০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সুদানের সেনা-মিলিশিয়া লড়াই এবং নেপথ্য সমীকরণ

সুদানের সেনা-মিলিশিয়া লড়াই এবং নেপথ্য সমীকরণ - ছবি : সংগ্রহ

সুদানের জনগণের জন্য সেনাবাহিনী ও মিলিশিয়া প্রধানের যুদ্ধ এখন একটি ট্র্যাজেডি। তাদের ক্রসফায়ারে অন্তত ৪০০ বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার। অদূর ভবিষ্যতে এই রক্ত ঝরা বন্ধ হবে এমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।

এই সঙ্কটের মূলে রয়েছে ২০২১ সালের অক্টোবরের একটি অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথ রুদ্ধ করার কারণ। যদিও এর আপাত কারণ হলো একজন অশিক্ষিত মিলিশিয়া প্রধানের ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে যাওয়া এবং সেনাবাহিনীর প্রধান হতে চাওয়া, যা বর্তমান সেনাপ্রধান কোনোভাবে চাইছেন না। আরো গভীরের কারণ হলো, আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদ ও শাসনব্যবস্থায় চীন-রাশিয়া বনাম পশ্চিমের নির্ণায়ক ভূমিকা গ্রহণের প্রতিযোগিতা। চীন-রাশিয়া সামরিক একনায়কদের ক্ষমতায় বহাল রাখতে চেয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা চেয়েছে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সুদান শাসিত হোক, যাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র হয়ে এটি চীন-নির্ভর একটি দেশে পরিণত না হয়।

প্রভাব বিস্তারের এই লড়াইয়ে দু'পক্ষের স্বার্থ রয়েছে। কিন্তু জনগণের স্বার্থটি হলো তারা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো একটি মুক্ত দেশের নাগরিক হবে, নাকি উত্তর কোরিয়ার মতো একটি একনায়ক শাসিত দেশে হতদরিদ্র হয়ে থাকবে। সুদানের মানুষ শেষেরটি বেছে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কায়েমি স্বার্থ আর ভাড়াটে সৈন্যের উৎস হিসেবে সুদানকে ব্যবহারের চিন্তা যাদের রয়েছে, তারা গোপনে দুই ক্ষমতাধর সেনা ও মিলিশিয়া প্রধানের দ্বন্দ্বকে উসকে দিয়েছে।

এই অস্থিতিশীরতার বিপদ আফ্রিকার একনায়কতান্ত্রিক শাসকের অবসানোত্তর সব দেশেই কম-বেশি হয়েছে। আফ্রিকার দীর্ঘতম শাসক নেতাদের একজন ওমর আল-বশিরকে ২০১৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত করার পর সুদানের অশান্তির উত্তরণে নতুন বিপদ যোগ করেছে। শক্তিশালী ব্যক্তির পতন, একটি বৈচিত্র্যময় এবং সুসংগঠিত প্রতিবাদ আন্দোলনের মাধ্যমে একটি টেকসই, শান্তিপূর্ণ প্রচারণায় আশা জেগেছিল যে দেশটি আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক, বেসামরিক-নেতৃত্বাধীন একটি শাসনে উত্তরণ ঘটাতে পারে। তবে সামরিক কর্মকর্তারা এই পরিবর্তন করতে রাজি হয়নি।

সুদানের সঙ্কট এই অঞ্চলের অস্থিরতাকে উসকে দেবে। কারণ এটি মহাদেশের সবচেয়ে ভূ-কৌশলগত অবস্থানগুলোর মধ্যে একটিতে অবস্থিত দেশটি। দীর্ঘ লোহিত সাগরের উপকূলরেখাসহ উত্তর এবং সাব-সাহারান আফ্রিকার মধ্যে একটি ঐতিহাসিক সেতু হিসাবে কাজ করে দেশটি। সুদানে আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন এবং ইতিবাচকভাবে জড়িত আঞ্চলিক ও বিদেশী নীতিগুলোকে উৎসাহিত করে অভ্যন্তরীণ সংঘাত বন্ধ করা এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

২০১৯ সালের এপ্রিলে বশিরের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরের সপ্তাহগুলোতে খার্তুমে সবাই একটি ভালো সুদানের আশা করেছিলেন যেখানে প্রত্যেকেরই তাদের দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে। সশস্ত্র বাহিনী কয়েক দশক ধরে অর্থনীতি পরিচালনা করেছে। ক্ষমতা মানে অর্থনৈতিক 'ভাড়া', তেল, খনিজ এবং রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া উৎস থেকে আয় আহরণের সুযোগ।

সুদানের সঙ্কট দেখার একটি উপায় হলো অভিজাত দর কষাকষির ধারণা। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ডগলাস নর্থের তৈরি একটি ধারণা দিয়ে এটি বোঝা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন যে ক্ষমতা, এবং এর সাথে যে অর্থনৈতিক সুবিধাগুলো যায়, তা অভিজাতদের মধ্যে বিভক্ত। এ নিয়ে প্রতিযোগিতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং নতুন প্রবেশকারীদের এতে নিরুৎসাহিত করা হয়।

সুদানে খার্তুমের চারপাশে কেন্দ্রীভূত সেনাবাহিনী এবং প্রধানত আরব অভিজাতরা অর্থনৈতিক সুবিধাদি নিয়ন্ত্রণ করেছিল। এখানে ভাগ বসাতে কামড় দেয়ার কয়েকটি উপায়ের মধ্যে একটি ছিল সহিংসতা। এভাবেই 'হেমেতি' নামে পরিচিত মোহাম্মদ হামদান দাগালো টেবিলে তার আসন অর্জন করেন। প্রথমত, তিনি দারফুরে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত তথাকথিত জানজাওয়েদ মিলিশিয়ার নেতৃত্ব দেন। পরে তিনি বশিরের প্রতিষ্ঠিত একটি আধা-সামরিক বাহিনীর প্রধান হন যারা এটিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সামরিক শক্তিকে খণ্ডিত করতে চেয়েছিলেন।

হেমেতিকে ক্ষমতাধর করে তোলা বশিরের জন্য একটি ভুল ছিল। এতে ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়েছিল। আর আবহ পাল্টানোর বিষয়টি টের পেয়ে এই দৈত্য বশিরকে উৎখাতে বৈশ্বিক মাফিয়াদের সাথে নেমে পড়েন। ক্ষমতার লড়াইয়ে দ্বিতীয় শীর্ষ পর্যায়ে যাবার পর প্রাইমারি পাশ এই মিলিশিয়া নেতা শীর্ষ ক্ষমতাধর হতে সেনাপ্রধান হবার প্রতিযোগিতায় নামেন। আর এতে উসকানি দেয় রাশিয়া, ইসরাইল, আমিরাতের মতো দেশ। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুদ্ধ শুরুর আগে তার সাথে বৈঠকে মিলিত হন।

গোপন সফরে তাকে ইসরাইল ডেকে নেয়া হয়। লিবিয়ায় আমিরাতের সহায়তায় ত্রিপলি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হাফতার বাহিনীতে তার ১,২০০ যোদ্ধা রয়েছে। ওমর আল বশিরের সময় ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে একটি কেন্দ্র বিন্দু ছিল। সুদানে এখন সমান্তরাল দুটি শক্তি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে। দু'পক্ষের পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী শক্তির ইন্ধন।

সুদানের বিক্ষোভকারীরাও দরকাষাকষির টেবিলে একটি আসন অর্জন করেছিল। তারা গণতান্ত্রিক রূপান্তরে আমূল পরিবর্তনে কিছু প্রস্তাব করেছিল : সীমিত অ্যাক্সেসের সমাজ থেকে এমন একটি সমাজে স্থানান্তর তারা চেয়েছিল, যেখানে লোকেরা যোগ্যতার ভিত্তিতে সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতা করতে পারে। তারা যে শব্দটি ব্যবহার করেছিল তা ছিল ‘গণতন্ত্র’। সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে নিয়ে যাওয়া।

কিন্তু সশস্ত্র বাহিনী ওই সমঝোতা চুক্তি থেকে সরে আসে। ২০২১ সালে দ্বিতীয় অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নতুন গণতান্ত্রিক উত্তরণকে হত্যা করে তারা। সামনে চলে আসে হেমেতির আধাসামরিক বাহিনী এবং জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহানের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন। বুরহান চেয়েছেন, মিলিশিয়া বাহিনীকে নিয়মিত সেনাবাহিনীতে আত্মীকরণ করে হেমেতিকে নিরপেক্ষ করতে। আর হেমেতি চেয়েছেন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে। এখান থেকেই সুদানের আজকের সহিংসতার সূত্রপাত।

আপাত দৃষ্টিতে হেমেতি বা বুরহান গণতান্ত্রিক রূপান্তর থেকে সরে যাওয়ার জন্য এই সঙ্কট। কিন্তু আরো গভীরে রয়েছে দেশটিতে প্রভাব বিস্তারের লড়াই। বশিরের সময় আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধের কারণে বিনিয়োগের একমাত্র উৎস ছিল চীন। দেশটি নানা প্রকল্পে বিনিয়োগ করে একটি শক্তিমান অবস্থান তৈরি করেছে। রাশিয়ার ভাড়াটিয়া বাহিনী ওয়েগনার গ্রুপের সেনা রিক্রুটের অন্যতম উৎস ছিল মিলিশিয়া গ্রুপগুলো। এভাবে সুদানে তারা অবস্থানকে সুসংহত করে। এর সাথে স্বর্ণখনি নিয়ন্ত্রণ, লোহিত সাগরে সামরিক ঘাঁটির পরিকল্পনা এবং ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ সেনার হাতে ধরে রাখার স্বাভাবিক মনোবৃত্তি এবং সৌদি আামিরাত মিসরের মতো আঞ্চলিক প্রভাবশালীদের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের বিরোধিতা এক জটিল অবস্থা তৈরি করেছে সুদানে।

গণতান্ত্রিক রূপান্তরের চুক্তি বাস্তবায়ন এক্ষেত্রে ছিল সর্বোত্তম উপায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন, সৌদি আরব ও আমিরাতকে নিয়ে কোয়াড গঠন করেছে এ সমস্যা দেখার জন্য। তাদের দিয়ে গণতান্ত্রিক উত্তরণের ফয়সালা করা কোনো সহজ কাজ নয়। এই উল্টামুখী স্বার্থের টানাপড়েনে সুদানে যে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছে তা সহজে থামবে বলে মনে হয় না।

ইসরাইলপন্থী এক গণমাধ্যম বলেছে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা হেমেতিকে মদদ দিচ্ছে আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যোগাযোগ রাখছে বুরহানের সাথে। ওআইসির একটি কার্যকর উদ্যোগ এখানে শান্তি আনতে পারত। তেমন কোনো উদ্যোগ এখনো দৃশমান নয়। প্রভাবশালী মুসলিম দেশগুলোর বেশির ভাগই যার যার দেশে নানা সঙ্কট মোকাবেলায় ব্যস্ত রয়েছে।
সুদান আজ যে ‘এরিয়া ডিনায়েলের’ পরিস্থিতির মুখে পড়েছে তেমন পরিস্থিতি দক্ষিণ এশিয়ায়ও উদ্ভব হবার আশঙ্কা রয়েছে। এই অঞ্চলে চীন-রাশিয়ার সাথে পাশ্চাত্যের প্রভাব বিস্তারের লড়াই ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। চীন-রাশিয়া এখানকার দেশগুলোতে কর্তৃত্ববাদিতার বিস্তার চায়। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা চায়- গণতন্ত্র চর্চা, যাতে তাদের প্রভাব বিস্তারের টুলসগুলো কার্যকর থাকে। আর চীন-রাশিয়ার পছন্দ উত্তর কোরিয়া-মিয়ানমার ধরনের শাসন। দু’পক্ষের এই লড়াই তীব্র হলে সুদান ধরনের পরিস্থিতি এই অঞ্চলের জন্য খুব বেশি দূরে বলে মনে হয় না।


আরো সংবাদ



premium cement
হালুয়াঘাটে বিএনপি ঘরানার আব্দুল হামিদ বিজয়ী সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার রায় আজ ৫ ঘণ্টা পর ঢাকার সাথে উত্তরবঙ্গের রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক খাগড়াছড়িতে ৩ উপজেলার ফলাফল ঘোষণা, একটিতে স্থগিত সমুদ্র পথ থেকে হজ কাফেলা যেভাবে বিমান যাত্রায় বিবর্তন হলো নাসিরনগর উপজেলায় প্রথম নারী চেয়ারম্যান রোমা, সরাইলে শের আলম ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধ না হলে মুসলিম বিশ্ব বসে থাকবে না : ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম ইউক্রেনের সহায়তায় ব্যবহারের জন্য চুক্তিতে পৌঁছেছে ইইউ আটক করা রুশ সম্পদ আফগানিস্তানে তালেবান গাড়িবহরে বোমা হামলা, নিহত ৩ ইসরাইলকে চূড়ান্ত হুমকি বাইডেনের বগি লাইনচ্যুত, ঢাকার সাথে উত্তরবঙ্গের রেল যোগাযোগ বন্ধ

সকল