২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং উন্নয়নের সূত্র

বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং উন্নয়নের সূত্র - প্রতীকী ছবি

গত ৮ জুন Quacquarelli Symonds (QS) প্রকাশ করেছে তাদের সুপরিচিত ‘ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং ২০২২’। এটি তাদের ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিংয়ের অষ্টাদশ সংস্করণ। অর্থাৎ তারা ১৮ বছর ধরে এটা প্রকাশ করে আসছে। কিউএস র‌্যাংকিং হচ্ছে একমাত্র ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং, যা ‘ইন্টারন্যাশনাল র‌্যাংকিং এক্সপার্ট গ্রুপ’ (আইআরইজি) থেকে অনুমোদিত। কিউএস র‌্যাংকিং বিবেচিত বিশ্বের অন্যতম তিনটি ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিংয়ের একটি হিসেবে। এই তিনটি র‌্যাংকিংয়ের মধ্যে অন্য দুটি হচ্ছে : ‘অ্যাকাডেমিক র‌্যাংকিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ’ এবং ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং’।

কিউএস পাবলিশার্স ২০০৪-২০০৯ সময়ে প্রতি বছর এই র‌্যাংকিং প্রকাশ করতে সহযোগিতা গড়ে তোলে ‘টাইম হায়ার এডুকেশন ম্যাগাজিনের সাথে এর ‘ইন্টারন্যাশনাল লিগ ট্যাবল’ প্রকাশের জন্য। এর পর থেকে এই দুই প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব র‌্যাংকিং সংস্করণ আলাদাভাবে প্রকাশ করে আসছে।

সর্বশেষ কিউএস র‌্যাংকিংয়ে বিশ্বের ২৮ হাজারের মতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মূল্যায়িত হয়েছে ৯৭টি দেশের ১৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক অবস্থান। এই ১৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটির র‌্যাংকিং বা অবস্থান বিবেচিত হয়েছে ছয়টি মানদণ্ড অনুসরণ করে। এগুলো হচ্ছে- অ্যাকাডেমিক রেপুটেশন : ৪০ শতাংশ, এমপ্লয়ার রেপুটেশন : ১০ শতাংশ, সাইটেশন পার ফ্যাকাল্টি : ২০ শতাংশ, ফ্যাকালিট/স্টুডেন্ট রেশিও : ২০ শতাংশ, ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাকাল্টি রেশিও : ৫ শতাংশ এবং ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট রেশিও : ৫ শতাংশ। কিউএস ৫০০-এর নিচের অবস্থানে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট র‌্যাংক বা অবস্থান উল্লেখ করে না।

সর্বশেষ এই র‌্যাংকিংয়ে বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়টি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট ফর টেকনোলজি তথা এমআইটি। টানা ১০ বছর এই শীর্ষস্থান দখলে রাখার গৌরবের ভাগীদার এই প্রতিষ্ঠানটি। এর পরই অবস্থান অনুক্রমে শীর্ষদশে থাকা অন্য ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে : যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড, যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড, যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ, যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, যুক্তরাজ্যের ইম্প্যারিয়্যাল কলেজ লন্ডন, সুইজারল্যান্ডের ইটিএইচ জুরিখ, যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়। আমেরিকার আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সুখ্যাত আটটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে : হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়, ডার্টমাউথ কলেজ, পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলোর মধ্যে হার্ভার্ড ছাড়া আর একটিও এবারের কিউএস তালিকায় সেরা দশে থাকতে পারিনি। তবে এগুলোর বেশির ভাগের অবস্থান রয়েছে সেরা ১০০-এর তালিকায়।

পূর্ববর্তী বছরের মতো এবারের র‌্যাংকিংয়ে ‘সেরা একশ’ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় রয়েছে এশিয়ার ২৬টি বিশ্ববিদ্যালয়। আর পুরো তালিকায় স্থান পেয়েছে এশিয়ার ৩৯০টি বিশ্ববিদ্যালয়। আজ পর্যন্ত ২৬টির বেশি এশীয় বিশ্ববিদ্যালয় ‘সেরা একশ’র তালিকায় আসতে পারেনি। এশিয়া অঞ্চলের সেরা দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’টিই সিঙ্গাপুরের : ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর এবং নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি। কিউএস র‌্যাংকিংয়ে এ দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান যথাক্রমে একাদশ ও দ্বাদশ। কিউএস তালিকায় ১৭৭ নম্বর অবস্থানে থাকা ‘আইআইটি বম্বে’ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে।

