৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বাংলাদেশ কী এক স্নায়ুযুদ্ধের মুখোমুখি হচ্ছে

লেখক সালাহউদ্দিন বাবর। - ছবি : নয়া দিগন্ত

দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন নিয়ে এখন নানা কথা হচ্ছে। এটি স্বাভাবিক। কেননা, নির্বাচনের সময় খুব দূরে নয়। আর একটি কথা এখানে যোগ করা যেতে পারে, গত দুই সংসদের নির্বাচন নিয়ে হাজারো কথা ও শত প্রশ্ন রয়েছে। তাই আসন্ন নির্বাচনের রূপ স্বরূপ নিয়ে মানুষের মন-মগজে ক্ষণেক্ষণে আশার আলো-ছায়ার খেলা চলছে। এমন খেলার প্রধান পক্ষ অবশ্যই ক্ষমতাসীন শক্তি ও তাদের প্রতিপক্ষ। প্রতিপক্ষ আন্দোলন করছে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারসহ আর সব ধ্বংস করে দেয়া চাওয়া-পাওয়া ও অধিকারগুলো যথাস্থানে পুনঃস্থাপনের জন্য। এ সংক্রান্ত যাবতীয় অধিকারসংক্রান্ত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হলে প্রতিপক্ষ শক্তিগুলো মনে করছে পক্ষশক্তির বিকল্প অনুসন্ধান একান্ত অপরিহার্য।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরাও বসে নেই তার কৌশল, অপকৌশল সব কিছুই তাদের বিবেচনায় থাকছে এবং কার্যক্রমে অনুসৃত হচ্ছে। যেমন তাদের আয়ত্তে যা কিছু আছে সবই তারা করছে পরবর্তী নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসার জন্য। ইতোমধ্যে যে বিষয়টি হয়তো তাদের কাছে প্রথম ও সর্বোচ্চ প্রাধান্য পাচ্ছে, তা হলো এখনই প্রশাসনকে নিজেদের অনুক‚লে বিন্যস্ত করে নেয়া। সবাই অবহিত যে, সরকার বেশ কিছু উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তার চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি করছে। উপর থেকে জেলাপর্যায় পর্যন্ত প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে তাদের বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত অফিসারদের পদায়ন করছে। তারা আন্তর্জাতিক বলয়ে পশ্চিমের এক্সিস থেকে সরে এসে ভারত চীন-রুশ বলয়ে পাকাপোক্তভাবে আসন গেড়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এসব পদক্ষেপ তাদের কতটা শেষ রক্ষা করতে সক্ষম হবে। সবাই জানেন, বিরোধী দল বলতে প্রায় সব প্রতিপক্ষ শক্তি এখন এটি অনুভব করছে এবং ক্ষমতাসীনদের সব প্রস্তুতির খবর অবশ্যই তাদের লক্ষ্যসীমায় রয়েছে। তারা (ক্ষমতাসীনরা) বস্তুত বিনাযুদ্ধেই প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সে লক্ষ্যেই এখন দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। সবাইকে আরো মনে রাখতে হবে, ক্ষমতাসীনরা যে নতুন আন্তর্জাতিক বলয়ে নাম লিখিয়েছে সেই নতুন বলয় থেকে অত্যন্ত খোলামেলা ও স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে, তারা বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন শক্তির অবস্থানকে সঠিক বলে মনে করে। শুধু মনে করে না সেজন্য সব প্রকার সহযোগিতা দেবে ক্ষমতাসীনদের স্বঅবস্থানে টিকে থাকার জন্য। আসলে সব মিলিয়ে এসব অগ্রগতি শুধু সরকারের প্রতিপক্ষের জন্য দুঃসংবাদ নয়; দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্যও সেটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। কেননা, যে কারণে দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতির ইতিবাচক উন্নতি ঘটার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না; বরং সামগ্রিক পরিস্থিতির অবনতি অনিবার্য হবে। এর প্রধান দুই কারণ হচ্ছে- প্রথমত, এই অক্ষম প্রশাসনের পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনাই আর হয়তো থাকবে না। দ্বিতীয়ত, সরকার যে নতুন বলয়ে প্রবেশ করছে তাদেরও কোনো সক্ষমতা এমন নেই যে, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে যে অর্থনৈতিক সঙ্কট চলছে তা থেকে উত্তরণের জন্য দুই পয়সা দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করবে।

অথচ পশ্চিম বলয়ের যেসব শক্তিকে বর্তমান সরকার বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে তাদের ঋণ অনুদান নিয়েই বাংলাদেশ এখনো চলছে। আরো ভয়ের বিষয়, বাংলাদেশের মাথায় এখন বিপুল ঋণভার। যেকোনো মুহূর্তে সেই ভারে দেশ অতল সায়রে ডুবতে পারে। সরকার প্রকৃতপক্ষে এই মুহূর্তে সব রকম অর্থনৈতিক সক্ষমতা হারিয়েছে। তাদের ঘাড় ঘুরানো এতটুকু স্পেস সম্ভবত এখন আর নেই। সরকারের নতুন বন্ধুদের পক্ষে এখানে কোনো ভূমিকা রাখার সক্ষমতা যে নেই, সে কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ কোনো আর্থিক সহায়তা নিয়ে তাদের পক্ষে এগিয়ে আসা সম্ভব হবে না। উপরন্তু তাদের দেয়া ঋণের যে সুদ সেটিই পাওয়ার জন্য রুশদের প্রবল চাপ রয়েছে। অনেক সময় খড়কুটো ধরেও মানুষ বাঁচতে চায়। ক্ষমতাসীন মহল এখন সেই খড়কুটো ধরেই যেন ভেসে থাকতে চাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এই সিদ্ধান্তেই এখন তারা পৌঁছেছে যে, জনগণের প্রতি তাদের যেহেতু তেমন কোনো প্রতিশ্রুতি নেই তাদের ওপর ভরসা করা দরকারও নেই। অতীতে জনগণকে দূরে রেখে ভোটের নামে যে সব কীর্তিকলাপ করা হয়েছে, এখন সামনেও লোক দেখানো বা লোক হাসানোর মতো হলেও তেমনি কিছু করে পগার পার হওয়ার চেষ্টায় তারা সংকল্পবদ্ধ। তা ছাড়া তাদের ‘তিন মুরব্বি’ বলা হোক বা সুহৃদ বলা হোক; তারা সরকারকে খোলা চেক দিয়ে দিয়েছে। ক্ষমতাসীনরা যেকোনো অবস্থান নিক, তিন সুহৃদ তাদের নেত্র বন্ধ রেখে তাদের সাথেই থাকবে। জনঅভিপ্রায়কে দুই সুহৃদ নিজেদের দেশেই তোয়াক্কা করে না। ভিন্ন দেশে এসব ভেবে তাদের ‘মূল্যবান সময়’ নষ্ট করতে এতটুকু আগ্রহী হওয়ার কথা নয়।
অথচ বিএনপিসহ সরকারের অপর সব প্রতিপক্ষ কিন্তু আম মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ধরনা দিয়েই চলেছে।
জনসমাবেশ করে গণতন্ত্রসহ আর সব হৃত বিষয় বা অধিকার আদায়ের জন্য সহযোগিতা কামনা করছে।
বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সমর্থনদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পশ্চিমের গণতান্ত্রিক শক্তি তাদের আদর্শগত অবস্থান থেকেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনরত উপরোল্লিখিত শক্তিগুলোকে নৈতিক ও পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এখানে পশ্চিমের শক্তির নৈতিক অবস্থানের বিষয়টি আরেকটু গভীরভাবে চিন্তা করলে ভিন্ন একটি বিষয় পরিষ্কার হবে। সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের পর থেকে বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত যেসব দেশ রয়েছে, সেসব দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি এখন অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এসব অঞ্চলের শাসকগোষ্ঠীর, যারা গণতন্ত্রের ‘গ’ ও মানবাধিকারে ‘ম’ বলতে কিছু বোঝে না, তাদের প্রতি রুশ-চীন বলয়ের আশীর্বাদ শুভেচ্ছা পুরোপুরি বহাল রয়েছে। এই সম্মিলিত শক্তির প্রভাব মিয়ানমার পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এখন তাদের লক্ষ্য বাংলাদেশের দিকে কি-না সেটাই বড় প্রশ্ন। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক শক্তি এখন কোন অবস্থানে থাকবে, তারই পরিষ্কার আভাস ইঙ্গিত কিন্তু উপরে দেয়া হয়েছে।

আবারো ফিরে আসি পশ্চিমের গণতান্ত্রিক শক্তি ও রুশ-চীনের বাংলাদেশ নিয়ে তাদের ভিন্ন অবস্থান প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের জনগণ সবসময় গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে তাদের ‘লাইফস্টাইল’-এর সাথে একীভূত করে নিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ও তারও আগে থেকে এ দেশের মানুষ এসব প্রশ্ন নিয়ে সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। তাই পশ্চিমের সাম্প্রতিক ভূমিকাকে তারা ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। অন্যদিক রুশ-চীন বলয়কে কখনোই তারা তাদের সুহৃদ শুভাকাক্সক্ষী বলে মনে করে না। তাই এই দুই বলয়ের শক্তিকে এক পাল্লায় তোলা কোনোক্রমেই যৌক্তিক নয়। আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। সেটা হলো, বর্তমান প্রশাসন রুশ-চীন এই দুই দেশকে অযৌক্তিকভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে একান্তই স্বীয় স্বার্থে। বাংলাদেশকে এখন হয়তো একটা দীর্ঘ স্নায়ুযুদ্ধের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। দেশের স্বার্থ না দেখে গোষ্ঠী স্বার্থের প্রাধান্য দেয়ার বিষয়টি কোনো বিবেচনাতেই অনুমোদন দেয়া জনগণের পক্ষে সম্ভব নয়। সম্ভবত এসব কারণেই জনগণ ক্ষমতাসীনদের ব্যাপারে সন্দিহান।

ইতোমধ্যে ক‚টনীতিক মহল কিন্তু উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অগ্রগতি লক্ষ করে। পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশ থেকে শুধু আমদানিই করে। বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে তৈরী পোশাক তারা সবচেয়ে বেশি আমদানি করে থাকে। যার পরিমাণ বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের ৮৫ শতাংশের বেশি। অথচ চীন শুধু বাংলাদেশে পণ্য রফতানি করে এবং সে দেশটি বাংলাদেশের পণ্য আমদানির সবচেয়ে বড় উৎস হয়ে উঠেছে। আবার অতি মূল্যের অধিকাংশ মেগা প্রকল্পের ঠিকাদারি চীনা কোম্পানিগুলো পাচ্ছে। সে প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল মুনাফা এখান থেকে তুলে নিচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে চীন তার অর্থনৈতিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকে শর্তহীনভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমের শক্তি যদি বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থানকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে; কেবল মাত্র দুটো ক্ষেত্রে তাদের বর্তমান অবস্থানকে পুনর্মূল্যায়ন করতে চায় এবং অন্য পন্থা অবলম্বন করে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে পরিস্থিতির উদ্ভব হবে সেটা সামাল দেয়ার কোনো সক্ষমতাই সরকারের নেই। বস্তুত এসব অগ্রগতি ভয়াবহ এক সঙ্কট দেশকে কাঁপিয়ে তুলতে পারে। তাই আমাদের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়াই সমীচীন।

সবাইকে এ কথা মনে রাখতে হবে কেউই সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়। দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতার চর্চা কী যথেষ্ট নয়। তার পরও যদি কারো ক্ষমতা চর্চার অভিলাষ পূরণ না হয় তবে জনগণের কাছে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ম্যানডেট গ্রহণ করা যেতে পারে। যদি জনগণ তাদের অতীতের কার্যক্রমকে ইতিবাচক বলে মনে করে তাদের হাসিমুখে বরণ করে নেয় তবে কারোই ‘বেজার’ হবার কোনো অবকাশ থাকে না। এ দেশ বড় গরিবের দেশ, একে নিয়ে কারোই ছলাকলা করার সুযোগ আছে কি না নিজেদের বিবেককে একবার প্রশ্ন করে দেখুন। কী জবাব আসে।

ndigantababar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement