১৯ মে ২০২৪, ০৫ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলকদ ১৪৪৫
`


যে সব কারণে করের বোঝা বাড়তে পারে আগামী বাজেটে

- ছবি - বিবিসি

চলতি অর্থবছরে প্রত্যাশিত কর সংগ্রহ করতে না পারার কারণে আগামী বাজেটে কর সংগ্রহের বড় চেষ্টা থাকতে পারে সরকারের। সে ক্ষেত্রে আরো বেশি মানুষকে করের আওতায় নিয়ে আসা হতে পারে বলে ধারণা দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।

গতকাল রোববার বাংলাদেশের বাজেট নিয়ে এক আলোচনায় অর্থনীতিবিদরা বলছেন যে চলতি অর্থ বছরে দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। নতুন সরকারের আগামী বাজেট নিয়ে এই সংলাপের আয়োজন করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ বা সিপিডি।

এবার বাজেটের আগে অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অভ্যন্তরীণ ও বিদেশী ঋণের ঝুঁকি বাড়ছে, প্রবৃদ্ধির ধারা কমার কারণে কম কর সংগ্রহের মতো বিষয়গুলোকে মূল সঙ্কট হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।

সিপিডি’র সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘প্রবৃদ্ধির ধারা শ্লথ হওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রে যে শুল্ক ছাড় পাওয়া যেত সেটা আগামী বাজেট থেকে তুলে নেয়া হতে পারে। সেইসাথে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাবে আইএমএফ-র শর্তের কারণে অনেকে যে প্রণোদনা পাচ্ছিল সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে তুলে নিতে হবে।’

আগামী বাজেট নিয়ে এই সংলাপে একটি জরিপ রিপোর্ট প্রকাশ করে সিপিডি। যেখানে বলা হয়, এই জরিপে অংশগ্রহণকারী ৬৪ শতাংশ মানুষ মতামত দিয়েছেন আগামী বাজেট নিয়ে তারা কোনো প্রত্যাশা করেন না।

জরিপের তথ্য তুলে ধরে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘জরিপে তিনটি বিষয় পরিষ্কার। সবার আগে তারা শোভন কর্মসংস্থান চায়, মানসম্মত শিক্ষা চায়, সম্প্রসারিত সামাজিক সুরক্ষা চায়।’

এই সংলাপে অংশ নিয়ে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী ড. আব্দুল মান্নান বলেন, ‘প্রবৃদ্ধি যে এত সহজে নেমে যাবে এটা বলার সুযোগ নাই। দেশের প্রবৃদ্ধি সামান্য নেমেছে। কিন্তু বলা হচ্ছে অর্ধেক নেমে গেছে। এর ফলে মানুষের কাছে এক ধরনের ভুল বার্তা যায়।’

অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ মূল্যস্ফীতি
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চে দেশের মূল্যস্ফীতি ছিল নয় দশমিক ৮১ শতাংশ। গত দুই বছর ধরে দেশের মূল্যস্ফীতি অনেকটা বেশি। আর গত এক বছর ধরে দেশের এই মূল্যস্ফীতি রয়েছে নয় শতাংশের ওপরে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি আগামী বাজেটের আগে যে তিনটি সঙ্কটকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় সঙ্কট হলো মূল্যস্ফীতি।

সিপিডির গবেষণা তথ্য বলছে, চলতি বছরের মার্চের তথ্য অনুযায়ী দেশে মূল্যস্ফীতি প্রায় ৯.৮১ শতাংশ। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি নয় দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং খাদ্য বাদে অন্যান্য জিনিসে মূল্যস্ফীতি নয় দশমিক ৬৪ শতাংশ।

সেমিনারে অর্থনীতিবিদরা বলেন, গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এটি এখন অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে চলেছে, যা মানুষের জীবন মানকে আঘাত করছে।

মূল্যস্ফীতি পিছিয়ে পড়া মানুষের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপভাবে প্রভাব ফেলছে। কখনো কখনো বাড়ছে বাল্য বিয়েও।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়লেও মানুষের বেতন বাড়ছে না। তাতে কিন্তু নতুন দরিদ্র তৈরি হচ্ছে। এবারের বাজেটের লক্ষ্য হবে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে কিভাবে আরো অন্তর্ভুক্ত করা যায়। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে মানু্ষকে আরো যুক্ত করতে হবে।’

এই মূল্যস্ফীতির প্রভাব নিয়ে গবেষক ও সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির সাথে মানুষের মজুরি বাড়ছে না সমান্তরালভাবে। এর ফলে অনেকের জীবন মান দারিদ্রসীমার নিচেও নেমে যেতে পারে। এটি একটি বড় সমস্যা।’

কারণ হিসেবে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, মূল্যস্ফীতি বাড়লে বিভিন্ন কাঁচামালের দাম বাড়ে, পরিবহন খরচ বাড়ে।

এ কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার ফলে অনেক সময় পণ্য উৎপাদনে প্রতিযোগিতার সক্ষমতাও অনেক সময় চলে যায়।

বাড়ছে দেশী-বিদেশী ঋণের ঝুঁকি
সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ বা ইআরডি-র সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বিদেশী ঋণের সুদাসল পরিশোধ বাবদ খরচ বেড়েছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৮৯ কোটি ডলার।

ইআরডির প্রতিবেদন বলছে, গত নয় মাসে সব মিলিয়ে ২৫৭ কোটি ডলারের বেশি সুদ ও আসল পরিশোধ করা হয়েছে। গত বছর একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১৭৩ কোটি ডলার। বিদেশী ঋণ পরিশোধের এই চাপ এসেছে এমন এক সময়ে, যখন দেশে কয়েক মাস ধরে বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট চলছে।

এই সংলাপে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, বর্তমানে জিডিপির ৩৭ শতাংশ সরকারের ঋণের পরিমাণ। আরো পাঁচ শতাংশের ওপর ব্যক্তি খাতের ঋণ রয়েছে। জিডিপির প্রায় ৪২ শতাংশ বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণ। এর ফলে বিনিময় হারের ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। টাকার বিনিময় হারের অবনমন ঘটছে।

সংলাপে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ‘আগে বলা হতো বাংলাদেশ কখনো ঋণ খেলাপি করেনি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে কমপক্ষে পাঁচ বিলিয়ন ডলার আমরা দিতে পারছি না। অপরিশোধিত রয়েছে।’

বিবিসি বাংলাকে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সরকারেরর যেটুকু সম্পদ আছে, তার একটা বড় অংশ ঋণের দায় শোধ করার জন্য চলে যাচ্ছে ‘

বিশেষ করে রাজস্ব ব্যয়ের এক তৃতীয়াংশের বেশি যদি ঋণ পরিশোধ এবং সরকারি বেতন ভাতায় চলে যায়, তাহলে উল্লেখযোগ্য কোনো অংশ বাকি থাকে না উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করার জন্য।

এই অর্থনীতিবিদ আরো বলছেন, ‘এই ঋণ বিদেশী টাকায় শোধ করতে হবে। যাদের কাছ থেকে আমরা পণ্য নিয়েছি, পণ্যের দাম আমরা শোধ করতে পারিনি। সেগুলো আরেকটা সমস্যা হিসেবে দেখা যাচ্ছে। এর ফলে টাকা ও ডলার দু’টিতে টান পড়ে। এটা বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।’

কর সংগ্রহ কম, নামছে প্রবৃদ্ধি
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে শিল্প খাতে, তিন দশমিক ২৪ শতাংশ। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ শতাংশ।

এই সংলাপের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.১০ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি কমে হয়েছিল ৫.৭৮ শতাংশ। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি আরো কমে হয়েছে ৪.৮৪ শতাংশ।

সরকারের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭.৫ শতাংশ, তা অর্জনে অর্থবছরের বাকি মাসগুলোতে প্রবৃদ্ধি হতে হবে ১০ শতাংশ।

এই নিয়ে সেমিনারে অংশ নিয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এর ফলে প্রবৃদ্ধি কিছুটা ধীর হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে যেটা দাঁড়িয়েছে সেটা হলো কর আহরণ। এর ফলে সরকারের খরচ করার ক্ষমতা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে বিগত দেড় দশকে কর জিডিপির অনুপাত বাড়েনি। সে কারণে আগামী বাজেটে কর সংগ্রহের বড় চেষ্টা থাকতেই হবে। এর ফলে আরো বেশি করদাতাকে করের আওতায় নিয়ে আসা হতে পারে।’

একইসাথে আইএমএফ-র শর্তের কারণে অনেক খাতে যে প্রণোদনা দেয়া হচ্ছিল, আগামী বাজেটে সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে তুলে নেয়া হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

তবে এই সংলাপে অংশ নিয়ে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুল মান্নান বলেন, ‘জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে, তবে সেটা খুবই সামান্য। কিন্তু আমাদের অর্থনীতিবিদরা সেটাকে অনেক বড় করে দেখছেন। অনেকটা বাড়িয়ে বলছেন।’

বাজেট নিয়ে প্রত্যাশা নেই
সিপিডির এই সংলাপে আগামী বাজেট নিয়ে অনলাইনে করা একটি জরিপের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৬৪ শতাংশ মানুষ জানিয়েছে তাদের কোনো প্রত্যাশা নেই বাজেট ঘিরে।

'বাজেটে মানুষের প্রত্যাশা' নিয়ে সিপিডি ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের উদ্যোগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এটি প্রচার করা হয়। এতে আট হাজারের বেশি ব্যবহারকারীর কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।

যারা মন্তব্য করেছেন, তাদের ৬৪ শতাংশ জানিয়েছেন, আগামী বাজেট থেকে তাদের কোনো প্রত্যাশা নেই। এরমধ্যে ৮৯ শতাংশ সিপিডির এই উদ্যোগকে ‘লাভ’ ও ‘লাইক’ দিয়ে সাধুবাদ জানিয়েছেন। আর ১১ শতাংশ ‘অ্যাংরি’ ও ‘হাহা’ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সাধুবাদ না জানানোর ভাব প্রকাশ করেছেন।

গবেষণার সারাংশ উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘মানুষ তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছে। প্রথমত শোভন কর্মসংস্থান, দ্বিতীয়ত মানসম্মত শিক্ষা এবং সর্বশেষ সামাজিক সুরক্ষা। চার নম্বরে এসেছে পিছিয়ে পড়া মানুষের বৈষম্য হ্রাস করে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ব্যবস্থা।’

জরিপে দুই হাজার ২৪৯ জন ব্যক্তির গুগল ফর্মের মতামত ও আট হাজার ৪৮টি সোশ্যাল মিডিয়া রিঅ্যাকশন বিবেচনায় নেয়া হয়।

জরিপে শোভন কর্মসংস্থান চেয়েছে ২১ দশমিক ৫৭ শতাংশ মানুষ, ১৭ দশমিক ৫১ শতাংশ মানুষ মানসম্পন্ন শিক্ষা, ১২ দশমিক শূন্য নয় শতাংশ মানুষ সামাজিক নিরাপত্তার চাহিদার কথা জানিয়েছেন।

এতে আরো জানানো হয়, চর এলাকার ১৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ মানুষ কর্মসংস্থান, ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ শিক্ষায় অগ্রাধিকার দেয়ার কথা জানিয়েছেন।

বিবিসি বাংলাকে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘মানুষের প্রত্যাশার সবগুলোতে এখন বড় ধরনের ঘাটতি রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে সরকারের হাতে যেটুকু সম্পদ আছে এবং যে ব্যবস্থাগুলো রয়েছে সেগুলোর যদি সুষ্ঠু ব্যবহার করতে পারে তাহলেই কেবল সুরাহা হতে পারে।’

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
শিগগিরই মাগুরায় রেললাইন চালু হবে : রেলমন্ত্রী সংসদ ভবনের সামনে স্বেচ্ছাসেবক লীগের ২ গ্রুপের সংঘর্ষে ছাত্রলীগকর্মী নিহত জুজুৎসুর সম্পাদকের যৌন নিপীড়নের তথ্য দিলো র্যা ব পানচাষীদের পরিশ্রমের ফসল জিআই স্বীকৃতি : প্রতিমন্ত্রী বগুড়ায় অবৈধ মজুদকৃত ১ লাখ ডিম উদ্ধার তথ্যের জন্য সাংবাদিকরা শতবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যেতে পারেন : ডেপুটি গভর্নর ইসরাইলি হামলায় ৪০ ফিলিস্তিনি নিহত আফগানিস্তানে গুলিতে ৩ স্প্যানিশ ও ৩ আফগান নিহত বিভিন্ন অপরাধে সাতজনের ফাঁসি কার্যকর করল ইরান কিরগিস্তানে আতঙ্কে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা ‘প্রাচীন হিব্রুদের সাথে ইসরাইলি ইহুদিদের জেনেটিক সংযোগ নেই’

সকল