আলোচ্য সর্বশেষ র‌্যাংকিংয়ে সেরা ৫০০-এর তালিকায় স্থান পেয়েছে ভারতের আটটি ও পাকিস্তানের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়। ভারতের এই আটটি বিশ্ববিদ্যালয় ও এগুলোর র‌্যাংকিং অবস্থান নিম্নরূপ : ১৭৭. ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বোম্বে (আইআইটি বোম্বে), ১৮৬. ইন্ডিয়ান ইনস্টিউিট অব সায়েন্স ব্যাঙ্গালোর, ১৮৫. আইআইটি দিল্লি, ২৫৫. আইআইটি মাদ্রাজ, ২৭৭. আইআইটি কানপুর, ২৮০.আইআইটি খড়গপুর, ৩৯৫. আইআইটি গৌহাটি এবং ৪০০. আইআইটি রুরকি।

সেরা ৫০০-এর তালিকায় থাকা পাকিস্তানের তিনটি বিশ্বদ্যালয়ের অবস্থান নিম্নরূপ : ৩৫৫. ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইসলামাবাদ, ৩৭৩. পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স, ৪৫৪. কায়েদ-ই-আজম ইউনিভার্সিটি। পাকিস্তানের একটি বিশ্বদ্যিালয়ের অবস্থান রয়েছে এ তালিকার ৬৫১-৭০০ র‌্যাংক ব্যান্ডে, তিনটি ৮০১-১০০০ ও আরো কয়েকটি ১০০১+ র‌্যাংক ব্যান্ডে। ৬৫১-৭৭০ র‌্যাংক ব্যান্ডে রয়েছে ‘লাহোর ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স, ৮০১-১০০০ র‌্যাংক ব্যান্ডে রয়েছে ইসলামাবাদ কমস্যাটস ইউনিভার্সিটি, লাহোর ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি এবং পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়। অপর দিকে ১০০০+ র‌্যাংক ব্যান্ডে রয়েছে ফয়সলাবাদ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, করাচি বিশ্ববিদ্যালয় ও লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়।

এবার ফিরে তাকানো যাক, আমাদের বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থানের দিকে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে এক সময়ে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের আরেক গৌরবের ধন বুয়েটের র‌্যাংকিং অবস্থান কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিংয়ে কততম অবস্থানে তা সুনিনির্দিষ্টভাবে জানার কোনো সুযোগ নেই। কারণ সেরা ৫০০-এর তালিকার বাইরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনির্দিষ্ট র‌্যাংকিং কিউএস প্রকাশ করে না। এই সেরা ৫০০-এর তালিকায় বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়েরও স্থান হয়নি। তবে এটুকু জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট এই তালিকায় ৮০১-১০০০ র‌্যাংকসীমার মধ্যে রয়েছে। এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১৩৪তম স্থানে। ২০২২ সালের এই কিউএস র‌্যাংকিং তালিকায় বাংলাদেশের কোনো সরকারি কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সেরা ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নেই। তবে বাংলাদেশের দু’টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রথমবারের মতো ১০০১-১২০০ র‌্যাংকসীমায় অবস্থান নিতে সক্ষম হয়েছে। শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র অন্য একটি দেশ, যা কিউএস তালিকায় স্থান পেয়েছে। পাকিস্তানের চারটি ও ভারতের ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান নতুন এই র‌্যাংকিং তালিকায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপরে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দেয়া তথ্য মতে, দেশে ৪৯টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু রয়েছে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রথমবারের মতো কিউএস র‌্যাংকিংয়ে অন্তর্ভুক্ত হওয়াতেই মোটামুটি খুশি। বিশ্ববিদ্যালয়টি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, এখন তাদের প্রয়াস হবে এশিয়ার সেরা ১০০ এবং বিশ্বের সেরা ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান করে নেয়া। অন্য দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক আখতারুজ্জামান একটি পত্রিকাকে জানিয়েছেন, তার বিশ্ববিদ্যালয় এখন র‌্যাংকিং নিয়ে কিছু ভাবছে না। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন নজর দিচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রসারণ ও মৌলিক গবেষণার উন্নয়নের ব্যাপারে। একই সাথে আমরা জোর দিচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও পরিবেশ উন্নয়নের ব্যাপারে। আমরা যদি এসব বিষয়ে মনোযোগ দিই, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং এমনিতেই ওপরে উঠে আসবে।’ -জানি না, অধ্যাপক আখতারুজ্জামান তার এই প্রয়াসে কতটুকু সফল হবেন। তবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান সার্বিক অবস্থাদৃষ্টে এ ব্যাপারে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ কম। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও পরিবেশ উন্নয়নের প্রবণতা ক্রমেই নিম্নমুখী।

২০১২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৬০১-এর ওপরে ছিল। ২০১৪ সালে তা নেমে আসে ৭০০+ ব্র্র্যাকেটে, ২০১৯ সালে এই অবস্থান আরো নিচে নামে। বিগত এক দশক ধরে এর অবস্থান ক্রমেই নিচে নামতে নামতে বর্তমানে ৮০১-১০০০ র‌্যাংকসীমায় পৌঁছেছে। গত বছরেও এই দু’টি বিশ্ববিদ্যায়ের র‌্যাংক ৮০০-১০০০-এর ব্র্যাকেটে বন্দী ছিল।

ভারত, চীন ও সিঙ্গাপুরের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র‌্যাংকিংয়ে সামনে এগিয়েছে। এমনকি র‌্যাংকিংয়ে আমরা পাকিস্তানের তুলনায়ও পিছিয়ে। এর অন্যতম কারণ শিক্ষকদের পড়াশোনার চেয়ে অধিক মাত্রায় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রায়ই উত্তপ্ত হয়ে পড়ে কিংবা বন্ধ হয়ে যায়। আবরার হত্যার মতো অভাবনীয় ঘটনা ঘটে।

শিক্ষাবিদরা মনে করেন, র‌্যাংকিংয়ে পিছিয়ে থাকার অন্যতম দু’টি কারণ হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা সহায়তার ও মানসম্পন্ন প্রকাশনার চরম অভাব। আমাদের প্রকাশনা আছে, তবে এগুলোর আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা তেমন নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা সহযোগিতা, লাইব্রেরি সুবিধা যথেষ্ট নয়। এ ছাড়াও আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানসম্পন্ন মেধাবী শিক্ষকরা নিয়োগ পান না, রাজনৈতিক আনুকূল্যে নিয়োগ পায় লেজুড়বৃত্তিতে অগ্রসর অযোগ্য সব শিক্ষক। নানা প্রশ্ন ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের বাছাই ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিয়ে। এ সবের কারণ, আমাদের জানা। এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশের অবনতি ঘটে।

উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন আর বিদেশী শিক্ষক চাকরি করতে আসেন না। একই কারণে আগের মতো বিদেশী শিক্ষার্থীরা আমাদের নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে আসতে চায় না। এর আরেকটি কারণ, হালনাগাদ তথ্যসমৃদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েবসাইট আমাদের নেই। লক্ষণীয়, ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাকাল্টি (বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমণ্ডলী) রেশিও এবং ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট রেশিও কিন্তু কিউএস র‌্যাংকিংয়ের দু’টি মেট্রিকস বা মাপকাঠি। অতএব, এই দুই মেট্রিকসের স্কোরে আমাদের পিছিয়ে পড়তে হয়। ওয়ার্ল্ড র‌্যাংকিংয়ে অন্যান্য যেসব মাপকাঠি বা ক্রাইটেরিয়া বিবেচিত হয়, সেসব ক্ষেত্রে আমরা অনেকদূর পিছিয়ে থাকি।

এর বিপরীতে আমরা লক্ষ করি, পাশ্চাত্যের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে সবমহলে সমাদৃত অনেক ফ্যাকাল্টি (শিক্ষকমণ্ডলী) সায়েন্টিস্ট ও স্কলার। রয়েছে উপযুক্ত অবকাঠামো ও তহবিলের পর্যাপ্ত জোগান। এই তহবিল শুধু এরা গবেষণার পেছনেই ব্যয় করে না, খরচ করে দেশে-বিদেশের পণ্ডিতজনদের তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নেয়ার জন্য। এর মাধ্যমে এরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ট্যালেন্ট পুল গড়ে তুলতে চায়। সেখানে করপোরেট জগৎ ও বিশ্ববিদ্যালয় ফ্যাকাল্টির মধ্যকার সহযোগিতা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে করে তোলে অধিকতর শক্তিশালী। তাদের যৌথ উদ্যোগের গবেষণা থেকে উভয়পক্ষ বেশ উপকৃত হয়। এ প্রেক্ষাপটে কিউএস র‌্যাংকিংয়ে এবারের দ্বিতীয় স্থানে থাকা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ টানা যেতে পারে। এই বিশ্ববিদ্যালয় সুইডিশ ওষুধ কোম্পানি ‘অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র সহযোগিতায় গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবন করেছে একটি ‘অ্যান্টি-কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন’। এই ভ্যাক্সিন এখন বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় করোনার জন্য উদ্ভাবন করেছে র‌্যাপিড টেস্টিং টেকনোলজি ও একটি সহজে ব্যবহারোপযোগী ভ্যান্টিলেটর। এসব উদ্ভাবন মূলত এই বিশ্ববিদ্যালয়কে র‌্যাংকিংয়ে এগিয়ে রেখেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বুয়েট আমাদের বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে এ ধরনের সহযোগিতা পেলে হয়তো এ দু’টি বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিংয়ে আরো কিছুটা এগিয়ে যেতে পারত। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ ধরনের ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি পেয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র‌্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকার ক্ষেত্রে এটিও একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। এর ফলেই হয়তো নতুন এই কিউএস র‌্যাংকিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ১৭৭টি বিশ্ববিদ্যালয়, যার মধ্যে ১৯টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছে এবং সেই সাথে সেরা স্থানটিও পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি। এই সংখ্যা বিশ্বের অন্যসব দেশের তুলনায় সর্বাধিক।

আমাদের শিল্প খাতকে যুক্তরাষ্ট্রের এই উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। গবেষণা ও উন্নয়ন কাজ শুধু শিল্প খাতের তহবিলই নয় সরকারকেও বাজেট বরাদ্দ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে হবে। আমাদের সরকার দাবি করে, দেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে গেছে। কিন্তু আমরা দেখছি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ সেভাবে বাড়ছে না। শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো হয়, কিন্তু তা ব্যয় হয়ে যায় প্রতি বছর এ খাতের শিক্ষক-কর্মচারীর বর্ধিত বেতনভাতা জোগানোর পেছনে। ফলে গবেষণা খাতে তহবিলের আকাল কাটে না। যে জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষদের গবেষণায় নিয়োজিত করার সুযোগ পায় খুব কম। ফলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এনজিও প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে দেখা যায়। এর অবসান না ঘটাতে পারলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র‌্যাংকিং সন্তোষজনক পর্যায়ে নিয়ে তোলা কিছুতেই সম্ভব হবে না।

উপযুক্ত পরিবেশ পেলে বুয়েটও পারবে এর র‌্যাংকিংয়ের উন্নয়ন ঘটাতে। বুয়েট বিদ্যমান পরিবেশেও বেশ কিছু প্রাযুক্তিক উদ্ভাবন উপহার দিতে পারছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করতে সক্ষম হচ্ছে। নাসার রোবটিক চ্যালেঞ্জেও বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ভালো মেধার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছে। তহবিল দারিদ্র্য না থাকার কারণে সৌদি আরবের বাদশাহ আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয় কিউএস তালিকায় ১০৯ নম্বর অবস্থানে উঠতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের গবেষণা তহবিলের আকাল কাটাতে পারলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট ‘সেরা একশ’-এর তালিকায় থাকতে পারবে না, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।

আজকের দিনে গবেষণা ও আবিষ্কার-উদ্ভাবন সবচেয়ে বেশি মাত্রায় চলছে আইটি খাতে। সেজন্য আইটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই র‌্যাংকিংয়ে বেশি সাফল্য প্রদর্শন করছে। এর প্রতিফলন রয়েছে এবারের কিউএস র‌্যাংকিং তালিকায়। সুনির্দিষ্টভাবে, আমরা একটি উদাহরণ টানতে পারি ভারতের বেলায়। নতুন কিউএস র‌্যাংকিংয়ে ভারতের যে আটটি বিশ্ববিদ্যালয় ‘সেরা ৫০০’-এর তালিকায় স্থান পেয়েছে, এর মধ্যে সাতটিই আইটি বিশ্ববিদ্যালয়, আর একটি বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় (কার্যত এটিও আইটি বিশ্ববিদ্যালয়, কারণ প্রযুক্তি হচ্ছে বিজ্ঞানের বাণিজ্যিক শাখা)। অতএব, আমরা যদি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং বাড়াতে চাই তবে আইটি সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা কার্যক্রম আরো জোরালো করে তুলতে হবে।

হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং বাড়িয়ে তুলতে হলে প্রয়োজন : গবেষণা ও উন্নয়নের পরিধি সম্প্রসারণ ও কর্মকাণ্ড জোরদার করে তোলা। আর মাথায় রাখতে হবে, গবেষণা তহবিলের আকাল দূর করতে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা অপরিহার্য। সর্বোপরি আমাদের শিক্ষক ও ছাত্রসমাজকে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির বৃত্ত থেকে বের করে এনে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তবেই যদি কাটে আমাদের বিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং দারিদ্র্য।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement