ থেকে যে সেফ এনট্রান্সের দাবি উঠবে তাকে হালকা করে দেখার অবকাশ থাকবে না। কেননা বিএনপির সমমনা সংগঠনগুলোর হাজার হাজার নেতাকর্মীকে জীবন বাঁচাতে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। তাদের কেউ দুর্নীতিবাজ রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনকারী ছিল না। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করা হয়েছে। সে জন্য কারো পক্ষেই তাদের এনট্রান্সকে বাঁকা চোখে দেখা সম্ভব হবে না। তখন এই এক্সজিট ও এনট্রান্স অনেক বড় রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। সেই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সুচিন্তিত একটা পথ বের করতে হবে।

যাই হোক, ওপরের বক্তব্যকে কেউ এ মুহূর্তের স্পেকুলেশন বলে ধরতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কেউ কিন্তু বিষয়টি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারবেন না। হাওয়ায় দোল খেয়ে সন্ধ্যায় আকাশ যেভাবে ক্ষণে ক্ষণে তার রঙ বদলায় সম্মুখে রাজনীতির আকাশও এমনই হতে পারে। রাজনৈতিক আকাশে বয়ে যাওয়া এলোমেলো সমীরণে সেখানেও বারবার তার স্বরূপ পাল্টে যেতে পারে। তখন যে পক্ষ অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কতটা কৌশলী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়- সেটিই দেখার বিষয়।

আসলে ঘুড়িটা এখন দূর আকাশে উড়ছে। কিন্তু নাটাইটা কার হাতে কেউ কি বলতে পারবেন? এই নাটাইটা কেন কিভাবে হাত ছাড়া হলো তার জবাব অবশ্যই পেতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, যারা গত প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতার চর্চা করছেন তাদের কাছেই জাতি এসবের জবাব চাইতে পারে। এটাই যক্তিযুক্ত। তাদের টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার নিট রেজাল্ট কী? এ জন্য তারা আগামীতে ডান হাতে নিজেদের আমলনামা পেতে পারেন না।

প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এখন রণক্লান্ত। কেউ কেউ হয়তো এটা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা এখন করছে। বিশেষ করে কিছু মিডিয়া দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে তাদের মতো করে ব্যাখ্যা করার ঠিকাদারি রাজনীতিকদের কাছ থেকে স্বপ্রণোদিতভাবে নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে। তবে সেটি শুভ লক্ষণ নয়। এই মিডিয়া এখন তাদের মতো করে লাগসই সব ‘এক্সপার্টদের’ মাঠে নামিয়ে দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। অথচ এসব ‘এক্সপার্ট’ গত ১৫ বছর সরকারবিরোধীদের ওপর যে নির্যাতন চলেছে তখন মগ্ন মৈনাকের মতো হিমালয়ের চূড়ায় উঠে মাথা গুঁজে গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন ছিল। আর অপেক্ষায় ছিলেন মাহেন্দ্রক্ষণ কখন আসবে। অতীতের সব সুবিধাভোগী এখন রৌদ্রস্নান শেষে জেগে উঠে ভেল্কিবাজি দেখানোর চেষ্টা করছে। তবে তাদের সবকিছুই হবে ‘সকলই গরল ভেল’। কেননা এখন জনতা জেগেছে। আর তারা মাঠে একা নয় তাদের বিপক্ষে অনেক পাকা খেলোয়াড়ও এখন চমৎকার কসরত দেখাচ্ছে। জনগণ তাতে পরমানন্দ পাচ্ছে।

এখন কিছু স্পেকুলেশন এবং কঠিন বাস্তবতা নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। গত ১৫ বছরে দেশে এমন এক ‘সুশাসন’ চলেছে যে কারণে দেশের কঙ্কালসার মানুষের হাতে এমন ঝুড়ি তুলে দেয়া হবে যার কোনো তলা নেই। এই অবস্থায় রাজনৈতিকভাবে যুদ্ধাহত কোনো সৈনিকের পক্ষেই এমন কোনো ভার নেয়া যুক্তিসঙ্গত নয়, যা সেই এ মুহূর্তে বহন করতে পারবে। সে জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে। তবে দিকনির্দেশনা দিতে হবে সেই অন্তর্বর্তীকালীন কর্তৃপক্ষকে কোন পথে দেশ দশের প্রকৃত মুক্তি। রাষ্ট্র মেরামতে যে দফাগুলো মাঠে এসেছে সেই দফাগুলোই সামনে নিয়ে আসতে হবে। তারপরই নির্বাচনী খেলা নয় মেলায় নামতে হবে। অর্থাৎ আগে মানুষ হাসি-খুশি আনন্দ উৎসব করে যেমন বার্ষিক মেলায় যোগ দিত- তেমন করেই নির্বাচনকে উৎসব মনে করে হাজার হাজার নর-নারী বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নির্বাচন কেন্দ্রে হাজির হতো। আজ সেটি কোন রূপ নিয়েছে? তার সব শেষ দৃশ্য ঢাকা মহানগরীর জনগণ দেখেছে। এ নিয়ে আর কথা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। আগের সেই মেলায় অংশ নেয়ার মতো পরিবেশ তৈরি করতে হবে নির্বাচনের দিনে। দেশের ১৬ কোটি লোক সেটি আশা করে।
ndigantababar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement