২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ

ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ - ছবি : সংগৃহীত

রোগ হিসেবে যার বয়স হাজার বছরের, প্রসার প্রতিপত্তিতে গজেন্দ্রগামী, আহ্বায়ক অনেক অসংক্রামকের, মহামারী আকারে যার বিস্তার বীভৎসতায় ভাবিয়ে তুলছে গোটা বিশ্বকে তাকে চিনতে-জানতে, নিয়ন্ত্রণে প্রতিরোধের নাকি এখনই সময়। সেই মহাসর্বনাশা শত্রুরূপী রোগটির নাম ডায়াবেটিস। যুগে যুগে দেশে দেশে তার হরেক নাম- মধুমেহ, বহুমূত্র, ডায়াবেটিস মেলিশাস, এন্ডোক্রাইন ও মেটাবলিক ডিসঅর্ডারস। গোটা বিশ্বে এখন প্রতি আট সেকেন্ডে একজন করে ডায়াবেটিক রোগী মারা যাচ্ছে- এই ভয়াবহ সংবাদ ভাবিয়ে তুলছে গোটা বিশ্বকেই। নীরব ঘাতক স্বভাবের ডায়াবেটিক রোগটি এমনিতে দেহে বহু ব্যাধির (চোখ, হার্ট, কিডনিসহ মূল্যবান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যাপক ক্ষতিসাধনে সক্ষম) আহ্বায়ক। এই রোগটির অব্যাহত অভিযাত্রায় শঙ্কিত সবাইকে এটি নিয়ন্ত্রণে যথা সচেতন করে তুলতেই অন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশন আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯১ সাল থেকে ১৪ নভেম্বরকে বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস হিসেবে পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে।

বস্তুত বিগত শতাব্দীর শেষার্ধে সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে গোটা বিশ্বে সবাই উঠে পড়ে লাগে। এতে গুটিবসন্ত কলেরা যক্ষা ম্যালেরিয়ার মতো মহামারী নির্মূলে সফল হলেও ডায়াবেটিসের বিস্তার রোধ ও নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তি সচেতনার অনিবার্যতা এবং এর জন্য সুপরিকল্পিত সর্বজনীন উদ্যোগ গ্রহণে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণের আবশ্যকতা যথা মনোযোগ ও চেতনার চৌহদ্দিতে আনা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান সমস্যা ও সীমাবদ্ধতাগুলোর প্রতি বিশ্ব দৃষ্টি আকর্ষণ এবং সব সরকার ও জনগণের তরফে সংহত ও সমন্বিত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে ঐকমত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস) জাতিসঙ্ঘকে প্রস্তাব গ্রহণের আহ্বান জানায়। মূলত বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির হয়ে বাংলাদেশ সরকারের আহ্বানে এবং যৌক্তিকতার প্রচারণা-প্রয়াসে ১৪ নভেম্বরকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে জাতিসঙ্ঘ ২০০৭ সালে ৬১/২২৫ নং প্রস্তাব গ্রহণ করে। সেই থেকে জাতিসঙ্ঘের সব সদস্য দেশে, বিশ্ব ডায়াবেটিক ফেডারেশনের দুই শতাধিক অধিক সদস্য সংগঠনে, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সংস্থা কোম্পানি পেশাজীবী সংগঠন ও ডায়াবেটিক রোগীদের মধ্যে বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস নানান প্রাসঙ্গিক প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে উদযাপিত হচ্ছে।

ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে ১৯২১ সালে ফ্রেডারিক ব্যান্টিং এবং চার্লস বেস্ট কর্তৃক ইনসুলিনের আবিষ্কার এক যুগান্তকারী অগ্রগতি- এ জন্য ব্যান্টিং চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯২৩ সালে। বলা বাহুল্য, ১৪ নভেম্বর ফ্রেডারিক ব্যান্টিংয়ের জন্মদিবসকেই তার প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শনার্থে বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস হিসেবে গৃহীত হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, ২০০০ সালে ভিত্তি বছরে বিশ্বে ডায়বেটিক রোগীর সংখ্যা যেখানে প্রায় ১৭ কোটি (বিশ্ব জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৩ ভাগ) ছিল, তাদের আশঙ্কা ২০৩০ সালে সে সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হয়ে যাবে। প্রাদুর্ভাবের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায় উন্নত বিশ্বে টাইপ-২ অর্থাৎ ইনসুলিন নিরপেক্ষ রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে পূর্ব ভ‚মধ্যসাগরীয় দেশগুলোকে সবচেয়ে বেশি (১৮০ শতাংশ), এরপর আফ্রিকা মহাদেশে (১৬০ শতাংশ), তারপর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় (১৫৫ শতাংশ) হারাহারি মতে ডায়াবেটিক রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতায় রয়েছে। বিশ্বে গড় বিস্তার যেখানে ১১৪ শতাংশ আমাদের বাংলাদেশে সেই বিস্তারের হার ১৪৯ শতাংশ যা যথেষ্ট আশঙ্কাজনক।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষামতে নগরায়ন, ওয়েস্টার্ন ফুড আর সার্বিক পরিবেশ এর ভারসমাম্যহীনতায় এই রোগের বিস্তারকে করছে বেগবান। বিশ্ব রোগ নিরাময় কেন্দ্রের মতে, এই শতকের মাঝামাঝি পৌঁছার আগেই এটি মানবভাগ্যে মারাত্মক মহামারীরূপে উদ্ভাসিত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ডায়াবেটিক তথ্য নিকাশ কেন্দ্রের হিসাব মতে, খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই এই ঘাতকব্যাধি বছরে ১৩২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিসাধন করে জাতীয় অর্থনীতির।

রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে বেশি দিন ধরে থাকলে ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়। সাধারণত ডায়াবেটিস বংশগত কারণে ও পরিবেশের প্রভাবে হয়। কখনো কখনো অন্যান্য রোগের ফলেও হয়ে থাকে। এ রোগ সব লোকেরই হতে পারে। ডায়াবেটিস একবার হলে আর সারে না। এটি সবসময়ের এবং আজীবনের রোগ। তবে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ রোগকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব হয়।

অতিরিক্ত প্রস্রাব, অত্যধিক পিপাসা, বেশি ক্ষুধা, দুর্বল বোধ করা এবং কেটে ছিঁড়ে গেলে ক্ষত তাড়াতাড়ি না শুকানো হচ্ছে এ রোগের সাধারণ লক্ষণ। যাদের বংশে (রক্ত-সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়স্বজনের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন খুব বেশি, যাদের বয়স ৪০-এর ওপর এবং যারা শরীরচর্চা করেন না-গাড়ি চড়েন এবং বসে থেকে অফিসের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অত্যধিক চিন্তাভাবনা, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, আঘাত, সংক্রামক রোগ, অস্ত্রোপাচার, অসম খাবার, গর্ভাবস্থা এবং ওজন বেশি বেড়ে গেল এ রোগ বাড়াতে সাহায্য করে। এগুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে প্রথম থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ বা বিলম্বিত করা যায়। ডায়াবেটিস প্রধানত দু’প্রকারের- ক. ইনসুলিন নির্ভরশীল এবং খ. ইনসুলিন নিরপেক্ষ। ইনসুলিন নির্ভরশীল রোগীদের ইনসুলিনের অভাবের জন্য ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়। ইনসুলিন নিরপেক্ষ রোগীদের দেহে কিছু পরিমাণ ইসনুলিন থাকে। তবে চাহিদার প্রয়োজনে তা যথেষ্ট নয় বা শরীর ইনসুলিন ব্যবহার করতে পারে না। এ সব রোগীদের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনে শর্করা কমানোর বড়ি সেবন করতে হয়।

ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয়। বেশি মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়, এ ধারণা ঠিক নয়। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা এবং ওষুধ এ রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায়। খাদ্যের গুণগত মানের দিকে নজর রেখে পরিমাণ মতো খাদ্য নিয়মিতভাবে গ্রহণ, জীবনের সব ক্ষেত্রে নিয়মকানুন বা শৃঙ্খলা মেনে অর্থাৎ কাজেকর্মে, আহারে, বিহারে, চলাফেরায়, এমনকি বিশ্রামে ও নিদ্রায়, শৃঙ্খলা মেনে চলা দরকার। নিয়ম শৃঙ্খলাই ডায়াবেটিস রোগীর জীবনকাঠি। ডায়াবেটিস রোগীকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মতো খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়। রোগ সম্বন্ধে ব্যাপক শিক্ষা ছাড়া ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের চিকিৎসায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। তবে ডায়াবেটিস বিষয়ে শিক্ষা কেবল রোগীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। একই সাথে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব এবং ডাক্তার ও নার্সদের শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। রোগী যদি চিকিৎসকের সাথে সহযোগিতা করে তার উপদেশ ও নির্দেশ ভালোভাবে মেনে চলেন এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা যথাযথভাবে গ্রহণ করেন তবে সুখী, কর্মঠ ও দীর্ঘজীবন লাভ করতে পারেন।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সবক’টি দেশই এক থেকে পাঁচ দশক ধরে স্বাধীনতা ভোগ করে এলেও দেশগুলো আজও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা মূল (স্থূল) জাতীয় উৎপাদনের Gross National Product স্বল্পতা, অক্ষরজ্ঞানের নিম্নহার, অনুন্নত কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি, অপর্যাপ্ত জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা, ব্যাপক অপুষ্টি, উচ্চজন্ম ও শিশু মৃত্যুর হার এবং পৌনঃপুনিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সংগ্রাম করে চলছে। এতসব সমস্যা থাকা সত্তে¡ও বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি দমনের সাথে সাথে এই অঞ্চলের অধিবাসীদের আয়ুষ্কাল ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পক্ষান্তরে বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগ, যথা- ডায়াবেটিস মেলাইটাস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদির প্রকোপ বেড়েছে।

ডায়াবেটিক মেলাইটাস সংক্রামক রোগ না হওয়ার কারণে এখনো পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সব দেশের স্বাস্থ্য কার্যক্রমের অগ্রাধিকার তালিকায় সংক্রামক রোগের তুলনায় এর স্থান অনেক নিচে। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও তাদের আঞ্চলিক অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। সুতরাং ডায়াবেটিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা কর্মসূচি এসব দেশে সন্তোষজনকভাবে গড়ে ওঠেনি। সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে চিকিৎসা করা হয় ঠিকই কিন্তু রোগীকে ইনসুলিন দেয়া হয় কেবল হাসপাতালে ভর্তি হলেই, বহির্বিভাগের রোগীকে কখনোই ইনসুলিন দেয়া হয় না। দেশের ৮৫ শতাংশ অধিবাসী যে পল্লী অঞ্চলে বাস করে, সেখানে ইনসুলিন পাওয়া যায় না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ডায়াবেটিসের মতো আজীবন রোগের ক্ষেত্রে যে ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন এসব উন্নয়নশীল দেশে সে সস্পর্কে যথেষ্ট সচেতনতাও নেই। যেসব হাসপাতালে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করা হয় সেখানেও এসব রোগীর কিছু নথি কিংবা তালিকা রক্ষা করা হয় না; এমনকি কোনো কেন্দ্রীয় নিবন্ধনও নেই।

লেখক: সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির ন্যাশনাল কাউন্সিল সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement