২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


জটিল রাজনীতি অনির্ধারিত গন্তব্য

লেখক গোলাম মাওলা রনি। - ছবি : নয়া দিগন্ত

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সারা দেশে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। যারা আওয়ামী লীগ করেন তারা সবাই একবাক্যে প্রচার করছেন যে, তাদের নেত্রীর সাহস আছে বটে। সারা দুনিয়ার মানুষ যাদের ভয় পায় তাদের প্রতি শেখ হাসিনা যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন তা গত পঞ্চাশ বছরেও দুনিয়া দেখেনি। তিনি যেভাবে আমেরিকাকে ইঙ্গিত করে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ঘোষণা দিলেন যে, দেশের বিরুদ্ধে যারা নিষেধাজ্ঞা দেবে তাদের নিকট থেকে কিছুই কেনাকাটা করব না। তার বক্তব্য শোনার পর আওয়ামী লীগের লোকজন বলাবলি শুরু করেছেন যে, বুকের পাটা আছে বটে- এই না হলে কি বঙ্গবন্ধুর কন্যা! শেখের বেটি যা করেছেন, ভালোই করেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর উল্লিখিত বক্তব্যের অব্যবহিত পরের গরম খবর হলো, সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত ও সৌদি রাষ্ট্রদূতের পুলিশ এসকর্ট বাতিল করেছে। শোনা যাচ্ছে, রাষ্ট্রদূতদের গাড়িতে নিজ নিজ দেশের পতাকা ব্যবহার নিয়েও বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে। এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন যে তথ্য দিয়েছেন তা খুবই কৌত‚হল উদ্দীপক এবং যথেষ্ট আবেদনময়। তিনি বলেন, এত দিন ধরে কিছু রাষ্ট্রদূত নিরাপত্তার নামে যে বাড়তি ঢং করছিলেন তা বন্ধ হচ্ছে। তিনি আরো বলেন যে, দুনিয়ার কোথাও এমন ঢং নেই। যে রাষ্ট্রদূতরা সামনে পেছনে পুলিশ প্রটোকল নিয়ে ঢং করেন তাদের সেই ঢং দেখে অন্য রাষ্ট্রদূতরাও বাড়তি পুলিশ প্রটেকশন দাবি করছেন, যা সরকারের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়।

ড. মোমেন যে বিশেষ কায়দায় কথা বলেন ঠিক সেই একই কায়দায় তিনি আরো বলেন যে, আমেরিকাতে আমাদের মিশনগুলোতে মন্ত্রী পদমর্যাদার লোকজন দায়িত্ব পালন করেন। তারা সেখানে একজন পুলিশের এসকর্টও কল্পনা করতে পারেন না। তা ছাড়া বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলার অবস্থা এমন নয় যে, এখানে কাউকে পুলিশ প্রটেকশন নিয়ে চলতে হবে। আমি মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ প্রটোকল ছাড়া ঢাকা ও গ্রামগঞ্জে একাকী চলাফেরা করি। রাষ্ট্রদূতদের গাড়িতে পুলিশ প্রহরা থাকলে তা দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করবে।

পুলিশ প্রটেকশন সম্পর্কে ড. মোমেন আরো উল্লেখ করেন, রাষ্ট্রদূতদের প্রটেকশন দিতে অনেক অর্থ খরচ হয়। অথচ তারা ধনী রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও কোনো অর্থ দিতে নারাজ। চলমান আর্থিক সঙ্কট মোকাবেলায় আমরা সর্বত্র খরচাপাতি কমানোর চেষ্টা করছি। অন্য দিকে পদ্মা সেতু, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় বিনা প্রয়োজনে অর্থ ব্যয় করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে রাষ্ট্রদূতরা যদি নিজস্ব অর্থায়নে এসকর্ট ব্যবস্থা চালু রাখতে চান সে ক্ষেত্রে তারা আনসার ব্যাটালিয়ন ভাড়া করতে পারেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনের উল্লিখিত বক্তব্য দেশ-বিদেশে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছে। বিশেষত প্রধানমন্ত্রীর জাপান-আমেরিকা-যুক্তরাজ্য সফরের পরপরই যখন উল্লিখিত বক্তব্য চাউর হলো তখন সবাই বলাবলি করছেন যে, প্রধানমন্ত্রীর সুদীর্ঘকালের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং দেশ-বিদেশের বাঘা বাঘা সব প্রতিদ্ব›দ্বীর সাথে হাজারো বাতচিতের সফলতার আলোকে তিনি নিশ্চয়ই কল্পনাপ্রসূত অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক কথা বলবেন না। বিশেষত জাতীয় নির্বাচন যখন দরজায় কড়া নাড়ছে, সরকার যখন দেশী-বিদেশী নানা চাপে বিপর্যস্ত এবং দেশের অভ্যন্তরে যখন মানুষের অশান্তির দাবদাহ চরমে, ঠিক তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন সরাসরি আমেরিকার বিরুদ্ধে কথা বলবেন।

বিশ্লেষকদের মতে, প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই এমন কিছু জানেন যা আমরা জানি না। তিনি এমন কিছু মোকাবেলা করছেন অথবা এমন কিছু দেখছেন যা সাধারণ জনগণের পক্ষে আন্দাজ করা অসম্ভব। ক্ষমতার অন্তিম সময়ে প্রায় পনেরোটি দিন ব্যয় করে তিনি বিশাল রাজকীয় বহর নিয়ে জাপান গেলেন। তারপর অতি সাধারণ যাত্রীবেশে আমেরিকা ও লন্ডন সফর করলেন। আমেরিকায় থাকাকালীন এতটা আত্মবিশ্বাস দেখালেন, যাতে মনে হলো তিনি বিজয়িনী। যেভাবে তিনি মার্কিন মুলুকের রাজধানীর রিজ কার্লটন হোটেলের সামনে সরকারবিরোধীদের প্রতি দরদ দেখালেন এবং তাদের হোটেলের ভেতরে বসে আলোচনার আহ্বান জানালেন তা দেখে যেকোনো মানুষ বিশ্বাস করতে বাধ্য যে, তিনি আত্মবিশ্বাসের চূড়ান্ত চূড়ায় পৌঁছে গেছেন।

ওয়াশিংটন থেকে লন্ডনে পৌঁছে তিনি আরো বেপরোয়া হয়ে গেলেন। লন্ডনের একটি সভায় তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং তারেক রহমান সম্পর্কে নজিরবিহীন বিষোদগার করলেন। তারপর দেশে এসে বললেন, যারা নিষেধাজ্ঞা দেবে তাদের নিকট থেকে কোনো কেনাকাটা নয়। এরপর তিনি তার ঐতিহ্যবাহী সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করলেন এবং স্বভাবসুলভ ধারালো কথাবার্তা দ্বারা নিজ দলের লোকদের আস্থা জাগানো এবং প্রতিপক্ষের মনে ভয় ধরানোর পরিবেশ সৃষ্টি করলেন; এই ঘটনার পরপরই রাষ্ট্রদূতদের পুলিশি এসকর্ট বাতিল করলেন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন এবং ঢাকায় পুলিশ কমিশনারকে দিয়ে প্রয়োজনীয় বিবৃতি প্রদান করালেন।

এখন প্রশ্ন হলো, প্রধানমন্ত্রী কেন হঠাৎ এমনটি করলেন। অনেকে মনে করছেন যে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার নয়া চালান সম্পর্কে তিনি হয়তো কোনো আগাম তথ্য পেয়েছেন। অথবা পাকিস্তানের ইমরান খানকে সরানোর জন্য আমেরিকা যে কৌশল অবলম্বন করেছিল ঠিক একই কৌশল হয়তো আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে নেয়া হবে এমন আশঙ্কা থেকে তিনি হয়তো মার্কিনবিরোধী প্রচার এবং আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূতের পুলিশ এসকর্ট বাতিল করেছেন। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অ্যাকশন যাতে মার্কিন অ্যাকশনের চেয়ে অগ্রগামী হয় সে জন্যই তড়িঘড়ি করে সবকিছু করা হয়েছে। বিষয়টি যে পরিকল্পিত আমরা টের পেলাম প্রধানমন্ত্রীর একটি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। তিনি যখন লন্ডনে ছিলেন তখন বিবিসির সাথে একটি একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন যা প্রচারিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর এবং কাকতালীয়ভাবে উল্লিখিত ঘটনাবলির পর।

বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি আমেরিকাকে দায়ী করেছেন অথবা সন্দেহ করেছেন। আমেরিকা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ, দেশটি অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে চাচ্ছে না। বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে যে অভিযোগ করেছেন তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বেশ কিছুদিন আগে তিনি জাতীয় সংসদে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন যে, আমেরিকা চাইলে অনেক দেশের ক্ষমতা পরিবর্তন করতে পারে।

আপনি যদি উল্লিখিত ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করেন তবে একবাক্যে বলতে পারবেন যে, বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি জটিলতার চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। রাজনীতিতে যখন জটিল রসায়ন শুরু হয় তখন অনেক প্রাসাদ ষড়যন্ত্র অনিবার্য হয়ে ওঠে। দিনগুলোতে কোলাহলের পরিবর্তে নীরবতা ভর করে আর রাতের অন্ধকারগুলো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে আর্তচিৎকার হজম করার জন্য। দেশী-বিদেশী হাজারো চক্রান্ত শাসকদের অক্টোপাশের মতো চেপে ধরে। রাজনীতির বাতাস বিষাক্ত হয়ে পড়ে। ঘন কুয়াশায় চার দিক এমন দুর্বোধ্য পরিবেশের সৃষ্টি হয় যার ফলে মাত্র এক ফুট বা বারো ইঞ্চি দূরত্বে কী হচ্ছে তা বোঝা যায় না। ফলে রাজনীতি সংশ্লিষ্ট কেউই গন্তব্য নির্ধারণ করতে পারে না। এ অবস্থায় অনির্ধারিত গন্তব্যের পানে ছুটে চলা মানুষের মধ্যে যে ভয়-আতঙ্ক, অবিশ্বাস, হাহাকার ইত্যাদি লক্ষ করা যায় যেগুলো কোন কোন রাজনীতিবিদের মধ্যে প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে তা নির্ণয়ের ভার সম্মানিত পাঠকদের ওপর ছেড়ে দিলাম।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement