২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


দলবাজ আমলা-কামলাদের হাল হকিকত

গোলাম মাওলা রনি - নয়া দিগন্ত

ঘটনার দিন আমি চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম। বিমানবন্দরের ভিআইপি গেট পার হয়ে যখন নির্ধারিত লাউঞ্জের দিকে এগুচ্ছিলাম ঠিক তখন আমার বাল্যবন্ধু রবিনের সঙ্গে দেখা (ছদ্ম নাম)। রবিনের সঙ্গে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়েছি এবং শৈশব-কৈশোরে সে-ই ছিল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এখন সরকারি চাকরি করে। ছাত্র জীবনে ছাত্রদল করত এবং সপরিবারে বিএনপির কট্টর সমর্থক। রবিন সারাটি জীবন বিএনপি-ধানের শীষ ও বেগম জিয়া ছাড়া কিছুই বুঝত না এবং বিএনপির জমানায় দলীয় পরিচয়ে সরকারি চাকরি পাবার পর সে রাজনীতিতে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে।

আমি নিজে ছাত্রলীগ করতাম আর আমার পরিবার ছিল কট্টর আওয়ামীপন্থী। তবুও রবিনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল নিবিড়-প্রগাঢ় এবং আনন্দময়। আমি যখন সংসদ সদস্য হলাম তখন ভিন্নমত সত্ত্বেও রবিন ভারী খুশি হলো। কারণে অকারণে আমার অফিসে আসত এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়ে যেত। আমি যখন ঢাকা বিমানবন্দর হয়ে কোথাও যেতাম তখন সে বিমানবন্দরে তার দায়িত্ব কর্তব্য ফেলে আমাকে প্রটোকল দিত এবং সেখানে তার বিরাট দঙ্গল সাঙ্গো-পাঙ্গ নিয়ে পুরোটা সময় আমার সঙ্গে থেকে আমাকে উড়োজাহাজের ভেতরে ঢুকিয়ে তারপর হাসিমুখে ফিরে যেত। ফলে তার সঙ্গে আর আবাল্য বন্ধুত্ব ২০০৯ থেকে ২০১৮ অবধি- প্রগাঢ় থেকে প্রগাঢ়তর হতে থাকল। এরই মধ্যে আমি বিএনপিতে যোগ দিলাম এবং রাতের ভোটের নির্মমতার শিকার হয়ে ২০১৯ সাল থেকে নতুন রাজনৈতিক জীবনযাপন করতে লাগলাম।
উল্লিখিত অবস্থায় একদিন কী মনে করে রবিনকে ফোন দিলাম। কিন্তু সে ফোন ধরল না। আমি বিষয়টি নিয়ে কোনো নেতিবাচক চিন্তা করলাম না। কারণ তার সাথে আমার সুদীর্ঘ বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতার কারণে আমার মনে হলো হয়তো সে কল ব্যাক করবে- নয়তো তার ফোন নম্বর পরিবর্তন হয়েছে। যা হোক, গত চার বছর ধরে রবিনের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই এবং নানা ব্যস্ততার কারণে যেমন তার কথা মনে হয়নি- আবার কোনো কাজে তার প্রয়োজনেও পড়েছি। এমতাবস্থায়, ঘটনার দিন যখন আমি তাকে বিমানবন্দরে দেখলাম তখন পুরোনো বন্ধুত্ব মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। আমি শিশুর মতো রবিন বলে চিৎকার করে উঠলাম।

আমাকে দেখে রবিন ভড়কে গেল। তার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। পালানোর উপায় থাকলে নিশ্চয়ই সে ভোঁ দৌড় দিত। আমি ওসব পাত্তা না দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। এদিকে, আমার পরিচিতির কারণে বিমানবন্দরের শত শত চোখ আমাদের কোলাকুলির দৃশ্য দেখছিল। অসংখ্য সালাম শুভেচ্ছা ও সেলফি তোলার হিড়িকের মধ্যে লক্ষ্য করলাম, রবিন যেন আতঙ্কে বরফ হয়ে গেছে। তাকে নিয়ে আমেরিকান এক্সপ্রেসের লাউঞ্জে ঢুকলাম এবং এক সঙ্গে ইফতার করলাম। ইফতার শেষে রবিনকে জিজ্ঞাসা করলাম- তুমি এমন করছ কেন এবং গত চার বছর কেনো যোগাযোগ করোনি? সে মাথা নিচু করে জবাব দিলো, বুঝোই তো সরকারি চাকরি করি। তুমি বিএনপিতে যোগদানের পর তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে যদি চাকরিটি চলে যায়।

আজকের নিবন্ধে রবিনের কথা মনে এলো মূলত আমার আরেক বন্ধু মিন্টুর কারণে (ছদ্ম নাম) যে কিনা একটি সরকারি অফিসের বড় কর্তা। বিএনপি করার কারণে অনেক দিন ওএসডি হয়ে ছিল। পরে দেনদরবার-মালকড়ি খরচ করে লাভজনক একটি পদে নিয়োগ পেয়েছে। প্রায়ই আমাকে ফোন দেয় এবং বিএনপি কবে আসবে, আওয়ামী লীগ কবে যাবে-এসব নিয়ে কথা বলে। আওয়ামী লীগের অবস্থা যখন ভালো বলে মনে করে, তখন আর ফোনটোন করে না। অন্য দিকে, বিএনপির পাল্লা যদি ভারী মনে হয় তবে বেপরোয়া ভাব নিয়ে আমার অফিসে ঝড়ের গতিতে চলে আসে। তো সেই মিন্টু ২-৩ দিন আগে ফোন দিলো। তারপর অফিসে আসতে চাইল। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের কথা শোনার পর বলল দোস্ত! তুমি বিএনপি করো- তোমার অফিসে গেলে তো চাকরি থাকবে না। ঘটনার পরের দিন মির্জা ফখরুলের সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠকের পর মিন্টু আবার পল্টি দিয়ে বিএনপির দিকে ঝুঁকল।

বিএনপিপন্থী কর্মকর্তাদের উল্লিখিত কর্মকাণ্ডের সাথে আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তাদের কর্মকাণ্ডের কিছু নমুনা পেশ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। আওয়ামী কর্মকর্তাদের চঞ্চলতা-অস্থিরতা এবং ভীতসন্ত্রস্ত ভাব কোন পর্যায়ে, তার একটি মহড়া দেখলাম আমার এক বন্ধুপুত্রের বিবাহের অনুষ্ঠানে। বন্ধুটি দেশের খুবই নামকরা শীর্ষ আইনজীবী। তার অনুষ্ঠানটি সব শ্রেণীপেশার শীর্ষ লোকদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। ঊর্ধ্বতন সামরিক বেসামরিক কর্তা, বিচারপতি, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ সবাই ছিলেন। তবে বিএনপির লোক বলতে আমার চেয়ে উল্লেখযোগ্য কেউ ছিলেন না। অন্য দিকে, আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা মন্ত্রীদের সঙ্গে দলের হোমরা চোমরাদের কোলাহলে চারদিকে যখন নৌকা-লগি-বৈঠা ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছিল না- তখন অনুষ্ঠানস্থলে সপরিবারে আমার উপস্থিতি মুহূর্তের মধ্যে সব কোলাহল থামিয়ে দিলো। তারপর শুরু হলো মৃদু গুঞ্জন।

ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিছুটা থমকে গেলাম। কিন্তু পরক্ষণে উচ্ছ্বাস উদ্দীপনায়, সহাস্য বদনে যখন অনুষ্ঠানস্থলের সাধারণ মানুষ দলে দলে এগিয়ে এলেন অভ্যর্থনার জন্য এবং শত শত সেলফি তোলার দৃশ্য যখন ভিআইপি-সিআইপিরা দেখলেন তখন তাদের টনক নড়ল। তারা ভাবলেন- আমি হয়তো আবার আওয়ামী লীগে ফিরে এসেছি অথবা এতবড় এক মিলনমেলায় আমাকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের যে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-আবেগ উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে সে ক্ষেত্রে আমার সঙ্গে করমর্দন করাটা অনেক ভিআইপির জন্য ইজ্জতকা সওয়ালে পরিণত হলো। সুতরাং তারাও এগিয়ে এলেন এবং অতীতের সম্পর্কের মধুময় দিনগুলো স্মরণ করে খোশগল্পে মেতে উঠলেন। উপস্থিত ভিআইপিদের মধ্যে একজন ছিলেন রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পদধারী, যার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ রাজনীতি করেছি। তিনি এগিয়ে এলেন। কিন্তু আমি কিছুতেই তাকে চিনতে পারলাম না। কারণ তার মুখের লম্বা দাড়ি টুপি এবং হাল আমলের নাম ডাকের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলের স্মৃতি কিছুতেই মিলাতে পারছিলাম না। কথা বলতে বলতে তিনি অশ্রুসিক্ত হলেন এবং আমার স্ত্রীকে বললেন, জানেন ভাবী! রনি ও আমি এটা করেছি ওটা করেছি ইত্যাদি। এরপর আমার ফোন নম্বর নিলেন, নিজেরটা দিলেন। ইতোমধ্যে একদল লোক এগিয়ে এলেন ছবি তোলার জন্য। আমার ভিআইপি কর্তা বন্ধুও আমার সাথে ছবি তোলার আগ্রহ জানালেন। কেউ একজন ফিসফিসিয়ে পরামর্শ দিলো, স্যার! ওনার সঙ্গে কি ছবি তোলা ঠিক হবে? পরামর্শ শুনে ভদ্রলোকের বীরত্ব চরমে উঠল এবং তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেকগুলো ছবি তুললেন।

বাসায় ফেরার পথে স্ত্রীকে বললাম, দেখো। দুনিয়াতে এখনো মানুষ আছে। সবাই রাজনৈতিক কারণে ব্যক্তিগত সম্পর্ক জলাঞ্জলি দেয় না। আমার স্ত্রীও সহাস্যবদনে সায় দিলেন। এই ঘটনার কয়েক দিন পর নেহাত কৌতূহলবশত সেই ভিআইপিকে ফোন দিলাম। অবাক করা বিষয় হলো, তিনি ফোন ধরলেন না। কিংবা পরে ফিরতি কল দিলেন না। আমি অবাক হলাম না বটে- তবে আমার অভিজ্ঞতায় সরকারি কর্তাদের আচরণ সম্পর্কে আরো নতুন একটি অধ্যায় যুক্ত হলো।
উল্লিখিত ঘটনার মতো শত শত কৌতূহলোদ্দীপক এবং আকর্ষণীয় ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছে। ফলে পারতপক্ষে আমি পদ পদবিধারীদের কাছ দিয়ে হাঁটি না- কারো সাথে কোনো সম্পর্ক থাকলে তা ভুলে থাকার চেষ্টা করি এবং কখনো মুখোমুখি হলে না চেনার ভান করে এড়িয়ে যাই। ফলে ক্ষমতার বাইরে থাকা সত্ত্বেও আমি কোনো দিন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়িনি। আমার ব্যবসা-বাণিজ্য অথবা অন্য কোনো ব্যক্তিগত কাজে আজ পর্যন্ত কোনো চেষ্টা তদবিরের প্রয়োজন হয়নি। কারো কাছে ধরনা দিতে হয়নি এবং কোনো কাজের জন্য ঘুষ দেয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি। বরং উল্টো বিভিন্ন ক্ষমতাধরদের ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর তাদের পুনর্বাসিত করার জন্য নানা রকম কষ্ট কসরত করতে হয়েছে। এমনকি নিয়োগ বদলির মতো কাজও করে দিতে হয়।

সরকারি আমলা কামলা সম্পর্কে নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনার পর আজকের শিরোনাম সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বলে নিবন্ধের ইতি টানব। আমাদের সমাজের একশ্রেণীর মানুষের বিশেষ করে দুর্নীতিবাজ ধনিক শ্রেণীর মানসিক রোগ হলো বড় বড় আমলা কামলা এবং প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা। ক্ষেত্র বিশেষে এ ধরনের সম্পর্কের মধ্যে বিশেষ ধান্ধা ও ফন্দিফিকির থাকে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হীনম্মন্যতার কারণে কিছু মানুষ পদপদবির লেহন করে। নিজেদের অশিক্ষা নীচুতা অবৈধ আয় সামাজিক মর্যাদাহীনতা চারিত্রিক কলঙ্ক ইত্যাদি আড়াল করার জন্য বড় বড় গাড়ি, প্রাসাদোপম বাড়ি, বন্দুকওয়ালা দেহরক্ষী, দামি পোশাক পরিচ্ছদ ও অলংকারাদির মতো আমলা কামলার বন্ধুত্বকে তারা পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু নিজেদের বিপদে আপদে প্রয়োজন সেই পণ্য কোনো উপকারে এসেছে, এমন তথ্য আমি এখনো পাইনি। তবে খানাপিনা বিনোদনের জন্য হীনম্মন্য ব্যক্তিরা ক্ষমতাধরদের সান্নিধ্য যেকোনো মরণ নেশার চেয়েও অধিকতর মাত্রায় উপভোগ করে থাকে।

আমলা কামলার সান্নিধ্য প্রত্যাশীদের বিপরীতে আমলা কামলাদের আচরণও বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। সাধারণ উঁচু মার্গের শিক্ষিত সজ্জন ও সৎ আমলারা অনেক কিছু এড়িয়ে চলেন। রাজনীতিবিদ ব্যবসায়ীদের মতো যাদের বদনাম রয়েছে তাদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলেন এমন আমলার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তবে ঘুষ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত আমলারা সর্বদা রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য সর্বহারা ভিক্ষুকের মতো দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের পদ লেহনের জন্য রীতিমতো পাগলপারা হয়ে যায়। নিজেদের অবৈধ আয় দ্বারা ফুর্তি করার জন্য সমপর্যায়ের অপরাধীদের সঙ্গ লাভের জন্য তারা নেশাখোরদের মতো সম্বিত হারিয়ে উপযুক্ত সঙ্গী সঙ্গিনীর খোঁজে চরকির মতো ঘুরতে থাকে। এই শ্রেণীর আমলা কামলারা সব সময়ই শক্তের ভক্ত নরমের যম এবং ক্ষমতা যেখানে আমরা আছি সেখানে এই নীতিতে উল্কার গতিতে ছুটে বেড়ায়। ফলে ক্ষমতায় থাকা দুর্র্নীতিবাজ লোকেরা সমপর্যায়ের ও সমচরিত্রের আমলা কামলাদের দ্বারা পরবর্তী জীবনে কতটা দুর্ভোগ দুর্দশার মধ্যে পড়বেন তা ক্ষমতার চেয়ার থেকে না নামা পর্যন্ত টের পাবেন না।

পাদটীকা : আজকের লেখাটি মূলত দেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি সচেতনতামূলক নিবন্ধ। ক্ষমতার পালা পরিবর্তন যখন অনিবার্য তখন প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদরা যা করেন তা হলো দলবাজ আমলাদের জন্য নিজেদের বাড়ি ও অফিসের দরজা বন্ধ করে দেয়া এবং যারা এই কাজটি যত বেশি সফলতার সঙ্গে করতে পারেন তারাই ক্ষমতার চেয়ারে বসে দেশ জাতির কল্যাণে বেশি কাজ করতে পারেন।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement