২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বিএনপির ভবিষ্যৎ কী?

লেখক গোলাম মাওলা রনি। - ছবি : নয়া দিগন্ত

ঘটনাটি কয়েক দিন আগের। একটি টেলিভিশনের টকশোতে অংশগ্রহণের জন্য সেখানে গিয়েছিলাম। সহ আলোচক ছিলেন দু’জন। একজন সাংবাদিক আর অন্যজন আওয়ামী লীগ নেতা। অন্য দিকে, যিনি উপস্থাপিকা তার আওয়ামী লীগ প্রীতি যেকোনো কট্টর আওয়ামী লীগের কর্মীর চেয়ে বেশি। অনুষ্ঠানপূর্ব আলোচনা চলছিল- আমি মশকরা করে বললাম- একটি অনুষ্ঠানে যদি চারজনই আওয়ামী লীগার হয় তবে আলোচনা কিভাবে জমাবেন? তারা হিসাব করে তিনজন আওয়ামী লীগারকে খুঁজে পেলেন অর্থাৎ উপস্থাপিকা, সাংবাদিক এবং আওয়ামী লীগ নেতা। কাজেই চতুর্থ ব্যক্তি কে? এমন প্রশ্ন করার আগেই বলে ফেললাম যে, আমিও তো সারা জীবন আওয়ামী লীগ করেছি এবং নির্বাচনের আগে হঠাৎ করে বিএনপিতে এসেছি। কাজেই তিনজন আওয়ামী লীগারের কাছে একজন নবীন বিএনপির আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কিইবা করার থাকবে?

আমার কথা শুনে উপস্থিত লোকজন হো হো করে হেসে উঠলেন। তাদের সাথে অনুষ্ঠানপূর্ব আলোচনায় যা বুঝলাম, তাতে মনে হলো তারা সবাই আওয়ামী লীগের শক্তিমত্তা ও শেখ হাসিনার অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ এবং আত্মবিশ্বাসী। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো কেন প্রধানমন্ত্রীর সামনে বারবার নতজানু হন এবং ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক কেন শেখ হাসিনার সামনে একান্ত অনুগত-বাধ্যগত এবং মুগ্ধ শিক্ষার্থীর মতো করে কাঁচুমাচু হয়ে বসেন তার ব্যাকরণগত অর্থ ব্যাখ্যা করে বাহারি সব তথ্য হাজির করে এ কথা প্রমাণের চেষ্টা করেন যে, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার সাথে তুলনীয় কোনো রাজনৈতিক দল অথবা ব্যক্তিত্ব ধরাধামে নেই।

টকশোপূর্ব অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় উল্লিখিত ব্যক্তিদের কথাবার্তা শুনে আমার মনে সর্বকালের অন্যতম সেরা ইংরেজ সাহিত্যিক জর্জ অরওয়েল রচিত অমর সাহিত্যকর্ম ‘১৯৮৪’-এর কথা মনে এলো। দ্বিতীয়ত, গত কয়েক মাসের মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের যে মানসিক বিবর্তন ঘটেছে তাও আমি আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম। আমার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পেশাগত দায়িত্বের কারণে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন সম্পর্কে এত দিনের যে ধারণা গড়ে উঠেছিল, তাও মারাত্মকভাবে ধাক্কা খেল সে দিনের তিনজন আওয়ামী লীগারের মনমানসিকতা দেখার পর। সুতরাং দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী বিশ্বাস-আওয়ামী হিম্মত ও আওয়ামী স্বপ্ন ও চেতনার যে নতুন ধারার অভ্যুদয় হয়েছে তার বিপরীতে বিএনপি তথা জাতীয়তাবাদী শক্তির করণীয় কী অথবা অনাগত দিনে বিএনপির পরিণতি কী হতে পারে সে চিন্তা আমাকে পেয়ে বসল।

আজকের শিরোনাম প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার আগে চলমান রাজনীতিতে যে বাস্তব পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা আবশ্যক। আওয়ামী লীগের গত এক যুগের চেষ্টা তদবিরের ফলে তাদের অবস্থা হয়েছে ক‚লহারা প্রবহমান নদীর মতো। বিষয়টি সহজ করার জন্য আমরা পদ্মা নদীর উদাহরণ দিতে পারি। ধরুন, আওয়ামী লীগ হলো প্রবহমান প্রমত্তা পদ্মা। নদীর যে চরিত্র সে মতে, পদ্মার একটি উৎসমূল যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে শেষ গন্তব্য অর্থাৎ পদ্মার স্রোত যেখানে গিয়ে সাগরে মিশেছে। আপনারা কমবেশি সবাই পদ্মা-গঙ্গা, যমুনা-সরস্বতী প্রভৃতি নদীর সৃষ্টি নিয়ে হিন্দু পুরাণের বিভিন্ন কল্পকাহিনী জানেন। হিন্দুদের দেবতা শিবের একাধিক স্ত্রী যারা আবার সবাই দেবী হিসেবে পূজিত। তারা কিভাবে একে অপরের অভিশাপে পদ্মা-গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী, ভাগিরথীতে পরিণত হয়েছেন তাও সাহিত্যের পাঠক কমবেশি জানেন।

তো গঙ্গা তথা পদ্মার সাথে যে দেবীর নাম জড়িত তিনি যদি হঠাৎ মনে করেন যে, নদীর যে তীরে তার বসতি সেটির বিপরীতে অন্য তীরে তার সতীনের বসবাস। সুতরাং সতীনের বাসস্থান ধ্বংসের জন্য পদ্মার দেবী যদি তার বিপরীত তীরে ক্রমাগত ভাঙন সৃষ্টি করেন তবে একটি সময় পদ্মা আর নদী থাকবে না- সেটি সাগরে বিলীন হয়ে নিজের অস্তিত্ব ও নামটি হারিয়ে ফেলবে।

পদ্মাকে নিয়ে যে রূপক উদাহরণটি পেশ করলাম- তা যদি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে তুলনা করি তবে দেখতে পাবো যে, তারা প্রতিদ্ব›দ্বী হটাও যা কি না পরবর্তীতে প্রতিদ্ব›দ্বী নির্মূলের পর্যায়ে চলে গেছে তা হালআমলে এসে আওয়ামী লীগকে তীরহারা বা ক‚লহারা পদ্মায় পরিণত করেছে। ফলে তারা নদীর এক পাড়ে বসে অপর তীরের অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছে না। এ অবস্থায় তারা কি নদী নাকি সাগর নাকি আত্মপরিচয় হারিয়ে সাগরে আত্মাহুতি দিয়েছে, তা নিয়ে রসঘন রাজনৈতিক আলাপ অপরিহার্য।

আওয়ামী লীগ নিয়ে রূপক আলোচনা বাদ দিয়ে এবার সরাসরি কিছু কথা বলি। বাংলাদেশে গত ১২ বছরে তারা যা করেছে তার মোদ্দা কথা হলো- সীমিত গণতন্ত্র- পছন্দের বাকস্বাধীনতা এবং প্রচার-প্রপাগান্ডার উন্নয়ন। অন্য দিকে দেশ জাতি তাদের যেসব কর্মকাণ্ড দ্বারা দীর্ঘমেয়াদে ভোগান্তি ও দুর্ভোগ-দুর্দশার শিকার হবে তা হলো- মানুষের নৈতিক মান তলানিতে ঠেকেছে। সত্য কথা, সত্য কর্ম, সুবিচার-সুশিক্ষা ইত্যাদি সমাজ সংসার থেকেই কেবল উঠে যায়নি- বরং বই পুস্তকেও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। চোর-বাটপাড়-ডাকাত-লুটেরাদের দাপট ইতিহাসের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। খুনি ও ধর্ষকরা এখন ধর্মোপদেশ দেয়- ডাকাতরা ধনসম্পদের রক্ষকরূপে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। তস্কররা ব্যবসা-বাণিজ্যের রূপক এবং মূর্খরা জ্ঞানী ব্যক্তিদের

বিচারক-শিক্ষক-রক্ষাকর্তারূপে বাহাদুরি প্রদর্শন করে যাচ্ছে। ফলে জাতিসঙ্ঘের এসডিজি অর্থাৎ সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল বলতে যা বুঝায় তার একটিও আমরা অর্জন করতে পারিনি।

আজকে সারা দুনিয়ায় ভোট চোর ভোট চুরি ভোট ডাকাতি রাতের ভোট নিয়ে যে সমালোচনা নিন্দা ঘৃণা ও প্রতিবাদের ঝড় বইছে তা আমি আমার ক্ষুদ্র জীবনে দেখিনি বা শুনিনি। আফ্রিকার বহু দেশের অসভ্যতা নিয়ে বহু গল্প কথা রয়েছে। কিন্তু ভোট চোর ভোট চুরি নামক শব্দ উচ্চারণ করলে আকাশের নিচে তামাম জমিনের বাসিন্দারা একবাক্যে সে দেশ বা সে ব্যক্তির নাম তোতাপাখির মতো গড়গড়িয়ে বলে দেয় তা শুনলে এখন আর আমাদের বমি আসে না, লজ্জা শরমের বালাই আমাদেরকে বিব্রত করে না; বরং ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের অনেকের মনে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি-অহমিকাবোধ পয়দা হয়ে যায়। ফলে আমাদের মানসিক বিবর্তনের বর্তমান হাল হকিকতের জন্য বিএনপি-জামায়াত নাকি অন্য কাউকে দায়ী করব তা চিন্তা করার শক্তি আমাদের কয়জনের অবশিষ্ট রয়েছে, তাও আমার কাছে স্পষ্ট নয়।

উল্লিখিত অবস্থায় জাতির সামনে আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের তোড়জোড় দৃশ্যমান হচ্ছে। রাজপথের মোনাফেক, পোশাকধারী বেহায়া, চর্ম নাই এমন নির্লজ্জ ভণ্ডদের দল এবং নানারকম তথাকথিত চেতনাবাজরা ১৭ কোটি বাংলাদেশীর শ্রম-ঘাম ও রক্তের দ্বারা অর্জিত অর্থের ওপর লালসার জিহ্বা বের করে যেভাবে বিএনপির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে হুঙ্কারের প্রস্তুতি শুরু করেছে তা সামাল দেয়ার জন্য বিএনপি কী করবে তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। কেউ বলছেন বিএনপি সর্বদা প্রকৃতিপ্রদত্ত সুযোগ পেয়ে ক্ষমতায় এসেছে। সুতরাং সারা দেশে গত একযুগে যা কিছু ঘটেছে তার প্রতিক্রিয়ায় মানুষ যেভাবে বিক্ষুব্ধ হয়েছে তাতে করে বিএনপির কিছুই করতে হবে না। সময় ও পরিস্থিতি তাদেরকে কাক্সিক্ষত মাকামে পৌঁছে দেবে।

বিএনপি সম্পর্কে যারা নেতিবাচক চিন্তা করেন তাদের বক্তব্য হলো, দলটি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। জাতীয় পার্টি ওয়ার্কার্স পার্টি জাসদ তরিকত ফেডারেশন, আটরশি হেফাজতের একাংশ চরমোনাই পীরের হাতপাখাসহ তৃণমূল আদিমূল মূল আসল প্রভৃতি বিএনপির লোকজন যেভাবে আওয়ামী লীগের দয়া করুণা সাহায্য ও সহযোগিতা নিয়ে নির্বাচন খেলায় শামিল হয়ে সংসদে যাওয়ার চেষ্টা করছে ঠিক একইভাবে তারেক রহমানকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে বিএনপি নামটি বিলীন হয়ে যাবে এবং সেই ধ্বংসস্ত‚পের ওপর যেসব আগাছা ও পরগাছা জন্ম নেবে তারাই আগামীর মধু নেয়ার ভাগীদার হবে।

বিএনপি বিরোধীদের সমালোচনা প্রপাগান্ডার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের বহুদিনের পুরনো দমননীতি, মামলা-হামলার পরাকাষ্ঠা নতুন উদ্যমে চালু করেছে। বিএনপি-জামায়াত ছাড়াও বিএনপি সমর্থক ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক প্রভৃতি শ্রেণী-পেশার লোকজন যেন সরকারের শেষ সময়ে কোনো বাধা সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। ফলে একটি অজানা আশঙ্কা সারা দেশের ওপর ভর করেছে। তার ওপর প্রকৃতির বিরূপ আচরণ বিশেষ করে ইতিহাসের রেকর্ড ব্রেক করা গরম, বৈশ্বিক মন্দা, বেকার সমস্যা, ডলার সঙ্কট ইত্যাদি সব কিছু মিলে একটি হযবরল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সুতরাং সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিএনপির ভবিষ্যৎ কী হতে পারে তা যদি বুঝতে চান তবে নিম্নের অংশটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন।

আপনি যদি বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের দিকে তাকান তবে দেখতে পাবেন তাদের মধ্যে কোনো উৎকণ্ঠা নেই; বরং সবাই এক ধরনের খোশ মেজাজে রয়েছেন। দলের শীর্ষ নেতারা বিশেষ করে তারেক রহমান এবং মির্জা ফখরুলের সাম্প্রতিক কথাবার্তা বিশ্লেষণ করলে বুঝতে পারবেন যে, তারা বেশ উৎফুল্ল, হাসিখুশি এবং আত্মবিশ্বাসী।

অন্য দিকে বেগম জিয়া এবং ড. ইউনূসের দিকে তাকালেও একই দৃশ্য দেখতে পাবেন। বিপরীতে আওয়ামী লীগের লোকজনের দিকে তাকান এবং তাদের হাসি, কান্না, চলাফেরা, পোশাক আশাক, আহার নিদ্রা, প্রেম-বিনোদন ইত্যাদি পর্যালোচনা করুন। দেখবেন একের সঙ্গে অন্যটি মিলছে না- সব কিছু আপনার কাছে বেখাপ্পা লাগবে। এরপর আপনি ধীরস্থিরভাবে চিন্তা করুন এবং বিএনপির ভবিষ্যৎ কল্পনা করুন। আপনি সহজেই বাংলাদেশের রাজনীতির ভাগ্যাকাশে গ্রহ-নক্ষত্রের লীলাখেলা এবং প্রকৃতির ইচ্ছা-অনিচ্ছা টের পেয়ে যাবেন আর এখন আপনার বোধ-বুদ্ধি অনুযায়ী বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে থাকুন।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement