২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তারি দু’চারিটি অশ্রুজল

লেখক : জয়নুল আবেদীন - ফাইল ছবি

‘কুকুর মানুষকে কামড়ালে সেটি কোনো সংবাদ নয়, কিন্তু মানুষ কুকুরকে কামড়ালে সেটি সংবাদ’ হয়। বিজ্ঞ বিচারক বিচারকার্য শুরু করার আগে আচরণবিধিসহ মহামান্য উচ্চ আদালতের বিচারকদের মেনে চলতে হয় শপথ। যে কাজ করার জন্য আচরণবিধিসহ শপথ নেয়া হয় সে কাজ যথাযথভাবে পালন করতে থাকা কোনো সংবাদ নয়, সংবাদ হয় এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে অস্বাভাবিক কোনো কর্ম সংঘটিত হলে। গাঁয়ে একটি কথা আছে- ‘আকাশের যত তারা, পুলিশের তত ধারা’। রোমান আইনের ভিত্তি ১২ আইন থেকে এখন পৌঁছে গেছে আকাশের তারার সমপরিমাণ। প্রতিনিয়ত বাড়ছে নতুন নতুন সমস্যা, বাড়ছে নতুন নতুন আইন। সমস্যার সাথে পাল্লা দিয়ে আইন কুলিয়ে উঠতে পারে না। সমস্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে, আইন বাড়ে গাণিতিক হারে। তাই নানাভাবে বিচারকের হাত খোলা রাখা হয়েছে। খোলা হাত প্রয়োগ করতে হয় সাবধানে যার মধ্যে একটি আদালতের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা। উচ্চ আদালতে অন্তর্নিহিত ক্ষমতা ছাড়াও বিচারকের হাতে জন্ম হয় রুলিং আর পার্লামেন্ট তৈয়ার করে আইন। নিম্ন আদালতে এরকম অন্তর্নিহিত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়েই কেউ কেউ হয়ে পড়েন ইতিহাস, দৃষ্টান্ত, স্বেচ্ছাচারী, আবেগপ্রবণ ও ভীতসন্ত্রস্ত।

ইতিহাস হওয়ার উদাহরণ
‘সাতক্ষীরার জ্যেষ্ঠ বিচারক। দেড় ঘণ্টায় নিষ্পত্তি করেন ৫১ মামলা। সময় পেলে তিনি একাই সব মামলা নিষ্পত্তি করতে পারতেন। ‘সব নষ্টের মূল’ সংবাদ। ডেইলি বাংলাদেশ ডটকম গত ২ ফেব্রুয়ারি : ‘দেড় ঘণ্টায় ৫১ মামলার নিষ্পত্তি করার সংবাদ প্রকাশ করায় সেই বিচারকের বিরুদ্ধে এবার তদন্ত’ শুরু হয়েছে। প্রকাশ, ’সাতক্ষীরা জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তৃতীয় আদালতে দেড় ঘণ্টায় ৫১ মামলার নিষ্পত্তি করে রেকর্ড গড়া বিচারক মো: সালাহউদ্দীনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে।’ উল্লেখ্য, প্রতারণা, চুরি যৌতুক, মারামারিসহ বিভিন্ন অভিযোগে ৫১টি মামলা দীর্ঘদিন ধরে চলছিল। মঙ্গলবার মাত্র দেড় ঘণ্টায় বিচারক মো: সালাহউদ্দীন এসব মামলার রায় ঘোষণা করেন। এর মধ্যে আটটি মামলায় আসামিদের সাজা ও বাকি ৪৩টি মামলায় খালাস দেন তিনি।’

দৃষ্টান্ত হওয়ার উদাহরণ
‘আদালতের ব্যতিক্রমী রায় : ৪৮ স্বামী-স্ত্রী মিলে থাকার অঙ্গীকার’ শিরোনামে গত ২৫ নভেম্বর ২০২০ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার শিরোনাম। প্রকাশ, ‘বুধবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন মামলায় ৪৮ জন স্বামীকে তাদের স্ত্রীর দায়ের করা মামলায় সুনামগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো: জাকির হোসেন আসামিদের কারাগারে না পাঠিয়ে বাদি-বিবাদি (স্বামী-স্ত্রী) একত্রে বসবাস করার শর্তে আপস-নিষ্পত্তি করে দিয়ে এক ব্যতিক্রমী রায় দেন। সুনামগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারকের এই রায়টি প্রশংসায় ভাসছে সুনামগঞ্জ তথা সিলেট অঞ্চলে।’

স্বেচ্ছাচারী হওয়ার উদাহরণ
‘নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে ভবিষ্যতে সতর্ক থাকার অঙ্গীকার করলেন বিচারক’ শিরোনাম গত ২০ জুন দৈনিক প্রথম আলো। প্রকাশ, ‘এক মামলায় এক আসামিকে হাইকোর্টের দেয়া জামিন সত্ত্বেও জামিন আবেদন নামঞ্জুর করা হলো’ বলে দেয়া আদেশ ‘অসর্তকতাবশত’ ও ‘অনিচ্ছাকৃত ভুল’ উল্লেখ করে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন জামালপুরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ জিন্নাত জাহান ঝুনু। একই সাথে, ভবিষ্যতে নিজ দায়িত্বের প্রতি সতর্ক থাকবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন এই বিচারক।’

আবেগপ্রবণ হওয়ার উদাহরণ
‘ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টা পর কোনো মামলা নথিভুক্ত না করতে পুলিশকে নির্দেশনা দেয়ায় ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক মোসাম্মৎ কামরুন্নাহারের বিচারিক ক্ষমতা ‘সাময়িকভাবে প্রত্যাহার’ করেছেন সুপ্রিম কোর্ট।’ বিচারক মোসাম্মৎ কামরুন্নাহারের রেইন ট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ হয়। এমন প্রেক্ষাপটে ওই বিচারকের ‘বিচারিক ক্ষমতা’ কেড়ে নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দেয়া হবে বলে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের একদিন পরই সুপ্রিম কোর্ট এই সিদ্ধান্ত নেন।’

বিচারকের ক্ষমতা কেড়ে নেয়া বা সাময়িকভাবে প্রত্যাহারে বাদির কতটা লাভ? নিম্ন আদালতের বিচারকদের প্রশিক্ষণ ও সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার পেতে উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ কতটা? এসব বিষয়ে গত ১৫ নভেম্বর ২০২১ দ্য ডেইলি স্টারের সাথে কথা বলেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইন ও সালিশকেন্দ্রের সাবেক সভাপতি ও ব্লাস্টের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য জেড আই খান পান্না।

বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার অর্থ হলো- তিনি যে কাজের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, তার যোগ্য নন। এখন ওই বিচারককে বিচারিক কাজের বাইরে অন্য কোনো প্রশাসনিক কাজে নিয়োগ দিলেও সেটি কি যৌক্তিক হবে? এই প্রশ্নের জবাবে জেড আই খান পান্না বলেন, ‘এখানে তার বিচারিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। নিশ্চয় তার কার্যকলাপ সম্পর্কে তদন্ত হবে। সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্ট বিভাগের কোনো বেঞ্চ তার রেকর্ড দেখতে পারেন। সেটি সম্পূর্ণ আদালতের বিষয়। রেকর্ড দেখে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। তার বিরুদ্ধে সাময়িক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তবে, এ ধরনের ঘটনা শুধু এটিই নয়, আরো আছে। বিচারক হিসেবে তিনি যদি যোগ্য না হন, তাহলে অন্যান্য দাফতরিক কাজ তিনি করতে পারেন। যেমন ড্রাফট করা, ড্রাফট দেখে দেয়া।’

নিম্ন আদালতের বিচারকদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নিম্ন আদালতের বিচারকদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে যদি দুর্বলতা থাকে সেটি ঠিক করতে হবে। কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। বাংলাদেশে কয়েক হাজার জুডিশিয়াল অফিসার আছেন। সবার বেলায় এটি ঘটে না। সব জায়গায় সরিষার ভেতর দু’-একটা ভূত থাকে। এটিও সে রকম একটি ঘটনা।’

রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলাটির বিষয়ে শুরু থেকে গণমাধ্যম ও জনগণের দৃষ্টি ছিল, এ ধরনের অন্যান্য মামলা যেগুলোর প্রতি এমন নজর থাকে না, সে সব ক্ষেত্রে আসলে কী ঘটছে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে আমরা দণ্ডিত হতে ও খালাস পেতে- দুটোই দেখছি। এখানে বিচারক যে সুপারিশ করেছেন, ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের ঘটনায় কোনো মামলা যাতে পুলিশ না নেয়। এটি তিনি বলতে পারেন না। এটি সম্পূর্ণ আইন ও তার এখতিয়ার বহির্ভূত। কারণ ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে কোনো কিছু তামাদি হয় না।’

টিআইবি আয়োজিত অনুষ্ঠানে সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী বলেন, ‘দুর্নীতি নামক ব্লাডক্যান্সার রোগের চিকিৎসা সনাতনী পদ্ধতিতে হবে না। শরীরের পুরো রক্ত পরিবর্তন করতে হবে। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কথা উল্লেখ করে সাবেক প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচারক হওয়া মানে গঙ্গাজলে ম্লান করে আসা নয়। ভালো ভালো ছেলেরা বিচারব্যবস্থায় এসে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। (দৈনিক ইত্তেফাক, ২৫ মে ২০০৭)

‘বিচারকের বিচার ও সমালোচনা এবং আদালত প্রতিবেদকের দায়’ শীর্ষক নিবন্ধে সাঈদ আহসান খালিদ, সহকারী অধ্যাপক, এক নিবন্ধে বলেন, ‘বিচারকার্যের সমালোচনা কিংবা ভুল ও বেআইনি বিচারের জন্য বিচারকের বিচার করা যাবে কি-না এটি একটি জটিল গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এটি ঠিক যে, বিচারকার্য সরাসরি মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে। বিচারিক আদেশের সমালোচনার আইনগত সুযোগের সাথে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও আদালত অবমাননার প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আইন ও বিচার কোনো একক ব্যক্তির কাজ নয়, এটি একটি সমষ্টির ক্রিয়ার ফলাফল। যেখানে অনেকগুলো পক্ষ যেমন- বাদি, বিবাদি, উভয়পক্ষের আইনজীবী, তদন্তকারী পুলিশ, সাক্ষী, চিকিৎসক, বিচার প্রশাসন ও স্বয়ং বিচারক গভীরভাবে বিজড়িত থাকেন। এই প্রক্রিয়া বিনে সুতোর মালার মতো এবং পারস্পরিক নির্ভরশীল। কোনো একটি পক্ষের অবহেলায় বা অতি প্রতিক্রিয়ায় পুরো বিচার প্রক্রিয়াটি খারাপভাবে প্রভাবিত হতে পারে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইটালি ও পোল্যান্ডের আইনানুসারে বিচারকের ইচ্ছাকৃত ভুল, বেআইনি রায় ব্যক্তিগত দায়মুক্ত। তবে স্পেন ও মলদোভার আইনানুসারে ইচ্ছাকৃত বেআইনি আদেশের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা যায়। তবে, বিচারকের রায়ের বাধ্যকরী অংশের বস্তুনিষ্ঠ ও পক্ষপাতহীন উপস্থাপনা প্রতিবেদকের পেশাগত দায়িত্ব।’

পেশায় আইনজীবী হলেও লেখালেখির বাতিক শৈশব থেকেই। এক সময় ছিলাম দৈনিক আজাদ পত্রিকায় মফস্বল সাংবাদিক। লেখালেখির সম্পূর্ণ বিপরীত ভুবন আইনপেশায় প্রবেশ করে চোখে সর্ষেফুল দেখতে শুরু করি। আমার আইন পেশা- কর্মজীবনের সূচনা ঢাকা কোর্ট থেকে। ঢাকা থেকে উপজেলা হোমনা (কুমিল্লা) হয়ে বর্তমান জেলা কোর্ট নারায়ণগঞ্জে। আদালতপাড়ায় দেখেছি, ১২ রকমের মানুষের উদারতা, সঙ্কীর্ণতা ও গভীরতা। উদারতায় মুগ্ধ হয়েছি, গভীরতা ও মহত্ত্ব মহিমায় মুগ্ধ নয়নে তাকিয়েছি কারো কারো দিকে। সীমাহীন সঙ্কীর্ণতায় কষ্ট পেয়েছি, ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে হৃদয়।

বিস্ময়াভিভ‚ত হয়ে ভাবতাম- স্রষ্টা কত শঙ্কর উপাদান থেকে সৃষ্টি করেছে মনুষ্যহৃদয়। প্রতিদিন হৃদয়ের ক্যানভাসে লেগেছে কত আনন্দ বেদনার দাগ। কত শত দাগ সামান্য রোদ বায়ুতেই ধুয়ে-মুছে গেছে উদাসী কর্পূরের মতো। কোনো কোনো দাগ লেগে রয়েছে অনপনেয় হয়ে। অপসারণের অযোগ্য দাগগুলো বড়ই যন্ত্রণাদায়ক। কাজী মোতাহার হোসেন তার নিজের লেখা সম্পর্কে বলেন, ‘মুক্তবুদ্ধির বাণী প্রচার সহজ ব্যাপার নয়, তবু সেই কঠিন পথই আমরা বেছে নিয়েছি। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যেন আমরা সেই পথ ত্যাগ না করি। আমার চিন্তা, কর্ম ও লেখা যেন জীবনের একটি অপরিহার্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। এতে সফলতা লাভ হোক বা না হোক, একটি আদর্শ অনুসরণের সহজ আনন্দ যেন পেতে লাগলাম। আর সাথে সাথে একটি অস্পষ্ট আশা রইল যে, আজিকার ক্ষীণ আলো ভবিষ্যতে শক্তি সঞ্চয় করে যখন প্রখর সূর্যে পরিণত হবে, তখন আর তাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা কারো থাকবে না।’

২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সময়ে সিপিআই সূচকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বালাদেশের অবস্থান ছিল প্রথম। একটি পরিচিত প্রবাদ, ‘দেশ বৈরী প্রাণে মরি, হাকিম বৈরী রাজ্য ছাড়ি।’ রাজ্য ছাড়ার মতোই হয়েছিল দেশের বিচারব্যবস্থা। এসব কথাই উঠে এসেছে মহামান্য উচ্চ আদালতের বিচারকদের কথা ও লেখায়। বিচারপতি মো: রুহুল আমিন, মাহমুদুল আমিন চৌধুরী, মোহাম্মদ আবদুর রউফ, হাবিবুর রহমান, মোস্তফা কামাল প্রমুখ অযোগ্য বিচারকদের অপসারণসহ দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট ও ঘৃণাসহ আদালতের সুনাম ফিরিয়ে আনার পক্ষে বক্তব্য দিয়ে গেছেন। দেখিয়ে দিয়ে গেছেন ভালো হওয়ার পথনির্দেশনা। একই সভায়, প্রধান বিচারপতি মো: রুহুল আমিনের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি, ‘আদালত থেকে অদক্ষ অযোগ্যদের সত্বর অপসারণ না করলে ২০ বছরেও এই প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতি হবে না। রোকনউদ্দিন মাহমুদ বলেন, এসব অদক্ষ অযোগ্যদের বহন করতে রাজি নয়। সবাই একবাক্যে বলেছেন, অতিসত্বর তাদের অপসারণ করা হোক, এমনকি তারা বিভিন্ন সময় যে রায় দিয়েছেন তা ভুল কি শুদ্ধ তার বিচার করা যেতে পারে (দৈনিক মানবজমিন, ১ জানুয়ারি ২০০৭)

এর পরও ২০১০ সালের টিআইবি রিপোর্টে ঘুষ লেনদেনের কথা উল্লেখসহ প্রচার হয়েছে ‘সেবা খাতের মধ্যে বিচার বিভাগেই দুর্নীতি বেশি হয়’। টিআইবি রিপোর্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ হয়েছে- হয়েছিল মানহানি মামলাও। টিআইবি রিপোর্টের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদসহ মানহানি মামলার বিষয় দেশের মানুষ সবাই জানতে পেরেছে জাতীয় পত্র-পত্রিকা থেকে- শুধু জানতে পারেনি কোনো অদক্ষ অযোগ্য ও ঘুষখোর বিচারককে অপসারণ করা হয়েছিল কি-না। একদিকে বিচার বিভাগ সম্পর্কে টিআইবির নেতিবাচক রিপোর্ট আরেকদিকে তীব্র প্রতিবাদসহ মামলা মোকদ্দমা হতে দেখে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ক্রন্দসী কাব্যগ্রন্থের ‘উটপাখি’ কবিতার বিখ্যাত পঙক্তি ‘অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে’ উক্তিটি সামনে চলে আসে।

রাউজানে দুর্নীতি; কারণ ও প্রতিকার’ শীর্ষক সেমিনারে সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুর রউফ বলেছেন, ‘দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে সারা দেশ। যা মরণব্যাধি ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে। এ রোগ থেকে বাঁচতে সবাইকে নিজ উদ্যোগে প্রতিষেধক নিতে হবে। নতুবা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আধুনিক প্রতিষ্ঠিত দেশ রেখে যাওয়া সম্ভব হবে না (দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৪ জুলাই ২০০৭’ টিআইবি রিপোর্টের বক্তব্য অনুসারে, আদালতপাড়ায় প্রলয় চলছেই। ফল্গুধারার মতো প্রবহমান প্রলয় থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আধুনিক প্রতিষ্ঠিত দেশ রেখে যাওয়ার মহৎ উদ্দেশ্যে, সহস্র বিস্তৃত রাশি, ‘তারি দু’চারিটি অশ্রুজল’ নিয়েই এই প্রবন্ধ।

বিচারপতি আবদুর রউফ বলেন, ‘মেধাবী ছাত্ররা বিচার ব্যবস্থায় যোগ দিয়ে চরিত্র রক্ষা করতে পারছে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, বিচারকরা সমাজের বাইরের কেউ নন। সমাজের অন্যান্য অংশে যেমন দুর্নীতি আছে বিচারব্যবস্থায়ও তা আছে। এ জন্য মানবীয় গুণাবলির উন্নতি ঘটাতে হবে। (ইত্তেফাক, ২৫ মে ২০০৭)

আমার ওকালতি জীবনের প্রথমার্ধে কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেট পেয়েছিলাম, যারা শিক্ষাজীবনে তুখোড়, চলনে চটপটে, বলনে স্মার্ট, বোধবুদ্ধিতে বৃহস্পতি ও কর্মে কৌশলী ছিলেন যার মধ্যে একজনকে হোমনা, অপরজনকে পেয়েছিলাম সোনারগাঁ। সোনারগাঁ উপজেলায় যোগদানের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা, মনাইরকান্দি গ্রামের এক আসামি গ্রেফতার হয়ে আসে। দণ্ডবিধি ৩২৬ ধারা মামলার আসামি। গ্রেফতারকৃত আসামির বিরুদ্ধেই ৩২৬ ধারার অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ ছিল। আমি তখন উপজেলা কোর্টের উত্তর দিকে এক ভাড়া বাসায় থাকি। বন্ধের দিন থাকায় অন্য কোনো উকিল না পেয়ে আমাকে ডেকে নেয় জামিন শুনানি করার জন্য। কাগজপত্র দেখে বললাম-
-জামিন হবে না।

-জামিন হবে কি-না হবে, তা হাকিমের ব্যাপার। আপনাকে শুনানি করতে বলেছি, আপনি শুনানি করেন।
বলে আসামি পক্ষের লোকজন। আমি শুনানি করলাম। মক্কেলের কর্কশ ও আদেশমূলক কথায় দায়সারা শুনানি করলাম। মঞ্জুর হয়ে গেল। আমার কাছে অন্য এক ঘটনায় ৩২৬ দণ্ডবিধি মামলার আসামিরা জামিনের জন্য ঘোরাঘুরি করছিল। আমি হাজির করতে সাহস পাচ্ছিলাম না। এ আসামির জামিন হতে দেখে সাহস পেলাম। খবর দিলাম আসামিদের। আসামির সংখ্যা ১৭ জন, যার মধ্যে একজন মহিলা। নাম চিনি বেগম। প্রাণ উজাড় করে শুনানি করলাম। চিনি বেগম ছাড়া ১৬ জনের জামিন নামঞ্জুর করল। আদেশ শুনে শরীর ঘামতে শুরু করে। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। ১৬ জন আসামি জেলখানায় নেবে কিভাবে? জেলারের কাছে টেলিফোন করে, জেলখানার গাড়ি আনিয়ে আসামিদের পাঠানো হয়। কোর্ট দারোগার কাছে জানতে চাই-

-ভাই, এটি কেমন কাজ হলো?
-ঠিকই হয়েছে, আপনি কোন সাহসে ৩২৬ ধারা মামলার এতগুলো আসামি হাজির করলেন?
-কেন সেদিন যে জামিন দিলেন? সেটি তো ৩২৬ ধারার আসামিই ছিল? আবার পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হওয়া। আমরা হাজির হয়েছিলাম স্বেচ্ছায়। আমাদের আইনের প্রতি সম্মান দেখানোটাই কি অপরাধ?
-সেদিন যা হয়েছে, সবার সাথে বুদ্ধি-পরামর্শ করেই হয়েছে। আগে বুদ্ধি-পরামর্শ করে করলে আপনারটাও হয়ে যেত।

-ভাই, তাড়াতাড়ি বুদ্ধি পরামর্শ দিন। আমার লোকজন কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে।
-বুদ্ধির জন্য আসামিপক্ষের লোকজন পাঠান।
বুদ্ধি নেয়ার পর, পরের দিন যেনতেনভাবে মুভ করতেই সবার জামিন হয়ে গেল। (বিচারের বাণী, পৃষ্ঠা : ১১০-১১১)

দার্শনিক ও মনীষী অ্যারিস্টটল বলেন, ‘ন্যায়বিচারের ওপরই সমাজের শৃঙ্খলা কেন্দ্রীভ‚ত।’ যে সমাজে আইনের বিধান অনুসৃত হয়, সে সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি বিরাজ করে অবধারিতভাবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত হলে মানুষের মনোবল থাকে পর্বতশৃঙ্গের মতো শীর্ষে। বর্তমানে ‘ক্ষমতা’ ও ‘অর্থ’ এ দুটোর মাপকাঠিতে সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস হয়। এ দুটো যাদের আছে তাদের ভেতর থেকে বের হয় উৎপীড়ক, যাদের নেই তারা হয় উৎপীড়িত। উৎপীড়িত ও নিষ্পেষিতরাই ছুটে আসে কোর্টে। এসে দেখে এখানেও পৎ পৎ করে উড়ছে উৎপীড়কের বিজয় কেতন! তা দেখে মনে পড়ে ঈশপের গল্পটি। ‘প্রাণীকূলে ছাগশিশু অসহায় প্রাণী। ছাগশিশুর ওপর সবাই জুলুম করে। নানা অজুহাতে কামড়ায় ও সাবাড় করে ফেলে। ছাগশিশু ভাবে, সবার আহার্য হিসেবে তাকে সৃষ্টি করার কী দরকার ছিল? এই কষ্টের কথা বলার জন্য ছাগশিশু ব্রহ্মাকে খুঁজছিল। অনেক সাধনার পর ব্রহ্মার দর্শন পায়।’

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail : adv.zainulabedin@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement