২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


কর্মকর্তারা কার নির্দেশ মানবেন-সরকারের না ইসির

কর্মকর্তারা কার নির্দেশ মানবেন-সরকারের না ইসির। - ছবি : সংগৃহীত

সরকার শাসনতন্ত্রে এমন পরিবর্তন এনেছে যাতে সব সময়ের জন্য ক্ষমতাসীন সরকারকে নির্বাচনে বিজয়ী করতে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রচণ্ড চাপে থাকতে হবে। নির্বাচনকালেও সংসদ অবলুপ্ত করা হবে না। সরকার কোনো ঝুঁকি নিতে যাবে না, নির্বাচনের পর আরো তিন মাস এই সরকার ক্ষমতায় থাকবে; যাতে কোনো ব্যত্যয় হলে সাজা দিতে পারে। এ অসৎ পরিকল্পনার অংশ হওয়া নয়; বরং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারি কর্মকর্তাদের মুক্ত ও নিরপেক্ষ থাকার আবশ্যকীয় শর্ত ছিল। শাসনতন্ত্রে এমনভাবে সংশোধনী আনা হয়েছে যাতে ক্ষমতাসীন সরকার আসন্ন সাধারণ নির্বাচনকালে ক্ষমতায় থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণের ওপর নজরদারি করতে পারে।

এ জন্য সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে জাতীয় পরিষদ বিলুপ্ত করা হবে না। এ ব্যবস্থা করা হয়েছে কোনো রাখঢাক না করে সরাসরি একদলীয় বাকশালী কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে।

শাসনতন্ত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটি যখন সুপ্রিম কোর্টে বৈধতার প্রশ্নে উত্থাপন করা হয় তখন আটজন অ্যামিকাস কিউরির মধ্যে মাত্র একজন বিষয়টিতে ভিন্নমত পোষণ করেন। অন্য সাতজন পরামর্শক সুনির্দিষ্টভাবে জোর দিয়ে বলেন, নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার শাসনতন্ত্রের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। সুপ্রিম কোর্টে একজনের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে কেয়ারটেকার সরকারের বিধানটিকে অবৈধ বলা হয়। অর্থাৎ নতুন সংশোধনী এনে নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।

আসলে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজ করছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভয়াবহ শূন্যতা। সৎ ও অভিজ্ঞ একজন রাজনৈতিক নেতার সাক্ষাৎ পাওয়া দুষ্কর যার উপলব্ধি করার ক্ষমতা এবং বলার সাহস আছে যে, গণতন্ত্রের অর্থ হচ্ছে আইনের শাসন, স্বাধীন বিচার-ব্যবস্থা এবং অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন। ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচনী বিজয় নিশ্চিত করে অন্য সবাইকে বলছে নির্বাচনে আসুন, নির্বাচন স্বচ্ছ ও অবাধ হবে। অর্থাৎ হাত-পা বেঁধে কাউকে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে আহ্বান জানানো হচ্ছে। পুরো জাতিকে আহাম্মক মনে করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের দাবির ভিত্তিতে দলনিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠা করে শাসনতন্ত্রে পরিবর্তন আনা হয় এবং কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়েই দলটি ক্ষমতাসীন হয়েছিল। আবার এ দলটির অধীনে শাসনতন্ত্রের নতুন সংশোধনী পাস করা হয়, যাতে ক্ষমতাসীন সরকারকে বহাল রেখে নির্বাচন সম্পন্ন করে বিজয় নিশ্চিত করা যায়।

রাজনীতি পরিণত হয়েছে দুর্নীতির ব্যবসায়। অথচ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যিনি রাজনৈতিক নেতা হন তিনি জনগণের সেবা করেন নিঃস্বার্থভাবে। নিজেকে ধনী ও ক্ষমতাশালী করতে তিনি রাজনীতিতে যোগদান করেন না।

দুর্নীতির বাজারে কেনাবেচার সুবর্ণ সুযোগ আসে নির্বাচনের সময়। কোন দল কয়টি সিট পাবে কিংবা একটি সিটও পাবে না, সেটি বিতরণ ও নির্ধারণ করবে ক্ষমতাসীন সরকার।

এভাবে লোভী ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা জনগণের নির্বাচনকে সরকার নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে পরিণত করেছে। ব্যক্তিগত ধনসম্পদ বৃদ্ধির জন্য ক্ষমতার একচেটিয়া মালিক বনছে। দুর্নীতির স্রোতে ভেসে চলা সরকার পরিচালনায় কোনো রাজনৈতিক দক্ষতার প্রয়োজন হচ্ছে না। প্রকৃতপক্ষে দেশ আজ লুটেরাদের হাতের মুঠোয়, যারা জনগণের জীবন ও সম্পদের জন্য বিপজ্জনক ও অনিরাপদ অবস্থা সৃষ্টি করছে।

জনগণকে তাদের পছন্দমতো সরকার গঠন করতে দেয়া হচ্ছে না। এ রকম সরকারকে নির্ভর করতে হয় অনিয়ন্ত্রিত দুর্নীতির ওপর এবং ধ্বংস করতে হয় সেই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে যার ওপর ভর করে চলে একটি সৎ ও দক্ষ সরকার।

সুতরাং গতবারের মতো লোভী ও অসৎ লোকদের সহায়তায় সরকার সামনের দরজা দিয়ে বাকশালী একদলীয় শাসন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে ব্যস্ত।

রাজনীতিকে পারিবারিক ব্যবসায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। জনগণের ভোটের ওপর সরকারকে নির্ভর করতে হচ্ছে না বলে সরকারও জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য হচ্ছে না।

নির্বাচনকালীন দলীয় সরকারের কারণে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা অকার্যকর হয়ে গেছে। সরকারি কর্মকর্তারা কার কথামতো কাজ করবেন, প্রধানমন্ত্রীর না নির্বাচন কমিশনের? যদি একটি সৎ ও দেশপ্রেমিক নির্বাচন কমিশন থাকত তাহলে সেই কমিশন থেকে বলা হতো যে, শাসনতান্ত্রিক সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষমতায় থেকে যে নির্বাচনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তার কারণে সাংবিধানিকভাবে অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানে এই নির্বাচন কমিশন অক্ষম। সরকারি কর্মচারীরা সরকারের নির্দেশ না মানলে তাদের চাকরি নিয়েই টানাটানির মধ্যে পড়বেন। নির্বাচন সম্পর্কিত সরকারের আদেশ অমান্য করার ঝুঁকি তারা নিতে পারেন না। নিরপেক্ষ নির্বাচনে দলনিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকারই তো যুক্তিসঙ্গত। অন্যান্য দল যদি ক্ষমতায় না থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে তাহলে ক্ষমতাসীন দল কেন পারবে না?
বর্তমান সরকার শাসনতন্ত্রে এমন পরিবর্তন এনেছে যে, নির্বাচনে বিজয়ী হতে না পারলেও নির্বাচনের পরে ক্ষমতাসীন সরকার আরো তিন মাস ক্ষমতায় থাকবে। তার অর্থ হবে নির্বাচনে কারচুপি করে বিজয় নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে অসুবিধা হবে না।

সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা অন্যান্য দেশেও প্রচলিত আছে। সে সব দেশে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পার্লামেন্ট না থাকলে কোনো নির্বাচিত সরকার থাকে না। আমাদের জ্ঞানের এত বেশি অভাব যে, আমাদের বলতে অসুবিধা হয় না পার্লামেন্ট না থাকলেও নির্বাচিত সরকার থেকে যায়। সুপ্রিম কোর্টে এক ভোটের ব্যবধানের রায়ে বলা হলো, অনির্বাচিত কেয়ারটেকার সরকার বৈধ নয়। সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় পার্লামেন্ট বিলুপ্ত না করে কোন দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তার কোনো দৃষ্টান্ত উল্লেখ ছাড়াই সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হলো, নির্বাচনকালেও নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে হবে। আমাদের দেশের সুবিধাবাদী শিক্ষিত লোকদের পক্ষে সব কিছু বলা সম্ভব। তথাকথিত সুবিধাবাদী লোকদের জন্য জনগণকে নানা ধরনের অন্যায়-অবিচারের শিকার হতে হচ্ছে। দেশের মালিক যে জনগণ সেটি অস্বীকার করা সম্ভব হচ্ছে।

স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা আমাদের অধিকার রক্ষা করতে অপারগ, এটি আমরা গ্রহণ করতে পারি না। বস্তুত, সরকার পরিবর্তনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থা উপেক্ষা করে হিংসা-বিদ্বেষ ও রাস্তার সহিংস আন্দোলনকে উসকে দেয়া হচ্ছে।

লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট


আরো সংবাদ



premium cement