২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


অবিশ্বাস অসম্মান অমর্যাদার রাজনীতি

লেখক গোলাম মাওলা রনি। - ছবি : নয়া দিগন্ত

রাজনীতিবিদ কিংবা রাষ্ট্রনায়কদের আলোচনা উঠলেই আমার কেন জানি সবার আগে হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা:-এর নাম মনে আসে। বাদশাহ হারুন আল রশিদ, সুলতান সুলেমান, সম্রাট আওরঙ্গজেব এবং সুলতান ইলতুৎমিসের নামের সাথে বাংলার হর্ষবর্ধন, শশাঙ্ক, মহীপাল, গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ, আলাউদ্দিন হোসেন শাহ, শায়েস্তা খাঁ, আলীবর্দী খাঁ, মুর্শিদ কুলি খাঁসহ রাজা বল্লান সেন এবং লক্ষণ সেনের কথা মনে এসে যায়।

উল্লিখিত নামগুলোর সাথে সম্রাট দারায়ুস, সম্রাট সাইরাস, সম্রাট সারগন, সম্রাট নেবুচাড নেজার, সুলতান সালাউদ্দিন আইউবী, সুর সম্রাট তৃতীয় আব্দুর রহমান, রাজা হাম্বরাবী, ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিস, ফেরাউন তৃতীয় আমেন হোতেপ, ফেরাউন আখের নাকেনের নাম মনের অজান্তে মস্তিষ্কে চলে আসে। রোমান সম্রাট জাস্টিনিয়ান, জুলিয়াস সিজার, মার্কাস অরলিয়াস, ফ্রান্সের সম্রাট সালিমেন, নেপোলিয়ন বোনাপার্টসহ প্রাচীন দুনিয়ার আলেকজান্ডার, হানিবল, হামিলকার এবং চীনের শি হুয়ান টির কথা লিখতে গেলে বলতে গেলে এক ধরনের সম্মানবোধ মর্যাদাবোধ এবং ভালোলাগা ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার অনুভূতি পয়দা হয়ে যায়।

আপনি যদি রাজনীতির নাম শুনলে বমি করে দিতে চান তবে অতীতের কুখ্যাত কারো নাম স্মরণ করলে চলবে না, ইতিহাসের জঘন্য আমির-ওমরাহ, রাজা-বাদশাহরা কিয়ামত পর্যন্ত জমিনের অভিশাপ কুড়াতে থাকে এবং মানুষের তুচ্ছতাচ্ছিল্য গালাগালের উপলক্ষ হয়ে জীবন্ত প্রেতাত্মারূপে সমাজ সংসারে ভাসতে থাকে। কিন্তু তার পরও তাদের নাম শুনলে ছবি দেখলে সাধারণত গা রি রি করে ওঠে না। হিটলার, মুসোলিনী, চেঙ্গিস, হালাকুর নাম আমরা অশ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ করি- তাদের নাম ধরে বর্তমান জমানার কাউকে গালাগাল করি বটে কিন্তু তাদের জীবন্ত পোর্ট্রেটরূপে যারা আমাদের সামনে ঘুরে বেড়ায়, কথা বলে, চোখ রাঙায়, আঙ্গুল উঁচু করে দম্ভ করে অথবা রঙ্গতামাশা করে তাদের দেখলে যে আতঙ্ক, ভয়, অবিশ্বাস, অশ্রদ্ধা, ঘৃণা মনের মধ্যে টগবগিয়ে ফুটতে থাকে তার সাথে অন্য কোনো কিছুর তুলনা চলে না।

আজকের নিবন্ধটি যেন জটিল হয়ে না পড়ে এ জন্য শিরোনাম প্রসঙ্গে কী বলতে চাই তার একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা পেশ করে তারপর মূল আলোচনায় প্রবেশ করব। রাজনীতির মাধ্যমে যেমন সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্মান ও মর্যাদা অর্জন করা সম্ভব তেমনি রাজনীতি নামে অপরাজনীতির হোতারা কিভাবে অসম্মান ও অমর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠেন তার কিছু বাস্তব চরিত্রের নাম-ধাম উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। আজকের নিবন্ধে অবশ্য সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা না করে বরং ক্ষমতার চেয়ারে বসে কেন মানুষ হঠাৎ পরিবর্তিত হয়ে যায়- কেন নিষ্ঠুর হওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু করে এবং কেন নিজেদের হিরক রাজার মতো হাস্যকর প্রাণী, হাল্লা রাজার মতো নিষ্ঠুর অথবা রাক্ষসরাজ রাবণের মতো প্রলয়ঙ্করী হয়ে ওঠেন তার কার্যকারণ বর্ণনা করব। কিন্তু তার আগে আপনাদের কাছে দু’টি ঐতিহাসিক কাহিনী বর্ণনা করে নিই।

প্রথম কাহিনীটি সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালিকের। উমাইয়া খলিফা ওলিদের মৃত্যুর পর তার ছোট ভাই সুলায়মান দামেস্কের সিংহাসনে বসেন। সুলায়মানের জমানায় মুসলিম দুনিয়ার যে বিস্তৃতি এবং যেভাবে একক কর্তৃত্বে পুরো সাম্রাজ্য চলছিল তা ইতঃপূর্বে অথবা পরবর্তীতে অন্য কোনো মুসলিম শাসকের জমানায় ঘটেনি। পুরো মধ্যপ্রাচ্য, পুরো উত্তর আফ্রিকা, স্পেনসহ ফ্রান্সের বিরাট অংশ, ভারতের সিন্ধু-মুলতানসহ বিশাল এলাকা, সাইপ্রাসসহ মধ্য এশিয়ার কিয়দংশ মুসলিম সাম্র্রাজ্যের অধীন ছিল। উমাইয়াদের পতনের পর আব্বাসীয় খিলাফতের জৌলুশ ছড়িয়ে পড়ে বটে তবে তারা খলিফা ওলিদ অথবা সুলায়মানের সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির ধারেকাছেও যেতে পারেনি। আব্বাসীয় শাসনের শুরুতেই স্পেন ও সিন্ধু তাদের হাতছাড়া হয়। পরে ফাতেমী বংশ প্রতিষ্ঠিত হলে মিসরকেন্দ্রিক উত্তর আফ্রিকা ও হেজাজের বিশাল এলাকা ফাতেমীদের অধীনে চলে যায়।

খলিফা সুলায়মান যখন ক্ষমতায় বসেন তখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনী বৃহৎ রাজভাণ্ডার এবং সবচেয়ে জৌলুশপূর্ণ শহর বন্দর নগরী তার অধীন ছিল। তিনি বয়সে ছিলেন নবীন এবং চরিত্রে বহু মন্দ বিষয় মজ্জাগত হয়ে পড়েছিল। কাম-ক্রোধ এবং ঈর্ষা তাকে রীতিমতো দানবে পরিণত করে ফেলে। তিনি সাম্রাজ্যের নামকরা সেনাপতি, আমির ওমরাহকে হত্যা, কারারুদ্ধ, গুম অথবা নির্বাসন দিতে থাকেন কেবলমাত্র সন্দেহ অবিশ্বাস অথবা অতীতকালে তার প্রতি পর্যাপ্ত শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন না করার কারণে। তিনি সিন্ধু বিজয়ী মুহাম্মদ বিন কাসেমকে হত্যা করেন। উত্তর আফ্রিকা বিজয়ী মুসা বিন নুসায়ের এবং স্পেন বিজয়ী তারেক বিন জিয়াদকে পদচ্যুত ও বন্দী করে কারারুদ্ধ করেন। তার স্বল্প সময়ের অর্থাৎ দুই বছরের শাসনামলে উমাইয়া খিলাফতের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায় এবং মুসলমানদের অগ্রযাত্রা বন্ধ হয়ে যায়।

খলিফা সুলায়মানের পর যে কাহিনীটি বলব তার নায়ক হলেন খলিফা ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ যিনি ইতিহাসে খলিফা দ্বিতীয় ওমর হিসেবে সমধিক সম্মানীত। তিনি মাত্র চার বছর শাসক হিসেবে যে ইতিহাস তৈরি করেছেন অমন ইতিহাস মানবজাতির ইতিহাস অন্য কোনো শাসক সৃষ্টি করতে পারেননি। তিনি বয়সে তার পূর্বসূরি খলিফা এবং চাচাত ভাই সুলায়মানের চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট ছিলেন এবং যখন তিনি মারা যান তখন তার বয়স মাত্র ৩৯ বছর।

খলিফা ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ তার স্বল্পকালীন শাসনামলে এমন সব ন্যায়বিচারের নজির স্থাপন করেন যার ফলে খুলাফায়ে রাশেদীনের জমানায় সৃষ্ট সমস্যা থেকে শুরু করে তার পূর্বসূরিদের সৃষ্ট সব সমস্যার সফল সমাধান হয়ে যায়। যুদ্ধ বিগ্রহ, দ্বন্দ্ব ফাসাদ বন্ধ হয়ে যায় এবং তার শাসিত সাম্রাজ্যে সর্বোচ্চ শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের সাথে সাথে তিনি তার যাবতীয় সম্পত্তি রাজকোষে জমা দেন এবং তার স্ত্রী যিনি ছিলেন খলিফা আব্দুল মালিকের কন্যা এবং তৎকালীন দুনিয়ার সম্ভবত সেরা ধনাঢ্য মহিলা তিনিও স্বামীর নির্দেশে সব সম্পত্তি পরিত্যাগ করে রাজকোষে জমা রাখেন। ফলে হজরত ওমর ইবনুল আব্দুল আজিজ এবং তার স্ত্রীর জীবনযাত্রা ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমরের মতো হয়ে যায়।

ইতিহাস থেকে আমি যে দুটো কাহিনী বর্ণনা করলাম তার সাথে আজকের নিবন্ধের কী সম্পর্ক তা বর্ণনা করে শিরোনাম প্রসঙ্গে আলোচনা করব। খলিফা সুলায়মানের মধ্যে এক ধরনের অবিশ্বাস ছিল। তার অশিক্ষা, কুশিক্ষার কারণে মানবীয় গুণাবলি রহিত হয়ে দানবীয় বৈশিষ্ট্যগুলো প্রবল হয়ে পড়েছিল। ফলে ক্ষমতার সিংহাসনে বসেও তার মনে হতো লোকজন হয়তো তাকে মানছে না সম্মান করছে না- বিশ্বাস করছে না। এ জন্য তিনি জুলুম নির্যাতনকে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেন এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে পূর্ব পুরুষদের দ্বারা সৃষ্ট পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেন।

খলিফা সুলায়মান তার সারাজীবনের মন্দ কাজের মধ্যে যদি একটি মাত্র ভালো কাজ করে থাকেন তবে সেটি হলো জীবন সায়াহ্নে তার অনুভ‚তি। অনিয়ন্ত্রিত জীবন, স্বেচ্ছাচারিতা, মদ্যপান, চরিত্রহীনতা ইত্যাদি নানা কারণে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। মৃত্যুশয্যায় তিনি বারবার নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করেন এবং সবাইকে অবাক করে তিনি তার চাচাতো ভাই এবং ভগ্নিপতি ওমর ইবনে আব্দুল আজিজকে নিজের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। ফলে তার মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীর সুকর্মের কারণে তার নিজের কৃতকর্মসমূহ ঢাকা পড়ে যায়।

হজরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের ক্ষমতা লাভের পর তার অতি মাত্রায় উদারীকরণের ফলে রাষ্ট্রের লুটেরা-শ্রেণী বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে এবং ছলে বলে কৌশলে তাকে দুনিয়া থেকে সরানোর চক্রান্ত করতে থাকে এবং প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে খলিফার খাদ্যে বিষ প্রয়োগ করে তাকে হত্যা করা হয়।

আমরা উল্লিখিত ঐতিহাসিক ঘটনার আলোকে রাজনীতির অবিশ্বাস, অসম্মান ও অমর্যাদার কারণগুলো পর্যালোচনা করলে দেখতে পাব যে, ব্যক্তির অসততা, অশিক্ষা, চরিত্রহীনতা, ঈর্ষা, সন্দেহ ইত্যাদি কারণে এমন এক কলুষিত রাজনীতির সৃষ্টি হয় যেখানে রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে মানুষের ধারণা খুবই নেতিবাচক হয়ে থাকে। রাজনীতির শীর্ষ পর্যায় এবং ক্ষমতার মসনদে যখন মন্দ মানুষ থাকে তখন পৃথিবীর বৃহত্তম রাজভাণ্ডার এবং সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য তছনছ হয়ে যেতে পারে। অন্য দিকে ক্ষমতায় যদি ভালো মানুষের অভিষেক হয় তবে যেকোনো মন্দ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ হতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন পড়ে না।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement