২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বদর যুদ্ধের তাৎপর্য

বদর যুদ্ধের তাৎপর্য। - প্রতীকী ছবি

১৪৪৪ হিজরি সালের ১৭ রমজান। দ্বিতীয় হিজরির এই দিনেই সংঘটিত হয়েছিল ইসলামের ইতিহাসের সর্বপ্রথম ‘সত্য ও মিথ্যার’ মধ্যকার যুদ্ধ। ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুলাইয়ে সংঘটিত হওয়া (আশরাফি, ২০০২:৯২) এই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই আরববাসী বার্তা পেয়েছিল, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হতে এসেছে। এই যুদ্ধেই প্রমাণিত হয়েছিল মুহাম্মদ সা: আল্লাহর নবী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা। সাড়ে চৌদ্দ শ’ বছর আগেই রাসূল সা: অসাধারণভাবে আধুনিক গোয়েন্দা তৎপরতা এবং রণকৌশলের মাধ্যমে তিনগুণ বড় শত্রু বাহিনীকে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধের দ্বারা সমূলে পরাজিত করেছিলেন।

বদর যুদ্ধের আগে রাসূল সা: ‘গাজওয়াতুল আবওয়া’ নামে একটি অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। গাজওয়াতুল আবওয়া অভিযানে মুসলমানদের লক্ষ্য ছিল আবু সুফিয়ানের নেতৃত্ব সিরিয়াগামী বাণিজ্য কাফেলা। এই কাফেলা ছিল তৎকালীন সময়ের কোরাইশদের সর্ববৃহৎ বাণিজ্য কাফেলা। এই কাফেলার মূল লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের নির্মূল করার জন্য যুদ্ধের প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও রসদ সম্ভার গড়ে তোলা। এই বাণিজ্যে যাত্রার আগে কোরাইশরা মক্কার অধিবাসীদের সব অর্থ একত্রে জমা করে বৃহৎ পুঁজি সংগ্রহ করেছিল। শুধু পুরুষরাই নয়; বরং যে সব মহিলা অল্প বিস্তর ব্যবসায়ে অংশগ্রহণ করত, তারাও এ বাণিজ্যে শরিক হয়েছিল (আশরাফি, ২০০২ : ১০৪)। এসব সংবাদ রাসূল সা: সময়মতোই পেয়ে যান। রাসূল সা: কোরাইশদের যুদ্ধ করার সামর্থ্য যেন আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে না পারে সে জন্য এই কাফেলাকে বাধা দেয়ার পরিকল্পনা করলেন। কারণ, রাসূল সা: স্পষ্টতই কোরাইশদের শত্রুতামূলক যুদ্ধংদেহী আচরণে বুঝতে পারছিলেন যে, মদিনার ওপর কোরাইশদের আক্রমণ অত্যাসন্ন। কিন্তু গাজওয়াতুল আবওয়া নামক স্থানে পৌঁছার আগেই ওই বাণিজ্য কাফেলা সিরিয়ার উদ্দেশ্যে নিরাপদে চলে যেতে সক্ষম হয়েছিল। কাজেই নবীজী সা: সিরিয়া থেকে ফেরার পথে এই বাণিজ্য কাফেলাকে পাকড়াও করার পরিকল্পনা করেন। কারণ, মুসলমানরা হিজরত করে মদিনায় আসার পথে কোরাইশরা তাদের সহায়-সম্পদ সব কিছুই কেড়ে রেখে দিয়েছিল। এমনকি কোনো কোনো সাহাবির গায়ের কাপড় পর্যন্ত তারা খুলে রেখে দিয়েছিল। কাজেই এই কাফেলাকে সিরিয়া থেকে বিপুল সামগ্রীসহ ফেরার পথে ধরতে পারলে একদিকে যেমন কাফেরদের যুদ্ধ করার সামর্থ্য ক্ষয়প্রাপ্ত হবে অন্যদিকে মক্কায় মুসলমানদের ফেলে আসা সম্পদ কিছুটা হলেও উদ্ধার করা সম্ভব হবে। সুতরাং ওই বাণিজ্য কাফেলার ফিরে আসার সংবাদ সংগ্রহের জন্য রাসূলুল্লাহ সা: তালহা ইবন উবায়দিল্লাহ এবং সাঈদ ইবন জায়দ রা:-কে গুপ্তচর হিসেবে পাঠান। তাঁরা রা: সিরিয়ার নিকটবর্তী খুওয়ার নামক স্থানে পৌঁছে কুছায়ির ইবন মালিক আল জুমাহির আশ্রয়ে উঠে লুকিয়ে থেকে কাফেলার সংবাদ সংগ্রহের চেষ্টা করতে থাকেন। (সিরাত বিশ্বকোষ, ষষ্ঠ খণ্ড, ২০০৩ : ৩৪৪) এই গুপ্তচরদ্বয় পরে মদিনার উত্তর-পূর্ব দিকে ১০০ মাইল দূরে আল হাওরা নামক স্থানে পৌঁছলেন তখন তারা আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলার সাক্ষাৎ লাভ করেন (আশরাফি, ২০০২ : ১০৪) তারা দ্রুত ফিরে এসে রাসূল সা:-কে কাফেলা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেন। তথ্য মতে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ওই বাণিজ্য কাফেলায় এক হাজার উটসহ প্রায় ৫০ হাজার দিনার মূল্যমানের সম্পদ ছিল। গোয়েন্দা সংবাদ পেয়ে রাসূল সা: বাণিজ্য কাফেলাকে ধরার জন্য তৎক্ষণাৎ যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেন। যেহেতু সেটি ছিল মাত্র ৩০-৪০ জনের একটি কাফেলা সেহেতু তিনি সা: যারা যারা কাছেই ছিলেন তাদেরকে নিয়েই মাত্র ৩১৩ জনের বাহিনী তৈরি করে যার কাছে যা অস্ত্র ছিল তাইসহ কাফেলার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন। বাহিনী নিয়ে তিনি সা: আস-সাফরা নামক স্থানে এসে বাসবাস ইবন আমর জুহানি রা: এবং আদি ইবনে আবু জাগবা রা:-কে গুপ্তচর হিসেবে বাণিজ্য কাফেলার সংবাদ সংগ্রহের জন্য বদরের দিকে প্রেরণ করেন। এই স্পাই দুজন বদর প্রান্তরে এসে একটি পানির ক‚পের কাছে পানি সংগ্রহের ভান করে অপেক্ষমাণ ছিলেন। সেখানে তারা ওই এলাকার দু’জন দাসীর কথোপকথন থেকে বুঝতে পারেন যে আগামী দু-এক দিনের মধ্যেই কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলা এখানে এসে পৌঁছাবে। ঘটনাস্থলে সে সময় উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় এক গোত্রপতি মাজদি ইবন আমর আল জুহানি। মাজদি তখন ওই দাসীদ্বয়ের একজনের ধারণাকে সঠিক বলে বাণিজ্য কাফেলার আগমনের সংবাদকে সমর্থন করেন (সিরাত বিশ্বকোষ, ষষ্ঠ খণ্ড : ২০০৩ : ৩৬৩) রাসূল সা:-এর গোয়েন্দারা তৎক্ষণাৎ ফিরে গিয়ে রাসূল সা:-কে গোয়েন্দা প্রতিবেদন দেন। এ দিকে বদরের দিকে যাত্রাকালে একজন মুশরিক মুসলিম বাহিনীতে যোগ দিতে আসে। কিন্তু রাসূল সা: ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ সমরবিশরদ। তিনি সা: নিরাপত্তাজনিত কারণে তাকে বাহিনীতে নিতে অস্বীকার করলে লোকটি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তখন রাসূল সা: তাকে মুসলিম বাহিনীতে ভর্তি করেন এবং মনস্তাত্তি¡ক প্রেষণা দেন। (সাল্লাবি :২০২২ : ৬৩)। বদরে অগ্রাভিযানের সময় বাহনের স্বল্পতার কারণে বাহিনীর প্রতি তিনজনের জন্য একটি উট বরাদ্দ ছিল। রাসূল সাধ-এর সাথে উটে চড়ার জন্য আরো দু’জন সৈনিক ছিলেন। তিনজন পালা করে উটে চড়তেন এবং হাঁটতেন। অন্য দুজন তাদের পালা সমর্পণ করে রাসূল সা:-কে উটে চড়তে অনুরোধ করলে তিনি সা: বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করে নিজেও তাদের সাথে সমানভাবে হাঁটতে এবং উটে আরোহণ করতে লাগলেন। এইভাবে সৈনিকদের মনস্তাত্ত্বিকভাবে অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য নবীজী সা: নিজে সাধারণ সৈনিকদের মতই যুদ্ধ যাত্র করেন (প্রাগুক্ত)।

এদিকে বাণিজ্য কাফেলার সুচতুর নেতা আবু সুফিয়ান অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তার কাফেলা নিয়ে মদিনার পাশ দিয়ে পথ চলতে থাকে। ফলে সে মুসলিম বাহিনীর অগ্রাভিযানের সংবাদ যথাসময়েই পেয়ে তার কাফেলা নিয়ে সাধারণ রাস্তা ছেড়ে দিয়ে বিকল্প পথে মদিনা এড়িয়ে চলে যায়। একই সাথে সে আক্রন্ত হওয়ার ভয়ে মক্কায় সংবাদ পাঠায় যে, বাণিজ্য কাফেলা মুসলমানদের দ্বারা ভয়াবহ আক্রমণের শিকার হতে যাচ্ছে। মক্কায় খবর পৌঁছার সাথে সাথে আবু জেহেলের নেতৃত্বে এক হাজার সৈনের কোরাইশ বাহিনী মদিনা আক্রমণ করে মুসলমানদেরকে চিরতরে নিঃশ্বেষ করে দেয়ার জন্য অগ্রাভিযান শুরু করে।

নবীজী সা: যথারীতি সংবাদ পেয়ে যান যে, কোরাইশদের বিশাল বাহিনী এগিয়ে আসছে। এক হাজর সৈন্যের এই বাহিনীতে অশ্বরোহী ছিল ৩০০ জন, উট ছিল ৭০০টি ও বর্ম ছিল ৬০০ জনের। বিপরীতে মুসলমানদের ৩১৩ জনের মধ্যে উট ছিল ৭০টি, ঘোড়া ছিল মাত্র তিনটি এবং বর্ম ছিল মাত্র ষাট জনের। রাসূল সা: যখন জানতে পারলেন যে, বাণিজ্য কাফেলা ফসকে চলে গেছে এবং কোরাইশ সেনাবাহিনী আক্রমণ করতে মদিনার উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছে তখন তিনি সা: মুহাজির এবং আনসার নেতাদের সাথে পরামর্শ করে বদরের প্রান্তরে কোরাইশ বাহিনীকে মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

সিদ্ধান্ত মোতাবেক রাসূল সা: সেখান থেকেই বাহিনী নিয়ে বদরের নিকট পৌঁছে যাত্রা বিরতি করেন। বাহিনীকে বিশ্রাম দিয়ে তিনি সা: হজরত আবু বকর রা:-কে সাথে নিকে রেকি পেট্রল বা যুদ্ধের এলাকা পর্যবেক্ষণে বের হন। এ সময় তারা সা: একজন স্থানীয় বৃদ্ধের সাক্ষাৎ পেয়ে তার নিকট থেকে কুরাইশ বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। তথ্য দেয়ার শর্ত হিসেবে সেই বৃদ্ধ নবীজী সা:-কে জিজ্ঞেস করেন, তিনি সা: কোথা থেকে এসেছেন। তথ্যগুলো জেনে নেয়ার পর রাসূল সা: নিজের পরিচয় গোপন করার জন্য অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে নিজের পরিচয় দেন। তিনি সা: বলেন যে, ‘আমরা পানি থেকে এসেছি’। এ কথা বলেই নবীজী সা: বৃদ্ধকে পাল্টা প্রশ্নের সুযোগ না দিয়েই দ্রুত ফিরে আসেন। বৃদ্ধ শুধু বলতে লাগল, কোন পানি হতে? ইরাকের পানি? (সিরাত বিশ্বকোষ, ষষ্ঠ খণ্ড : ২০০৩ : ৩৬২)। এখানে নবীজী সা: বৃদ্ধের শর্ত মোতাবেক উত্তরও দিয়েছেন আবার গুপ্তচরের মতো নিজেদের পরিচয়ও সফলতার সাথে গোপন রেখেছেন। এই গোপনীয়তা মুসলিম বাহিনীর নিরাপত্তা এবং যুদ্ধ জয়ের কৌশলের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। রেকি মিশন থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ফিরে এসে সন্ধ্যাবেলা রাসূল সা: আলী রা:-এর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি স্ট্যান্ডিং পেট্রল বদরের ক‚পের নিকট পাঠান। এই পেট্রল পার্টি কূপের নিকট থেকে দু’জন লোককে আটক করে। এরা কুরাইশদের পানি বহনকারী শ্রমিক ছিল। তাদেরকে গ্রেফতার করে নবীজীর সা: নিকট নিয়ে এলে রাসূল সা: ইন্টারোগেট বা জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের নিকট থেকে কুরাইশ বাহিনীর জনশক্তি, অবস্থান, নেতৃত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে নেন। এরপর রাসূল সা: তার বাহিনী নিয়ে বদরের প্রান্তরে মদিনার দিক থেকে সবচেয়ে নিকটবর্তী কূপের পাশে থামলেন। এ সময় একজন সামরিক বিশারদ সাহাবি হুবাব ইবন মুনজির রা: ‘Terrain Analysis’ বা ‘ভূমি বিশ্লেষণ’ করে রাসূল সা:-কে পরামর্শ দেন যেন মুসলিম বাহিনী মক্কার দিক থেকে সবচেয়ে নিকটবর্তী বা মক্কার বাহিনীর নিকটবর্তী কূপের কাছে শিবির স্থাপন করে পিছনের দিকের অর্থাৎ মদিনার দিকের নিকটবর্তী সকল কূপ নষ্ট করে দেয়া হয়। সেই সাথে মুনজির রা: একটি হাউজ তৈরি করে তাতে পানি দিয়ে পূর্ণ করে রাখার পরামর্শ দেন। এতে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পানির প্রচণ্ড চাহিদার সময় শত্রুরা পানি পাবে না কিন্তু মুসলমান যোদ্ধাগণ প্রয়োজনীয় পানি পান করতে পারবে। এমন সময় Divine Security Intelligence (DSI) বা ঐশী গোয়েন্দা নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যকারী হয়ে উঠে। হজরত জিবরাইল আ: এসে নবীজী সা:-কে জানান যে, মুনজিরের পরামর্শ সঠিক (সিরাত বিশ্বকোষ, ষষ্ঠ খণ্ড, ২০০৩ : ৩৬৬) সুতরাং রাসূল সা: তাঁর বাহিনী নিয়ে মুনজিরের পরামর্শমতো স্থানে শিবির স্থাপন করেন। ফলে যুদ্ধের সময় পানির সমস্ত সুবিধা মুসলমানরা ভোগ করে জয় লাভ করেছিলেন। যুদ্ধ শুরুর আগে রাসূলের সা: সংক্ষিপ্ত উদ্দীপক ভাষণ মুসলিম যোদ্ধাগণের মনস্তত্বকে মজবুত করে তুলে। তাদের মনোবল বৃদ্ধি করে দেয়। তিনি বলেন, ‘সংখ্যাধিক্যের ওপর বিজয় নির্ভরশীল নয়। অধিকতর শানশওকত ও সমরাস্ত্রের উপরও নয়। বিজয়ের জন্যে যে জিনিসের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হচ্ছে ধৈর্য এবং অবিচলতা’ (আশরাফি, ২০০২ : ১২২)। তিনি সা: আরো বলেন, ‘সেই সত্তার কসম যাহার হাতে মুহাম্মদের জীবন ! আজ কোনো ব্যক্তি যদি এমনভাবে যুদ্ধ করে যে, সে ধৈর্য ধারণকারী, ছওয়াবের প্রত্যাশী, সম্মুখে অগ্রসরমান, পশ্চাতে নহে, এই অবস্থায় যদি সে নিহত হয় তবে আল্লাহ তাহাকে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’ (ইবন হিশাম, দ্বিতীয় খণ্ড : ২০০৭ : ৩১৫)। যুদ্ধ শুরু আগে রাসূল সা: নিজ বাহিনীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পুরো ব্যাটালিয়নের তিনটি কোম্পানির জন্য তিনটি ‘পাসওয়ার্ড’ বা ছদ্মনাম নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। মোহাজির কোম্পানির পাসওয়ার্ড ছিল ‘ইয়া বানী আবদির রহমান’, আনসারদের খাজরাজ কোম্পানীর পাসওয়ার্ড ‘ইয়া বানী আবদিুল্লহ এবং আওস কোম্পানির পাসওয়ার্ড ছিল ‘ইয়া বানী উবায়দিল্লাহ’ (সিরাত বিশ্বকোষ, ষষ্ঠ খণ্ড : ২০০৩ : ৩৯০)।

এইভাবে প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাসূল সা: তাঁর বাহিনীকে সারিবদ্ধভাবে শত্রুবাহিনীর বিপরীতে দাঁড় করিয়ে মোতায়েন করলেন। তিনি সা: বাহিনীকে আগে আক্রমণ না করে বরং আক্রন্ত হলে এবং আদেশ পাওয়ার পর একযোগে আক্রমণের নির্দেশ দেন। তিনি সা: বর্শাধারী সৈনিকদের প্রথম কাতারে রাখেন শত্রুবাহিনীর অশ্বরোহীদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য। তাদের পেছনের সারিতে দাঁড় করান তীরন্দাজদের কে। তীরন্দাজদেরকে নির্দেশ দেন যে, শত্রু কেবলকাছে আক্ষেপ করবে যেন লক্ষ্য ভেদ করা যায় এবং অযথা তীর খরচ না হয়। আর শত্রুবাহিনী আমাদের বাহিনীতে ঢুকে পড়লে পরে তরবারি কোষমুক্ত করে সর্বাত্মক আক্রমণের নির্দেশ দেন (সাল্লাবি : ২০২২ : ৮২) তৎকালীন আরবদের কাছে এই সুশৃঙ্খলাবদ্ধ ও সারিবদ্ধভাবে যুদ্ধ ছিল সম্পূর্ণ নতুন এবং অভিনব যুদ্ধ কৌশল। এই নতুন রণকৌশল অত্যন্ত কার্যকরী প্রমাণিত হয়। সর্বশেষে আল্লাহতায়ালার সরাসরি সাহায্য হিসেবে ফেরেশতা বাহিনী অবতরণ করে এবং মুসলমানদের বিশাল বিজয় অর্জিত হয় (ইবন হিশাম, দ্বিতীয় খণ্ড, ২০০৭ : ৩১৯)। বদরের ময়দানে দুই পক্ষের মধ্যে ভয়ংকর এক যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ১৪ জন শীর্ষ নেতাসহ ৭০ জন কাফের নিহত হয় এবং আরো ৭০ জন যুদ্ধ বন্দী হয়। আর ২২ জন মুসলমান শহীদ হন (আশরাফি, ২০০২ : ১৪৪, ১৪৮)। যুদ্ধে জয়ের পর রাসূলুল্লাহ সা: তার বাহিনী নিয়ে আরো তিনদিন বদর প্রান্তরে অবস্থান করেন। মূলত কৌশলগত কারণে এবং গোয়েন্দা কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই এই অতিরিক্ত তিনদিন বদরে অবস্থান করেছিলেন। যেন শত্রæ পুনর্গঠিত হয়ে পুনরায় আক্রমণের সাহস না পায় এবং শত্রুর সম্পূর্ণ পরাজয় নিশ্চিত হয়।

বদর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসের গভীর তাৎপর্যময় একটি যুদ্ধ। এর আগে কাফের সম্প্রদায় মুসলমানদেরকে খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে দেয়া সম্ভব বলে ভাবত। মদিনার অভ্যন্তরের মুনাফেক ও ইহুদি সম্প্রদায়ও মুসলমানদেরকে শেষ করে দেয়ার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু বদর যুদ্ধের পর কাফেরদের পুরো গর্ব-অহঙ্কার লজ্জাস্কর পরাজয়ে পরিণত হলো এবং ইহুদি-মুনাফেকদের সব আশার আলো নিভে গেল। এই যুদ্ধে মুসলমানদের বিশাল বিজয়ের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বার্তাটি পাওয়া গিয়েছিল। যুদ্ধে সরাসরি আল্লাহর সাহায্য পেয়ে মুসলমানদের সব হীনম্মন্যতা দূরীভূত হয়ে ঈমান মজবুত হয়েছিল। যুদ্ধবন্দীদের সাথে মুসলমানদের চমৎকার মানবিক আচরণ কাফেরদের বিবেকবোধে আঘাত করে তাদের মনোবলকে নড়বড়ে করে দিয়েছিল। সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো রাসূলুল্লাহর সা: চৌকস সামরিক নেতৃত্ব প্রমাণ করে দিয়েছিল যে, তিনি সা: সত্যিকারের আল্লাহর নবী। পৃথিবীতে এক কলম লেখাপড়া না করেও কিভাবে তিনি সা: সুচতুর গোয়েন্দা তৎপরতা ও চৌকস রণকৌশলের মাধ্যমে একটি তিনগুণ বড় বাহিনীকে পরাজিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন! কোনো সামারিক জ্ঞানার্জন না করেই কিভাবে তিনি সা: একটি তুলনামূলক বিশাল আক্রমণকারী বাহিনীকে প্রতিরক্ষা রণকৌশল দিয়ে পর্যুদস্ত করে দিলেন। রাসূল সা:-এর সেই যুদ্ধকৌশলই আজকের আধুনিক সমরক্ষেত্রেও অনুসরণ করা হচ্ছে।
তথ্য সূত্র :
১. সিরাত বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ষষ্ঠ খণ্ড-২০০৩
২. নবীজীর যুদ্ধজীবন, ড. আলী মুহাম্মদ সাল্লাবি, আকিক পাবলিকেশন্স, ২০২২।
৩. রাসূলের সা: যুগের যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাস, মাওলানা মুহাম্মদ ফজলুর রহমান আশরাফি, মাইন পাবলিকেশন্স : ২০০২।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
Email: maksud2648@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement