৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


নয়া নির্বাচনী আইন সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কি!

লেখক : সালাহউদ্দিন বাবর - ফাইল ছবি

কয়েক মাস থেকে রাজনীতি হয়ে উঠেছে মুখর। সে পর্যায় থেকে রাজনীতি অগ্রসর হতে শুরু করলেও এখন রাজনীতি দ্রুত এগোচ্ছে। মাঠে-ময়দানে রাজপথে নগরে-বন্দরে গৃহাভ্যন্তরে, নেপথ্যে পর্দার অন্তরালে সর্বত্র রাজনীতি সচল। শুধু সচলই নয়, এতে বিভিন্ন অনুষঙ্গ যোগ হচ্ছে। সব মিলিয়ে রাজনীতি এক নতুন মাত্রায় পৌঁছে গেছে। এমন আরো অনেক কিছুই এখন সক্রিয়, যা আগে দেখা যায়নি। সম্ভবত নিকট ভবিষ্যতে আরো কিছু যোগ হতে পারে। অনেকেই এই মুহূর্তে যা ভাবতে পারছেন না। সে জন্য রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল অপেক্ষায় রয়েছে।

রাজনীতিতে নতুন যে অনুষঙ্গের কথা বলা হয়েছে। সে সম্পর্কে দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে। জনগণ কিছুকাল থেকে লক্ষ করে আসছে, বাংলাদেশে নিযুক্ত পশ্চিমের রাষ্ট্রদূতরা ও তাদের পূর্ব বলয়ের সহযোগী দেশের দূতরা প্রবলভাবে সক্রিয়। আবার রাশিয়া-চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ দেশের রাজনীতিতে এখন ভূমিকা রাখছে। পশ্চিম-পূর্বের গণতান্ত্রিক শক্তির দূতরা এ দেশে রাজনীতি, অর্থনীতি ও মানবাধিকারসহ অন্যান্য জরুরি বিষয়কে ইতিবাচক একটি ধারায় ফিরে আসুক সেটি তাদের কামনা এবং সে বিষয়ে সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করছে। অন্য দিকে রুশ-চীনের উদ্দেশ্যে মাত্র একটি। তারা এখানে কেবল ক্ষমতাসীনদের টিকিয়ে রাখতে সার্ভিস দিচ্ছে। তাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, বর্তমান ক্ষমতাসীনদের টিকিয়ে রাখতে পারলে রুশ-চীনাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ অটুট থাকবে।

নেপথ্যে থেকে তাদের এ দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারেও ভূমিকা রাখার সুযোগ আগের মতো অবারিত থাকবে। পশ্চিম ও পূর্বের গণতান্ত্রিক বলয়ের কোনো স্বার্থ এখানে উদ্ধার হবে এমন বলার খুব একটা স্কোপ নেই। বরং তাদের নির্দোষ লক্ষ্য হচ্ছে গণতান্ত্রিক বিশ্বের পরিধি বৃদ্ধি করা। এর ফলে বিশ্বের গণতন্ত্র মানবিকতার বিকশিত হওয়ার পথ মসৃণ হবে। তা ছাড়া বাংলাদেশের জনগণের গণতন্ত্রের প্রতি তাদের যে আবেগ-অনুভূতি ভালোবাসা প্রতিশ্রুতিবদ্ধতাকে সম্মান করা সহানুভূতি প্রকাশ করাই তাদের অভিপ্রায়। মানবাধিকারের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের অপরিসীম শ্রদ্ধা থাকার পরও এখানে মানবিকতা ভূলণ্ঠিত, বহু মানুষ অমানবিকতার শিকার হয়েছে। গণতান্ত্রিক বিশ্ব এরও একটা বিহিত করতে চায়। গণতান্ত্রিক বিশ্বের শক্তিগুলোর এমন ভূমিকা তথা তাদের নেপথ্য থেকে বেরিয়ে এসে নানা বিষয়ে প্রশ্ন তোলাকে জনগণ ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনায় নিয়েছে। গণতান্ত্রিক বিশ্বের কর্মকর্তাদের ঘন ঘন আগমন বাংলাদেশের মানুষ বর্তমান প্রেক্ষাপটের কারণে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছে। তাদের ভূমিকা এ দেশের মানুষের স্বার্থের অনুকূলে বলে মানুষ মনে করে।

বিশেষ করে দেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা আবেগ অনুভূতি সেটা ধারণ করে শ্রদ্ধা জানিয়েই পশ্চিমের পদক্ষেপ দেশের মানুষকে এখন উদ্বেলিত করছে। তা ছাড়া বাংলাদেশের সংবিধান গণতন্ত্র মানবাধিকারের বিষয়গুলোকে জাতীয় লক্ষ্য হিসাবে ঘোষণা করেছে। এসব বিষয়ও পশ্চিমের গণতান্ত্রিক দেশগুলো একে শ্রদ্ধার চোখে দেখেই তাদের ভূমিকাকে স্পষ্টতর করেছে।

অন্য দিকে রুশ-চীনের আগ্রহ অন্যত্র। তারা কেবল তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থটা ষোলআনা বুঝে নিতে চায়। জনগণ তাদের এসব ব্যাপারে সম্যক ওয়াকিবহাল। তাই সরকারের এসব মিত্রদের পক্ষে দৌড়ঝাঁপ করা সমস্যার ব্যাপার। তা ছাড়া তারা এ-ও জানে সরকারের জনভিত্তি নিতান্ত দুর্বল। এমন প্রশাসনের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ হওয়া ভবিষ্যতের জন্য সুখকর না-ও হতে পারে। তা ছাড়া ভবিষ্যতে যদি এখানে পালাবদল ঘটেই যায়, সে ক্ষেত্রে নতুন প্রশাসনের সাথে তাদের কাজ করা, দেন-দরবার চালানো অনেকটা কঠিন ও অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে। তাতে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ বিঘিœত হওয়া স্বাভাবিক। এই বিষয়গুলো তাদের মাথায় অবশ্যই আছে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন প্রশাসন ও গুটি কতক মানুষের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থকেই তারা প্রাধান্য দেবে- এটাই স্বাভাবিক। এ জন্য মাঝেমধ্যে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে মুখরক্ষা করছে তারা। আর বৃহত্তর ভূ-রাজনীতির একটা বিষয়ও আছে।

এটাই সঠিক রুশ-চীনের কর্তৃপক্ষ এ দেশে ক্ষমতাসীনদের অবস্থান সংহত ও দীর্ঘায়ু করতে চায়। পশ্চিমের দূতদের এমন দ্রুত আনাগোনা তাদের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। এ দেশে রুশ-চীনে যেসব ব্যক্তি পায়রবি করে, সেই মানুষগুলোও রুশ-চীনের মতো পশ্চিমের ভূমিকা পালন নিয়ে ক্ষুব্ধ। তবে এমন প্রমাণও আছে, রুশ-চীনও এখানে একেবারে অলস সময় ব্যয় করছে না বা স্থির-স্থবির নয়।

পিকিং-মস্কোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সময় সুযোগে বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছে। সর্বোপরি জনগণ যেহেতু রুশ-চীনের বর্তমান ভূমিকাকে মন্দ চোখে দেখছে। সে জন্য নেপথ্য থেকে বেরিয়ে এসে ক্ষমতাসীনদের অনুকূলে কিছু বলা- ভূমিকা রাখাটা সহজ হচ্ছে না। বিধায় তাদের পক্ষে আর কিছু করা এই মহূর্তে সম্ভব নয়। তাদের অনুরক্তরা বিষয়টি হয়তো বুঝতে সক্ষম হচ্ছে না বলে অসহায় বোধ করছে।

প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাসীন প্রশাসনই পশ্চিম-পুব বলয়ের কূটনীতিকদের সক্রিয় করে তুলেছে। এখন তাদের হাতেই এমন মন্ত্র রয়েছে, সেই কূটনীতিকদের সব কিছু থেকে বিরত রাখার। যদি সত্যই দেশ ও দেশের কল্যাণের প্রশ্নে ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষ আন্তরিক হতে পারে তবে সব কিছুই নিষ্পত্তি হওয়া মুহূর্তের ব্যাপার। সরকার যদি তার প্রতিপক্ষের সাথে পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে সংলাপে বসে ইতিবাচক মন-মানসিকতাসহ প্রতিপক্ষের যৌক্তিক ও সার্বজনীন দাবিগুলোর নিষ্পত্তি করতে রাজি হয় তাহলেই সমাধান হয়ে যায়।

যেমন নির্বাচনের প্রশ্ন। সেটি মেনে নিলেই সব গোলোযোগ মিটে যাবে। সরকার অনেক দিন থেকে স্পষ্ট করে বলছে, তারা সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। বিরোধী পক্ষও তাই চায়। যদি তাই হয় তবে তাদের ক্ষমতা অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক বা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে। এই প্রশ্নে সরকারের প্রতিপক্ষের সাথে তাদের দ্রুত আলোচনায় বসার প্রস্তুতি নেয়া উচিত হবে। কিন্তু সরকারের বক্তব্য বিবৃতি ও দেহ ভঙ্গিমায় কিন্তু তাদের সুষ্ঠু নির্বাচন করানোর কোনো সদিচ্ছার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং ১৫ বছরের পর আরো বেশি সময় ক্ষমতার লক্ষ্যে স্থির সিদ্ধান্তে তারা থাকতে চায়। অর্থাৎ দেড় দশকের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার পরও তাদের আহলাদ মেটেনি।

কিন্তু গত ১৫ বছর ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় থাকা বর্তমান শাসক দল জাতিকে কি উপহার দিয়েছে, সেটি দেখা যেতে পারে। তারপর সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে, তাদের বাসনা কতটা যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য। বেশ কিছুকাল আগে এই সরকারের পক্ষ থেকে জনগণকে প্রবোধ দিয়ে আসা হচ্ছিল ২০২৪ সালের মধ্যে দেশ মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। এখন ২০২৪ সালে পৌঁছতে আর মাত্র পাঁচ মাস বাকি। এ পর্যন্ত দেশ সেই লক্ষ্যে কতটা পৌঁছতে পেরেছে? মাত্র কিছু দিন আগে সরকারের মন্ত্রি সভার একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী গর্বভরে জানালেন, আমরা এখন এলডিসিতে এসে পৌঁছেছি। অর্থাৎ এখন মাত্র স্বল্প উন্নত দেশের সীমান্তে এসে পৌঁছানো গেছে। কোথায় মধ্য আয়ের দেশ আর কোথায় এলডিসি! ফারাক যোজন যোজন মাইলের। এমন কচ্ছপ গতিতে অগ্রসর হলে দেশকে এই সরকারকে আরো ৫০ বছর ক্ষমতায় থাকতে দিতে হবে।

আসলে বর্তমান সরকারের এই মুহূর্তের কার্যক্রম যদি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। তবে দেখা যাবে তারা নিছক কথা মালাই সাজাতে পারেন, অন্য কিছু নয়। তাদের প্রতিপক্ষের কোনো কর্মসূচি বা লক্ষ্য নিয়ে হাসিঠাট্টা করা বা পাল্টা কিছু বলার মধ্যে দিয়ে নিজেদের খুব স্মার্ট হিসেবে জাহির করতে এই কর্তৃপক্ষ পারঙ্গম- এটা অস্বীকার করা যাবে না।

বিএনপির পক্ষ থেকে যখন রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়, ঠিক তখন তারা পাল্টা ঘোষণা দিলেন ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা। অথচ সেই কর্মসূচির কোনো সুচিন্তিত দলিল জাতির কাছে কখনোই পেশ করা হয়নি। জাতি জানল না, ডিজিটাল বাংলাদেশ আসলে কোন পদার্থ। এমনকি আওয়ামী লীগের নেতাদের পক্ষেও হয়তো সে সম্পর্কে বেশি কিছু বলা বা ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব বলে মনে হয় না। অবশ্যই এর ব্যাখ্যা অগ্রসর মানুষের কাছে থাকতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষ এ নিয়ে কি উপলব্ধি করবে? এরপর হঠাৎ করেই আবার স্মার্ট বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে গোলক ধাঁধা সৃষ্টি করা হলো। ডিজিটাল বাংলাদেশের বিষয়টি একটা পরিণতিতে পৌঁছার আগেই নতুন তত্তে¡র আমদানি হলো ।
আবারো একটু পেছনে ফেরা যেতে পারে।

বলা বাহুল্য পক্ষ শক্তির কাছে বলা হয়েছে, আমরা একটা ভালো নির্বাচন চাই। কিন্তু তার জন্য কি কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে? না, সেটি নেয়া হয়নি বরং এমন পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে যা কি না সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। সে বিষয়টি হচ্ছে বিরোধী দলের ঘোরতর আপত্তি ও কঠোর সমালোচনা উপেক্ষা করে জাতীয় সংসদে ‘রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপলস অ্যাক্ট ২০২৩ বা গণ প্রতিনিধিত্ব আইন (সংশোধনী) বিল-২০২৩ পাস হয়েছে। এতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ভোটের আগেই (গোলযোগে আশঙ্কা থাকলে) নির্বাচন স্থগিত করার ক্ষমতা ইসির ছিল- সেটি সরকার কেড়ে নিলো গৃহীত আইনের মাধ্যমে। তাহলে একে কি বলা যাবে ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ? দেশের সংবিধান ইসিকে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন করার যথেষ্ট ক্ষমতা দান করেছে। কিন্তু এই নয়া সংশোধনীর কারণে ইসির পক্ষে মানসম্পন্ন নির্বাচন করা যদি সম্ভব না হয়। অর্থাৎ ক্ষমতা খর্ব করার জন্য ইসির ভূমিকা পালন করতে কোনো ব্যত্যয় বা সমস্যা হয়, তবে সেটি কি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হবে না? তা ছাড়া সরকার নির্বাচন সামনে রেখে প্রশাসনকে যেভাবে বিন্যাস করছে, সেটি কি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না? নির্বাচনকালে এসব দলান্ধ কর্মকর্তারা ক্ষমতাসীনদের পক্ষে ভূমিকা রাখবে না? তাহলে তাদের সুষ্ঠু ভোট করার যে প্রতিশ্রুতি কি তারাই তছনছ করছে না? এক দিকে তারা ভালো নির্বাচন চায়, আবার সেই নির্বাচন হতে হবে তাদেরই অধীনে। বিগত দুই নির্বাচন তাদের অধীনেই হয়েছে, সে নির্বাচন দু’টি কি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে?

ndigantababar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement