ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
গত ২০০ বছরে পৃথিবীর প্রতিটি দেশে মানুষের আর্থ-সামাজিক ও বৈষয়িক জীবনে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। প্রথমত, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার লক্ষ্য করার মতো। ১০০০ খ্রি. পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ছিল ২৭ কোটি ৫০ লাখ। ১৮০০ খ্রি. নাগাদ এ সংখ্যা হয়েছে ১০০ কোটি। ১৯৮০ খ্রি.-এ ৪৪৫ কোটি, যা ২০২২ এর শেষে ৮০০ কোটিতে পৌঁছেছে। অর্থাৎ ৮০০ বছরে পৃথিবীর জনসংখ্যা বেড়েছে চার গুণ। এর পরের ১৮০ বছরে বেড়েছে সাড়ে চারগুণ। আর পরের ৪০ বছরে বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ২০৫০ খ্রি. নাগাদ পৃথিবীর জনসংখ্যা ৯৭০ কোটিতে দাঁড়াবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এর অর্থ আগামী ৩ দশকে বাড়বে আরো ২১ শতাংশ।
দ্বিতীয়, মানুষের জীবন-জীবিকার বেলায় এক বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। আঠারো শতকে জনসমষ্টির শতকরা ৭০ শতাংশ বা তারও বেশি মানুষের জীবন ধারণের একমাত্র উপায় ছিল কৃষি খাত। এই হার এখন উন্নত দেশগুলোতে নেমেছে ৫ শতাংশেরও নিচে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও কৃষিতে নিয়োজিতদের হার দিন দিন কমছে। ৩০০ বছর আগে শিল্প বিপ্লবের প্রারম্ভ থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ও গতি অনেক বেড়ে গেছে। শিল্প বিপ্লবের সূচনাতে পৃথিবীর মোট জনসমষ্টির তিন-চতুর্থাংশের বাস ছিল বিচ্ছিন্ন পল্লী, ছোট ছোট গ্রামের খামারবাড়ি, কুঁড়েঘর ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শহরে। গ্রামগুলো ছিল একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন। এখন উন্নত দেশগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠের বাস শহর-নগর বা নগরের উপকণ্ঠ এলাকায়। একই ধরনের ক্রমাগত পরিবর্তন ঘটছে প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশেও।
তৃতীয়, ১৮০০ সাল নাগাদ পৃথিবীর জনসমষ্টির বৃহদাংশ বাস করেছে নিদারুণ দারিদ্র্যে। এখন জনসমষ্টির মাত্র একটা লঘিষ্ঠ অংশ তুলনামূলক দারিদ্র্যে দিন কাটায়। আরো মৌলিক দিক থেকে বলা যায়, তখন ভূমিষ্ঠ শিশুর বেঁচে থাকার গড় আয়ু ছিল ৪০ বছর। এখন উন্নত দেশে গড় আয়ু ৮০ থেকে ৮৫, উন্নয়নশীল দেশে ৬০ থেকে ৭০ বছর। প্রাণবিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের বদৌলতে গড় আয়ু দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুর্ভিক্ষ ও অপুষ্টি কার্যত নেই। আধুনিক নারী-পুরুষ তাদের পূর্বপুরুষদের চেয়ে দীর্ঘকায়, শারীরিক দিক থেকে অনেক বেশি সুঠাম দেহের অধিকারী ও উৎপাদনশীল, বহুদিক থেকে স্বাস্থ্যবান ও বলিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আধুনিকতার সুবাদে জীবনযাত্রার সনাতন ধারা অনেক ভাবেই বদলে গেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বেড়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা বদলেছে। জাতীয় আয় বেড়েছে। সেই সাথে তাল মিলিয়ে মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। একই সাথে মানুষের জীবিকার কাঠামোয় বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে।
সনাতন জীবনধারা থেকে আধুনিক জীবনের বিবর্তনে; অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে মানুষের কর্মবৃত্তি ও জীবিকার কাঠামোতে বিশাল পরিবর্তন এসেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি, প্রকৃতি, কারণ ও উন্নয়ন এবং জাতীয় আয় এবং সেই সাথে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নততর পুষ্টিমান ও অপুষ্টিজনিত কারণে স্বাস্থ্যজনিত ভোগান্তি হ্রাস পেয়েছে। এসব মিলে মানবজীবনের যে মানোন্নয়ন ঘটেছে বা মানব সভ্যতার যে আবর্তন ও বিবর্তন ঘটেছে তার অনিবার্য কেন্দ্রবিন্দু হলো কৃষি। কৃষি থেকে শিল্পায়ন ও নগরায়িত সমাজে রূপান্তরিতকরণে ‘ক্রমাগত প্রক্রিয়ায় কৃষির অবদান সন্দেহাতীত’।
সমাজ রূপান্তর
প্রাচীন কৃষি সমাজ থেকে আধুনিক জনসমাজে রূপান্তরিত হওয়ার এই প্রক্রিয়ায় বা আধুনিকায়নে, সনাতন সমাজের কৃষি অর্থনীতি যে অবদান রেখেছে তা নিঃসন্দেহে ধারণা করা যায়। কৃষি খাতের আধুনিকায়ন ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো ছাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন সম্ভব হতো না। কৃষির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, সমাজের শিল্পায়ন ও আধুনিকায়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমাজের উন্নয়ন, পরস্পর নিবিড় সম্পর্কিত। এ সম্পর্ক লতা-পাতার মতো জড়ানো। এ সম্পর্ককে আলাদা করে দেখা সম্ভব নয়।
সমাজের আধুনিকায়ন ও শিল্পায়নের সাথে তাল মিলিয়ে মানুষের চাহিদার ভিত্তিতে একদিকে যেমন পণ্য উৎপাদনের উপাদানের চাহিদা বেড়েছে, অন্য দিকে পল্লী পণ্য ও সেবার চাহিদাও বেড়েছে। সেই সাথে জমি, শ্রম ও মূলধনের মতো উৎপাদনের উপাদানের বাজারেও পরিবর্তন এসেছে। পল্লীর একান্ত দরিদ্র মানুষের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শ্রমবাজার। বলার অপেক্ষা রাখে না, দরিদ্র লোকের হাতে তেমন জমি বা মূলধন থাকে না। শ্রম হলো তাদের একমাত্র মূলধন। পল্লীর কৃষিপণ্য ও পরিষেবার চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে পল্লীর কৃষিবহির্ভূত অর্থনীতি বিকশিত হয়। কৃষিবহির্ভূত পণ্য উৎপাদন বাড়লে শ্রমের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ে। শ্রমের বর্ধিত চাহিদা মজুরি বৃদ্ধির চাপ বাড়ায়। এতে করে পল্লীর দরিদ্র মানুষের আয় বৃদ্ধি পায়। দরিদ্রতা হ্রাস পায়। গ্রামীণ সমাজে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে এবং দরিদ্রতা হ্রাসের সুযোগ সৃষ্টি করে। দারিদ্র্য কমানোর এটি একটি অবিসংবাদিত পথ বলে ধারণা করা যায়।
সাধারণ্যে স্বীকৃত ধারণা
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে কৃষি খাত সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এই ধারণাটি এখন সর্বজনীন পর্যায়ে গৃহীত একটি বাস্তবতা। এতদসত্ত্বেও ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত অর্থনীতিতে শিল্পায়ন ও নগরায়নের তুলনায় কৃষি খাতকে পরোক্ষ বা গৌণ ভূমিকায় দেখা হতো। তখনকার ধারণা অনুযায়ী অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি বা বিনিয়োগকে প্রয়োজনীয় মনে করা হতো না। এটা কোনো তত্ত¡ না হলেও, এটাই ছিল বদ্ধমূল ধারণা। কৃষি খাতের প্রতি তুলনামূলক এই অবহেলার অন্যতম কারণ হয়তো বা অর্থনীতিবিদদের অনুমিত ধারণার মাঝে নিহিত ছিল। তাদের ধারণা ছিল যে শিল্পায়ন ও নগরায়নের জন্য বিপুল সম্পদ বা মূলধনের বরাদ্দ প্রয়োজন। কৃষির উন্নয়নে খুব একটা বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। বিনিয়োগ কম করলেও কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি থেমে যাবে না। অতএব, কৃষি খাতের বদলে শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়ালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের গতি বাড়বে। তাতে কৃষি খাতের তেমন ক্ষতি হবে না। এর আরেকটি কারণ হতে পারে, ১৯৫০-এর দশক অবধি কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম সহযোগী বা অঙ্গ উপাদান হিসেবে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। এ কারণেও কৃষি খাত বহুদিন উপেক্ষিত থেকেছে।
ইতিহাসের বিবরণী থেকে এটা প্রমাণিত যে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে শিল্পায়ন ও সেবা খাতের ক্রমবর্ধমান সম্প্রসারণ ঘটে। এতে সমাজে কৃষি খাতের অবদান না কমলেও মোট অর্থনীতিতে তুলনামূলকভাবে কৃষির হিস্যা বা ভাগ ক্রমাগতভাবে কমে যায়। কৃষি খাতকে ধরে নেয়া হয়েছে, এই খাত হলো উৎপাদনশীলতার একটা উৎস। উৎপাদনশীলতার ফলে যে বর্ধিত আয় হয়, সেই আয় শিল্পায়ন ও সেবা খাতে বিনিয়োগ করে দ্রুত গতিতে প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত কৃষি খাতের অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে ব্যাপকতর পর্যায়ে আদৌ আলোচিত হয়নি বা বোধগম্য হয়ে ওঠেনি। কিংবা কৃষির আধুনিকায়ন ও উৎপাদনশীলতা এবং অর্থনীতির বিকাশ, প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন একই সূত্রে গাঁথা, এ বাস্তবতাটি সবার কাছে গৃহীত ছিল না।
‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে কৃষির ভূমিকা উপেক্ষিত থাকার আরেকটি অন্যতম কারণ সম্ভবত উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতিতে কৃষি খাতের তুলনামূলক অবদান (হিস্যা) স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমে যাওয়া। যতোই কৃষির আধুনিকায়ন ঘটেছে, উৎপাদনশীলতা ও মোট উৎপাদন বেড়েছে, ততোই মোট জমির প্রয়াজনীয়তা ও কৃষি শ্রমের চাহিদা কমেছে। একই সাথে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে কৃষি খাতের অবদান (হিস্যা) ক্রমাগতভাবে কমে গেছে- ‘এটি প্রকৃত সত্য।’ ফলে নীতিনির্ধারকরা কৃষি খাতে বিনিয়োগ করতে তেমন আগ্রহ দেখায়নি। কেননা, আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় কৃষি খাতে যতই বিনিয়োগ করা হোক বা অবদান যাই হোক, অর্থনীতিতে কৃষি খাতের হিস্যা বা ভাগ সঙ্কুচিত হয়ে যায়। এ কারণেই হয়তো বা নীতি-নির্ধারকরা শিল্প খাতের আধুনিকায়নেই অধিকতর মনোযোগ দিয়েছেন। তাতে কৃষি খাতের সৃষ্টি করা সম্পদ শিল্প খাতে স্থানান্তরিত হয়েছে। কার্যত দরিদ্র চাষিদেরকে শোষণ করার মাধ্যমে এটা করা হয়েছে।
গরিব থেকে গরিবের নিকট সম্পদ হস্তান্তর
বহু উন্নয়নশীল দেশে, সরকার দরিদ্র ও অপেক্ষাকৃত কম বেতনে নিয়োজিত শিল্প শ্রমিকদের (তবে সত্যিকার অর্থে বলা যায়, শিল্প মালিকদের) সুবিধার জন্য মূল খাদ্যশস্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে। বিশেষ করে মূল খাদ্যের (Staples) যেমন; চাল, গম ইত্যাদি। এ কারণে প্রায়ই কৃষক তার ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। সরকারের এ ধরনের নীতিকে কৃষি খাত থেকে আর্থিক সম্পদ সরিয়ে নিয়ে, শিল্প ও সামাজিক খাতকে সমৃদ্ধ করার একটা উপায় বলে ধরে নেয়া হয়। মূল খাদ্যের দাম কম থাকলে শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের মজুরি কম রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এ নীতির লক্ষ্য হলো প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে শিল্পপণ্যের উৎপাদন করা। ব্যবস্থাটি বলাবাহুল্য কৃত্রিম। যুক্তি যাই হোক এর ফল হলো, এক গরিব গোষ্ঠীর সম্পদ, আরেক গরিব গোষ্ঠীর কাছে হস্তান্তর করা। শিল্প মালিকদের লাভ করতে সহায়তা করা। যাতে শিল্পে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়ে। এই ধরনের নীতি-কৌশল ধনী-গরিবের মাঝে সম্পদের বিলি-বণ্টন করা নয়; বরং বলা যায় এটা হলো আঁকা বাঁকা পথ অবলম্বনে গরিব জনগোষ্ঠীর সীমিত সম্পদ, ধনীদের (শিল্প মালিক) কাছে হস্তান্তর করা। যেমন শিল্প শ্রমিকের মজুরি কম থাকলে, উৎপাদন খরচ কম থাকে। তাতে শিল্প মালিক-ধনী গোষ্ঠীর মুনাফা বেশি করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাতে যা হওয়ার তাই হয়। ধনী আরো ধনী হয়। এতে সমাজে ধনী-গরিবের বৈষম্য আরো বেড়ে যায়। কৃষক শ্রেণী অধিক উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হয়। তাতে খাদ্য উৎপাদন কমে যায়। পাশাপাশি দাম বেড়ে যায়। এতে দুর্নীতি, দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও অপুষ্টি, ইত্যাদি সব বেড়ে যায়। এ অবস্থায় কালোবাজারি, দুর্নীতিবাজ ও ধনী শ্রেণী বেশি উপকৃত হয় এবং সুবিধা ভোগ করেন।
পুঁজিবাদ রক্ষায় কৃষিতে বিনিয়োগ
১৯৫০-এর দশকে বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও কৃষিতে উৎপাদনশীলতা কমে যায়। ফলে কৃষি পণ্যের উৎপাদন বাড়েনি এবং বর্ধিত জনসংখ্যার অনুপাতে খাদ্যের জোগান কমে যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যাও দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে দারিদ্র্য ব্যাপকতা লাভ করে। দুর্ভিক্ষ, মহামারী, অপুষ্টিজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা দেশে দেশে প্রকট আকার ধারণ করে। ধনী-দরিদ্র্যের বৈষম্য বেড়ে যায়। বহু দেশে আন্দোলনের দামামা বেজে উঠে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে ওই সংগ্রাম, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে হলেও, প্রকৃতপক্ষে ওই আন্দোলন-সংগ্রাম ছিল, তখনকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বিদ্যমান সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে। কালক্রমে এটি আন্দোলনে রূপ নিয়ে প্রসারিত হতে থাকে। একই সাথে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন নামে ও বিভিন্ন চেহারায়, কমিউনিস্ট (সাম্যবাদী) আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। ফলে গরিব বা অনুন্নত দেশগুলোতে কৃষি খাত (খাদ্য উৎপাদনের একমাত্র খাত) রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারকদের মাঝে শীর্ষ আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। বলতে গেলে তারা বাধ্য হয়। অনন্যোপায় হয়ে, উন্নত দেশগুলো সাম্যবাদী দর্শন থেকে পুঁজিবাদী সমাজ রক্ষায়, অনুন্নত দেশে কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোকে হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে আসে। ওই সময় কৃষি গবেষণা ও সম্প্রসারণ, কৃষি উপকরণ সরবরাহ, কৃষি পণ্যের বাজারজাতকরণ, কৃষি ঋণদান কার্যক্রম, সেচ ও অন্যান্য অবকাঠামো খাতে প্রচুর দেশীয় ও বৈদেশিক সম্পদ বিনিয়োগ করা হয়। যদিও এ বিনিয়োগের মূল উদ্দেশ্য ছিল কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি, উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর মাধ্যমে কৃষি পণ্যের উৎপাদন বাড়ানো এবং দরিদ্রতা ও ক্ষুধা হ্রাস করা। তবে অনেকে মনে করেন যে আন্দোলনের মাধ্যমে অগ্রসরমান সাম্যবাদের বিরুদ্ধে এটা ছিল পশ্চিমা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর এক মানবিক হাতিয়ার। কারণ যাই হোক, এর ফলে দেশে দেশে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে।
বিনিয়োগে ভাটা ও কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি
১৯৯০-র দশকের মাঝামাঝি উন্নয়নের অনুঘটক হিসাবে, কৃষিখাতে বিনিয়োগের প্রশ্নে নীতি-নির্ধারকদের আগ্রহে পুনরায় ভাটা পড়তে শুরু করে। দাতা ও নীতি-নির্ধারকরা তাদের মনোযোগ সামাজিক খাত যেমন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে সরিয়ে নেন। ইতোমধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম সাম্যবাদী দেশ চীন অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে পুঁজিবাদী দর্শনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। দ্বিতীয় বৃহত্তম সাম্যবাদী দেশ রাশিয়া ভেঙে যায়। পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের পুরনো অর্থনৈতিক দর্শন থেকে সরে এসে পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলোর সাথে মিলিত হয়ে যায়। ইতোমধ্যে অধিক বিনিয়োগের ফলে বিশ্ব্যে খাদ্য উৎপাদন বেড়ে যায়। বিশেষ করে মূল খাদ্যের যেমন ধান, গম, ভুট্টা ইত্যাদি। এসবের ফলস্বরূপ হয়তো বা নীতি-নির্ধারকদের দৃষ্টি অন্য দিকে সরে যায়। এ কারণে বিশ্বের বহু দরিদ্রতম ও সবচেয়ে কম উন্নত দেশের কৃষি খাতে বিনিয়োগ কমে যায়।
২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি এসে কৃষি পণ্যের দাম আবার বাড়তে শুরু করে। বিভিন্ন কারণে ওই দশকের শেষের দিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খাদ্যসঙ্কট বেড়ে যায়। ফলে খাদ্য-পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এ ছাড়া খাদ্য উৎপাদনে বহুমাত্রিক সমস্যার ফলে ফসলের ফলন কমে যায়। যেমন- জলবায়ুর পরিবর্তন, কোনো কোনো দেশে অতিবৃষ্টি ও বন্যা। কোনো কোনো দেশে অনাবৃষ্টি ও খরা। তাছাড়া জৈব জ্বালানি উৎপাদনের জন্য খাদ্য ফসলের ব্যবহার। যেমন; ভুট্টা, সয়াবিন, ইক্ষু থেকে তেল উৎপাদন। এ ছাড়া ক্রমাগত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা কমে যাওয়া; নগরায়নের সাথে তাল মিলিয়ে কৃষি জমি কমে যাওয়া; নগরায়ন-শিল্পায়ন-আধুনিকায়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে খাদ্য উৎপাদন বাড়েনি। তা ছাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সাথে সমাজের ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন খাদ্যের চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদনে পৃথিবীর সামর্থ্য নিয়ে সংশয় বেড়ে যায়। এখানে ধর্তব্যে আনা প্রয়োজন কৃষি পণ্যের উৎপাদনের দুই প্রধান উপাদান (রাসায়নিক সার ও কীটনাশক) এবং ইন্ধনশক্তির মূল্যের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। সার ও কীটনাশক হলো আধুনিক কৃষি উৎপাদনের অন্যতম বড় বিনিয়োগ। এ দুটো উপাদানের মূল উপাদন বা অঙ্গ হলো জ্বালানি। ওই সময়ে জ্বালানির মূল্যও বাড়তি ছিল। এসব কারণে বহু খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়।
আগেই বলা হয়েছে যে, ১৯৬০-এর দশকে কৃষি খাতে বর্ধিত বিনিয়োগের ফলে বিশ্বের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য যেমন ধান, গম, ভুট্টা, আলু এসব ফসলের ফলন বহুগুণ বেড়ে যায়। মানব ইতিহাসের কালপরিক্রমায় একে বলা যায় ‘এ যেন খাদ্য উৎপাদনে এক উল্লম্ফন’। খাদ্য সঙ্কট উত্তরণে এটা ‘সবুজ বিপ্লব’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। তবে পরবর্তীকালে (২০০০) খাদ্য উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার কমে যেতে থাকে।
এ কারণে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, আগামী দশকগুলোতে খাদ্যমূল্য দ্রুত হারে বেড়ে যাওয়া রোধ করতে হলে কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। অর্থাৎ বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে নীতি-নির্ধারকদের নতুন করে মনোযোগ দেয়া জরুরি।
সাম্প্রতিককালে কৃষি খাতের উন্নয়নে পুনরায় নতুন আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এই নতুন ধারণায় উদ্দীপ্ত হওয়ার মূল কারণ হলো; বিশ্বের বহু দেশের পল্ল্লী অঞ্চলে মানুষের দরিদ্রতা হ্রাসের হার কমে গেছে। ফলে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা যেমন হ্রাস পাচ্ছে না, তেমনি বহু দরিদ্র দেশে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া ও সাহারার দক্ষিণাঞ্চলের দেশগুলোতে অপুষ্টিও তেমন কমেনি। বিভিন্ন তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, এখনো বিশ্বের ৮০ কোটি মানুষ ক্ষুধা নিয়ে ঘুমোতে যায়। তারা অপুষ্টিতেও ভুগছে। অপুষ্টিজনিত কারণে রোগ-ব্যাধির প্রকোপ বেড়েছে। সেই সাথে জলবায়ুর ঝুঁকি ও কৃষি জমি কমে যাওয়া, এ সবই ফসল উৎপাদনকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। অতএব, কৃষি খাতের স্থবির উৎপাদনশীলতাকে গতিশীল করে উৎপাদন বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে সবাই এখন এক মত। তবে কৃষি উৎপাদনের কতকগুলো অনন্য বৈশিষ্ট্য ও সমস্যা আছে, সেগুলো কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজন নতুন প্রযুক্তি ও প্রচুর বিনিয়োগ।
কৃষি উৎপাদনের অনন্য বৈশিষ্ট্যাবলি
উন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কৃষি উৎপাদনের কাঠামো ও পদ্ধতি অনেকটা ভিন্ন। কৃষির বৈশিষ্ট্যগুলো শিল্প খাতের মতো নয়। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কৃষি উৎপাদনের বেশ কিছু বিশিষ্ট্যতা ও অনন্যসুলভ বৈশিষ্ট্যতা আছে। যেমন;
ক. কৃষি খাতের প্রধান ভূমিকা হলো মানুষের সবচেয়ে মৌলিক চাহিদার (খাদ্যের) জোগান দেয়া। সাবান, লোশন, ইত্যাদি না হলে কয়েক দিন চলে, কিন্তু খাদ্য প্রতিদিন প্রয়োজন। তাই দেশে চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা একান্ত জরুরি বিষয়;
খ. উৎপাদনের জৈব প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীলতা;
গ. উৎপাদনের বৈশিষ্ট্য মৌসুমি; এর কারণ গোটা বছর ধরে বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রার ভিন্নতা;
ঘ. বিপুল সংখ্যক উৎপাদক ও উৎপাদনের ইউনিট (ছোট কৃষি খানা, ক্ষুদ্র চাষি, এমনকি ভূমিহীন চাষি);
ঙ. উন্নয়নশীল দেশে কৃষিপণ্য উৎপাদকদের প্রায় সবাই একটি অংশ দিয়ে প্রথমে নিজ প্রয়োজন মেটায়;
চ. কৃষি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন অনেক জমি। সব উৎপাদকের জমি নেই। আর এ উৎপাদন হয় ভৌগোলিকভাবে ছড়িয়ে থাকা নানা অঞ্চলে;
ছ. এক এক জমিতে (মাটি) এক এক ধরনের ফসলের উপযোগিতা;
জ. অধিকাংশ কৃষি পণ্যের উৎপাদক বা চাষি তেমন শিক্ষিত নয়। তাদের জমি নেই, বা থাকলে নিতান্তই কম; আর্থিক মূলধনের অভাবে ভোগেন। তাই তাদের আর্থিক ঝুঁকি নেয়ার ক্ষমতা নেই;
ঝ. মৌসুমি ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া নির্ভর উৎপাদন বিধায় কৃষিতে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। তাই গরিব চাষিরা ঋণগ্রহণ করে বিনিয়োগে সাহস পায় না;
ঞ. কৃষি পণ্যের বাজারদরে ওঠা-নামার ঝুঁকি অনেক বেশি। এসব ঝুঁকি এড়াতে তারা সনাতন ফসল, বীজ ও আবাদের পদ্ধতিতে বেশি আস্থা রাখেন।
কৃষি পণ্য উৎপাদনে এই বিচিত্রতা, ভিন্ন ধরনের প্রকৃতি ও অনন্য বৈশিষ্ট্যের কারণে এগুলোর মিথষ্ক্রিয়া ঘটে নানাভাবে, ভিন্ন ভিন্ন কারণে, ভিন্ন ভিন্ন দেশে। কোনো সময় প্রত্যক্ষ, আবার কোনো সময় পরোক্ষভাবে। ফলে এই মিথষ্ক্রিয়ার ফলাফল, এক এক সময়ে এক এক রকম, বলতে গেলে বিচিত্র ধরনের। এসব বিচিত্রতার কারণে কৃষি উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে কৃষি খাতে নিয়োজিত উদ্যোগ প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা ও ব্যবস্থাপনা যেমন অতীব গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ব্যতিক্রম, অসাধারণ ও অস্বাভাবিক। যথা সময় যথা মাফিক বৃষ্টি হবে কি না, ফলন কতটুকু হবে, ফসলের দাম কী হবে, বিনিয়োগ উঠে আসবে কি না, এসব বিষয়ে অনিশ্চয়তা, কৃষি পণ্য উৎপাদনের সমস্যাকে আরো জটিল করে তোলে। এসব সমস্যা সমাধান করে, কৃষি পণ্য উৎপাদনের সুযোগ-সম্ভাবনাকে পুরোপুরি বা যথাসম্ভব কাজে লাগানোর মাঝেই নিহিত রয়েছে জনগোষ্ঠীর চাহিদা মোতাবেক উৎপাদন বৃদ্ধি করে খাদ্য জোগান দেয়ার সামর্থ্য।
মৌসুমি উৎপাদন ও ফসলের বাজার মূল্যে অস্থিরতা
একান্ত প্রকৃতিগত কারণেই কৃষিকাজ ও উৎপাদন হলো মৌসুমি, সর্বকাল্লীন নয়। এক এক মৌসুমে এক এক ফসলের উৎপাদন। এ কারণে সময়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কৃষিতে শ্রম ও উপকরণের চাহিদা, মূলধন বিনিয়োগের ওঠা-নামা, দামের অনিশ্চয়তা এগুলো হলো কৃষি খাতের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। একই কারণে কৃষি উৎপাদনের উপাদান, পণ্যের সরবরাহ, দাম ও আয়ও মৌসুমি চরিত্রের। মৌসুমি কৃষির তাৎপর্য হলো এই কর্মতৎপরতার জন্য বিশেষ সময়। কৃষি উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদনের জন্য নির্ধারিত সময় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিপঞ্জিকার সময়ের সাথে সম্মিলিত আবহাওয়ার অবস্থা যদি সামঞ্জস্য না হয়, অথবা যথাসময় শ্রম ও উপকরণে বিনিয়োগ করা না হয় তাহলে ফলন, খাদ্য সরবরাহ, খাদ্যমূল্য, উৎপাদকের আয়, কৃষক ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে নগদ অর্থ প্রবাহ, এবং কৃষিবহির্ভূত ক্রিয়াকাণ্ডকে অনিশ্চিত করে তোলে এবং কৃষি খাতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জীবনমানে নানাভাবে গুরুতর রকমে প্রভাবিত করে। এই অনিশ্চয়তা; প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ- যে কোনো কারণেই দেখা দিতে পারে। সরকারের ভুল ও বিতর্কিত নীতিও এর কারণ হতে পারে।
আবহাওয়া ও জৈবপ্রক্রিয়ার কাছে কৃষক অসহায়। উৎপাদনের সময় ও উপাদান তাদের হাতে থাকলেও, ফলনের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নেই। তারা অনুমানও করতে পারে না যে এ মৌসুম বা পরের মৌসুমে কী পরিমাণ ফলন হতে পারে। ফসলের মূল্যের ওঠা-নামার ওপরও তাদের কোনো হাত নেই বরং তারা ফসলের মূল্য ওঠা-নামার অসহায় শিকার।
নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে চাষিদের প্রাথমিক অনীহা
ফলনের অনিশ্চয়তা, ফসলের বাজার দরে অনিশ্চয়তা ও উদ্বায়িতা (Volatility) সঞ্চয়হীনতা বা সঞ্চয়ের ঘাটতি, সাধ্যের মধ্যে কম খরচে ঋণ নেয়া ও পাওয়ার সমস্যা, ঝুঁকি কমাতে কৃষি বীমা স্কিমের অনুপস্থিতি, ফলন বা ফসলহানির বিরুদ্ধে পরিপোষণের (support) কোনো ব্যবস্থা না থাকার কারণে, ফলনে অনিশ্চয়তা দেখা দিলে অনুন্নত দেশের কৃষক সমাজে এক ধরনের তাৎপর্যপূর্ণ বৈরী প্রভাব ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এসব একত্রে মিলে গরিব চাষিদের মাঝে কৃষি উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণে অনীহা দেখা দেয়। আর্থিক ঝুঁকি নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। যদিও এসব নিত্য-নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করলে ফলন বাড়ে। ফলন বাড়লে উৎপাদন খরচ কমে যায়। তাতে গরিব চাষিরা আর্থিক দিক থেকে বেশ উপকৃত হতে পারে। কিন্তু চাষিরা মনে করে যে সনাতনী কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারে ফলন কম হলেও, সুবিধা হলো এগুলো স্থানীয় পরিবেশের উপযোগী এবং আর্থিক ঝুঁকিও ন্যূনতম। তাদের আর্থিক ঝুঁকি নেয়ার সামর্থ্য নেই। অথচ ঝুঁকি না নিলে, লাভ কম হবে। যত দিন লাভ কম হবে, ততো দিন তারা গরিব থাকবে। তাতে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হওয়া তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে উঠে। এতদসত্ত্বেও কৃষক সমাজ প্রথম দিকে নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ বা ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করে।
সবুজ বিপ্লব
১৯৬৫ সালে আমি যখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে লেখাপড়া করি তখন একজন জাপানি (অনুবাদকসহ) প্রায়ই শহরের আশপাশের গ্রামগুলোতে ঘোরাফেরা করতো। প্রতি দিন সে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে কৃষকদের বিরি (ইজজও) ধান আবাদে উৎসাহ উদ্দীপনা জোগাতো। ফলন অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও কৃষকরা শুষ্ক মৌসুমে সেচের সাহায্যে পানির জোগান, সার ও কীটনাশকে বিনিয়োগে আগ্রহ থাকলেও ঝুঁকি নিতে সাহস পেতো না। অথচ বর্তমানে বাংলাদেশে কৃষকরা বিরি ধানের প্রতি বেশি আকৃষ্ট। এ জাতের উৎপাদনশীলতা বেশি বিধায় বোরো মৌসুমে একরপ্রতি ধানের উৎপাদন হয় বেশি। ধান সবচেয়ে বেশি উৎপন্ন হয়। মোট কথা হলো প্রযুক্তি যাই হোক, প্রথম দিকে গরিব কৃষকরা ঝুঁকি নিতে সাহস পায় না।
নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর প্রক্রিয়াটি কালক্রমে ‘সবুজ বিপ্লব’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। সঙ্কট মুহূর্তে সমাধানের শুভ লক্ষণ হিসেবে এ নামে পরিচিত। এই সবুজ বিপ্লব ঘটে ১৯৬০-এর দশকে। এর প্রেক্ষাপট নিয়ে আগেই আলোচনা করা হয়েছে। এ বিপ্লবের মূল ভিত্তি ছিল উচ্চ ফলনশীল বীজ। একই সাথে উপকরণ হিসেবে রাসায়নিক সার (কৃত্রিম) ও কীটনাশকের ব্যবহার। এসব উপকরণ ব্যবহারের মূল শর্ত হলো; ভূমি ও সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণের মাধ্যমে পানি ব্যবস্থাপনা।
নতুন প্রযুক্তির পক্ষে যুক্তি হলো; কৃষি জমির অভাব হলেও শ্রম ও মূলধনের সবচেয়ে দক্ষ সদ্ব্যবহার করা সম্ভব। তাতে এক দিকে খাদ্যের জোগান বাড়বে, অন্য দিকে গ্রামীণ জনসমাজে বেকারত্ব কমবে। তা ছাড়া এই প্রযুক্তি কার্যত বস্তু নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতশূন্য। শ্রম ও বিনিয়োগ হবে আনুপাতিক, অথবা সমানুপাতিক। ছোট বড় সব চাষি এ প্রযুক্তি কাজে লাগাতে পারে। চাষির জমির আয়তন অনুযায়ী উপকরণ খাতে বিনিয়োগ করবেন। ফলন ও আয় সেই অনুপাতেই হবে। ফলে এই প্রযুক্তির ব্যবহার দারিদ্র্য কমানো ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক দারুণ সম্ভাবনা নিয়ে আসে। গোড়ার দিকে এ প্রযুক্তির ব্যাপারে সবাই প্রচুর আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কেননা, উচ্চ ফলন মানেই খাদ্য সরবরাহ বাড়বে। একই সাথে কৃষকের আয় বেশি হবে।
১৯৯০ এর দশকে ওই প্রাথমিক উদ্দীপনা স্তিমিত হয়ে আসে। এমনকি অনেকে বিরোধিতা শুরু করেন। বিরোধিতার মোক্ষম যুক্তি হলো; এ প্রযুক্তি ব্যবহারে বড় চাষিরা অপেক্ষাকৃত বেশি উপকৃত হয়। ছোট চাষিদের উপর বরং নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে যুক্তি যাই হোক, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, উন্নত ও উন্নয়নশীল, উভয় শ্রেণীর দেশেই সবুজ বিপ্লবের ফলে গড় খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ বেড়েছে। মূল খাদ্যের মূল্য স্থিতিশীল থেকেছে। তাতে দরিদ্র লোকদের খাদ্যের প্রাপ্যতা ও জোগান দেয়ার ক্ষমতা বেড়েছে।
সাম্প্রতিককালে সবুজ বিপ্লবের সামাজিক ফলাফল সম্পর্কিত অভিমতের পাল্লা মাঝামাঝি জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারে কৃষিতে উৎপাদনশীলতা ও মোট উৎপাদন বেড়েছে তা এখন সর্বজনীন স্বীকৃত। একই সাথে সবুজ বিপ্লবের উপকারিতা বা ন্যায়বিচার-বণ্টনের প্রশ্নে পার্থক্যের মূল্যায়ন বা অধিমূল্যায়ন যাতে না ঘটে, সে দিকেও সবাই সতর্কতা অবলম্বন করছেন। এই প্রযুক্তির বিরুদ্ধে অন্য সব যুক্তি হলো; ফসলের বৈচিত্র্য কমে গেছে। এর কারণ, হাইব্রিড বা উচ্চ ফলনশীল প্রজাতির কারণে ফসলের জাতের সংখ্যা কমে গেছে। কমতে কমতে হাতেগোনা কয়েকটিতে এসে ঠেকেছে। ইদানীং এসব ফসলের ওপর রোগ-ব্যাধি ও পোকার আক্রমণ বেড়েছে। তাতে রাসায়নিক ওষুধ ব্যবহারের মাত্রা বেড়ে গেছে। তবে প্রাণপ্রযুক্তি ও অন্যান্য গবেষণার মাধ্যমে এসব সমস্যার প্রতিকারও খোঁজা হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে এমন সব জাতের ফসল উদ্ভাবন করা হচ্ছে যেগুলো পোকা ও রোগবালাই এর বিরুদ্ধে অনেক বেশি প্রতিরোধক।
লেখক : এমএসসি- কৃষি অর্থনীতি সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা