০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ষষ্ঠ বিলুপ্তির মুখে ধরিত্রী

ষষ্ঠ বিলুপ্তির মুখে ধরিত্রী - ছবি : নয়া দিগন্ত

সমগ্র মানবজাতির সামনে আজ এক চরম বাস্তবতা হচ্ছে- আমাদের পৃথিবীটা ক্রমেই উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছে। পৃথিবীর এ উষ্ণতর হয়ে ওঠা বর্তমান হারে চলতে থাকলে আমরা শিগগিরই ‘সিক্সথ মাস এক্সটিঙ্কশন’ বা ‘ষষ্ঠ ব্যাপক বিলুপ্তির’ মুখে পড়তে পারি। এর আগে এই পৃথিবী আরো পাঁচবার এমন ধরনের ‘মাস এক্সটিঙ্কশন’ বা বড় ধরনের বিলুপ্তির মুখোমুখি হয়েছে। এগুলো ‘বিগ ফাইভ’ নামে পরিচিত। প্রথম বিলুপ্তির ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে ৪৪ থেকে ৪৫ কোটি বছর আগে। এ সময় দুটি ঘটনায় পৃথিবীর সব প্রজাতির প্রাণীর ৬০-৭০ শতাংশের বিলুপ্তি ঘটেছিল। দ্বিতীয় বিলুপ্তিটি ঘটে আজ থেকে ৩৬ কোটি থেকে সাড়ে ৩৭ কোটি বছর আগে। সে সময়ে পৃথিবীর সব প্রজাতির প্রাণীর ৭০ শতাংশ বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ বিলুপ্তির কাল পরিধি ছিল দুই কোটি বছর। এর পরের বিলুপ্তিকালটি ছিল আজ থেকে ২৫ কোটি বছর আগে। এ বিলুপ্তিকালে পৃথিবীর সব প্রজাতির প্রাণীর ৯০-৯৬ শতাংশের বিলুপ্তি ঘটেছিল। এর পরবর্তী বিলুপ্তির ঘটনাটি ঘটে ২০ কোটি বছর আগে। আর এ সময়ে পৃথিবীর সব প্রজাতির প্রাণীর অর্ধেকই বিলুপ্ত হয়ে যায়। সর্বশেষ বিলুপ্তির ঘটনাটি ঘটে ছয় কোটি ৬০ লাখ বছর আগে। সে সময়ে পৃথিবীর সব প্রজাতির প্রাণীর ৭৫ শতাংশ বিলুপ্ত হয়েছিল। ২০২০ সালে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বলা হয়, এসব বিলুপ্তির অন্যান্য কারণের মধ্যে ছিল বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও এতদসংশ্লিষ্ট প্রবল আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, অক্সিজেন কমে যাওয়া ও এলোপাতাড়ি গ্রহাণুর আঘাত কিংবা উল্কাপাত।

আমরা এখন মুখোমুখি ষষ্ঠ ব্যাপক বিলুপ্তির আশঙ্কায়। এটি অতীতের কোনো বিলুপ্তির মতো এলোপাতাড়ি গ্রহাণু বা উল্কাপাতের আঘাত কিংবা আগ্নেয়গিরির প্রবল অগ্ন্যুৎপাত ঘটবে না। ঘটবে মানবসৃষ্ট কারণে। প্রকৃতির প্রতি মানুষের বিরূপ আচরণই হবে এর জন্য দায়ী। এটি ঘটবে ফসিল জ্বালানির মাধ্যমে জীবমণ্ডলকে ভারসাম্যহীন করে তোলা ও বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ অতিমাত্রায় বাড়িয়ে তোলায়। পৃথিবীকে ক্রমেই উষ্ণতর করে ফেলায় সুমেরু অঞ্চলে পার্মাফ্রস্ট বাড়ছে গুণনীয়ক হারে। সুমেরু অঞ্চলের মিথেন নির্গমন শুরু হয়ে গেছে এবং তা অব্যাহতভাবে চলবে। মিথেন হচ্ছে কার্বনের চেয়েও অধিক শক্তিশালী হিট-ট্র্যাপিং গ্রিনহাউজ গ্যাস। কার্বন যেমন বায়ুমণ্ডলে তাপ আটকে রেখে বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করে তুলে জলবায়ুর ক্ষতিকর পরিবর্তন ঘটাচ্ছে, মিথেন নির্গমনও ঠিক একই কাজটি করছে; তবে আরো জোরালোভাবে। সব কিছুর সম্মিলিত প্রভাবে সম্ভাব্য ষষ্ঠ বিলুপ্তির দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এ বিলুপ্তির সময়ে আমাদের পৃথিবী উপরে উল্লিখিত তৃতীয় বিলুপ্তির সময়ের মতো উষ্ণ হয়ে উঠতে পারে, তখন আমাদের সে সময়ের পরিণতিই মেনে নিতে হবে- এমনটি জানাচ্ছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা।

বিজ্ঞানী ও পরিবেশবাদীদের এমন আশঙ্কার কারণ- আমরা কার্বন ডাই-অক্সাইড উদগীরণ ঠেকানো কিংবা সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে যেসব চুক্তি অতীতে করেছিলাম, সেগুলো বাস্তবায়নে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছি। এটিই হচ্ছে বিতর্কাতীত বহুজাতিক বাস্তবতা। ১৯৯২ সালের রিওডি জেনারিও সম্মেলন থেকে শুরু করে ১৯৯৭ সালের কিয়োটো প্রটোকল, ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি ও সর্বশেষ ২০১৯ সালের সব ধরনের কার্বন উদগীরণসংক্রান্ত সম্মেলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। কার্বন উদগীরণ অব্যাহতভাবে বেড়েই চলেছে। সাধারণ মানুষের এ ব্যর্থতা প্রশ্নে তেমন কোনো জ্ঞান, সচেতনতা কিংবা সাড়া নেই। থাকলেও কার্যকর পর্যায়ের নয়। কিন্তু আমাদের অজান্তেই এর বিরূপ প্রভাব পুরো মানবজাতির দিকেই ধেয়ে আসছে। আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে ভয়াবহ এক বিলুপ্তির অপেক্ষায়।

বলার অপেক্ষা রাখে না- আবহাওয়ার এ বিরূপ প্রভাবের পুরো বিষয়টি মানবজাতির অস্তিত্বকে সঙ্কটাপন্ন করে তুলছে। এ সঙ্কট মোকাবেলায় মানবজাতির সামনে একমাত্র উপায় হচ্ছে- একটি নতুন ধরনের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, যেটি একযোগে একতালে বিশ্বব্যাপী ‘কার্বন প্রাইসিং’ কার্যকর করবে। কার্বন প্রাইসিং হচ্ছে কার্বন উদগীরণ কিংবা গ্রিনহাউজ গ্যাস উদগীরণ কমিয়ে আনার একটি পদক্ষেপের নাম। নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ পদক্ষেপের মাধ্যমে কার্বন উদগীরণের উৎসমুখ থেকেই কার্বনের দাম বাড়িয়ে তোলা হয়, যাতে মানুষ কার্বনের ব্যবহার ধীরে ধীরে কমিয়ে কার্বনের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনে। কার্বন প্রাইসিংয়ের ক্ষেত্রে এমন বাজারকৌশল ব্যবহার করা হয়, যেখানে কার্বন উদগীরণের দায়টা উদগীরকদের কাঁধে ফেলা হয়। এর প্রশস্ততর লক্ষ্যটি হচ্ছে ফসিল জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে এনে বায়ুমণ্ডলকে রক্ষায় কার্বন ডাই-অক্সাইডের ব্যবহার কমিয়ে আনা। এ কার্বন প্রাইসিং পদক্ষেপ আমাদের জন্য প্রভূত উপকার বয়ে আনে।

এটি জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকানোর ক্ষেত্রে অন্যতম এক শক্তিশালী নীতি-কৌশল। এর মাধ্যমে বিশ্বের অর্থনীতি, ব্যবসায় ও বিনিয়োগ কর্মকাণ্ডে ভোক্তাদের আচরণ পরিবর্তন করে বায়ুমণ্ডলকে অঙ্গারমুক্ত তথা ডিকার্বনাইজেশনের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। সংক্ষেপে বললে- একটি সুপরিকল্পিত ‘কার্বন প্রাইসিং’ পদক্ষেপ তিন ধরনের উপকার সাধন করে : এটি পরিবেশ সংরক্ষণ করে, ক্লিন টেকনোলজিতে বিনিয়োগ আকর্ষিত করে এবং একই সাথে কার্বন কর আরোপের মাধ্যমে রাজস্ব বাড়িয়ে তোলে। আমরা যদি উল্লিখিত নতুন প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলে একটি সুপরিকল্পিত কার্বন প্রাইসিং নীতি-কৌশল বাস্তবায়নে নেমে পড়তে পারতাম এবং এ নীতি-কৌশল শতভাগ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পারতাম- তবে হয়তো সম্ভাব্য ষষ্ঠ বিলুপ্তির বিয়োগান্তক ঘটনা ঠেকানো সম্ভব হতো। তেমনটি সম্ভব করে তুলতে চাইলে নতুন এই প্রতিষ্ঠানকে দিতে হবে কার্যকর আন্তর্জাতিক আইনি সহায়তা ও তা বাস্তবায়নের পরিপূর্ণ ক্ষমতা। এটিকে করে তুলতে হবে সত্যিকারের কার্যকর এক ‘গ্লোবাল ইনস্টিটিউশন’। আর হ্যাঁ, এ প্রতিষ্ঠানের কোনো প্রস্তাবে যেন না থাকে কোনো দেশের ভেটো দেয়ার ক্ষমতা। এই প্রতিষ্ঠানে যারা বোর্ড মেম্বার থাকবেন তারা হবেন গুরুত্বপূর্ণ ও সুখ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, সেই সাথে থাকবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান। তেমন একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে কাজে নামতে পারলে আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে কার্বনের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে পারব।

জাতিসঙ্ঘের ক্লাইমেট চেঞ্জ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের (ইউএনএফসিসিসি) শীর্ষ সিদ্ধান্তদাতা সংস্থা হচ্ছে সিওপি (কনফারেন্স অব পার্টিজ)। গ্রিনহাউজ গ্যাস উদগীরণ স্থিতিশীল রাখা ও জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি মোকাবেলার লক্ষ্য নিয়ে ইউএনএফসিসিসি গঠিত হয় ১৯৯৪ সালে। এ লক্ষ্যে পৌঁছার সুনির্দিষ্ট আহ্বান নিয়ে শুরু হয় এর প্রতিটি বৈঠক। এসব বৈঠকে বিশ্বনেতারা তাদের অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের কথা বলেন। কিন্তু তারা তা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হন না। একই সাথে তারা প্রয়োজন বোধ করেন না, এমন একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায়, যেটি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবে কঠোরভাবে। তা করতে হলে প্রয়োজন শক্তিশালী নেতৃত্ব। ওপরে বর্ণিত ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা অপরিহার্য আগামী এক বছরের মধ্যে, যা এমন পরিকল্পনা হাতে নেবে, যাতে সমগ্র বিশ্ব একযোগে কাজে নামতে পারে ক্ষতিকর কার্বন নির্গমন চিরতরে বন্ধে তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে। শুধু প্রতিশ্রুতি দেয়া নয়, তা বাস্তবায়নে বাধ্য করবে এ প্রতিষ্ঠান; এ জন্য এই প্রতিষ্ঠানকে দিতে হবে আন্তর্জাতিক আইনি সহায়তা। এর আরেকটি বড় দায়িত্ব হবে কার্বন প্রাইসিং ধীরে ধীরে বাড়িয়ে তোলা।

কার্বন উদগীরণ কমিয়ে আনা সম্ভব বাজারভিত্তিক পদক্ষেপের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারগুলো ভূমিকা পালন করতে পারে ডিসিপ্লিনারিয়ান তথা কঠোর শাসক হিসেবে। তারা ভোক্তাদের বাধ্য করবে বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারে। বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো যাবে জাতীয় পর্যায়ে কার্বন উৎসের দাম বাড়িয়ে। যেসব পণ্যের ওপর কার্বন জ্বালানি নির্ভরশীল, সেসব পণ্য ধীরে ধীরে সরিয়ে নিতে বাজারকেই সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। ফিরিয়ে নিতে হবে অ-কার্বন পণ্য ও সেবার দিকে।

অতীতে পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়ে বিশ্ববাসীর যত অবহেলাই থাকুক, এখন আর সে অবহেলা প্রদর্শনের কোনো সুযোগ নেই। কারণ, এরই মধ্যে আমাদের পৃথিবীটা যেন বসে আছে এক জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের ওপর। চলতি বছরের দিকে ফিরে তাকালে সহজেই তা আন্দাজ-অনুমান করা যায়। বিভিন্ন দেশে এমনকি কোনো কোনো মহাদেশজুড়ে জলবায়ুর ভয়াবহ পরির্তনের ফলে চলছে দাবানলের ভয়ঙ্কর তাণ্ডব। বিশ্বের নানা দেশে ঘটে চলেছে দাবানলের অসংখ্য ঘটনা। অস্ট্রেলিয়ার দাবানলের মওসুমে ২০১৯-২০ সালে অস্ট্রেলিয়ায় ‘ব্ল্যাক সামার ফায়ার’ নামে পরিচিত দাবানলে প্রায় এক কোটি ৯০ লাখ হেক্টর বনভূমি পুড়ে গেছে। ধ্বংস হয়েছে তিন হাজার বাড়ি, নিহত হয়েছে ৩৩ জন। চলতি বছরের সাইবেরিয়ার দাবানলের ফলে উদগীরিত হয়েছে রেকর্ড পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড। দেশটির কার্বন-সমৃদ্ধ পিটল্যান্ডের অর্ধেকই পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশে দাবানলের কারণে বহু মানুষকে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হয়েছে। নিজেদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি পুড়ে ছাই হয়েছে। বিরান হয়েছে এবং হচ্ছে বিস্তীর্ণ বনভূমি।

‘গ্লোবাল ল্যান্ডস্কেপ ফোরাম’ বিশ্বব্যাপী দাবানল নিয়ে সম্প্রতি বেশ কয়েক দফা আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়ার ও ইন্দোনেশিয়ার বিশেষজ্ঞরা। আরেকটি আলোচনায় তুলে ধরা হয় আমাজন ও যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে ঘটে চলা অগ্ন্যুৎপাতের বিষয়টি। উভয় অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এসব অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী প্রকৃতির প্রতি মানুষের নির্বিচার আচরণ। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে ঘটছে এসব বৈশ্বিক দাবানল। দাবানলের মওসুম যেমন দীর্ঘায়িত হচ্ছে, তেমনি দাবানল এলাকারো বিস্তৃতি ঘটছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাড়ছে খরার দাপট। এর প্রভাবে আরো বাড়তে পারে দাবানলের ঘটনা। অস্ট্রেলিয়ায় বিগত কয় বছর ধরেই এ ধরনের খরা বেড়ে গেছে। এর প্রভাবেই সেখানে সর্বশেষ দাবানলের মওসুমে, বেড়েছে প্রকোপ- এমনটি মনে করছেন সিডনির নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাইমেট চেঞ্জ রিসার্চ সেন্টারের জলবায়ু-বিজ্ঞানী সারাহ পারকিনস-কার্কপেট্রিক। তিনি জোর দিয়ে বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে, বায়ুমণ্ডলে জমছে আরো বেশি পরিমাণে পাইরোকুমুলোনিমবাস ক্লাউড- এই ক্লাউড সৃষ্টি হয় তাপ-উৎসের উপরিভাগে। এই মেঘ ব্যাপক বজ্রপাতের ঝড় সৃষ্টি করে, যা দাবানলকে চার দিকে ছড়াতে সহায়তা করে। অস্ট্রেলিয়ায় বেশির ভাগ দাবানল সৃষ্টি হয় বজ্রপাত বা কোনো দুর্ঘটনার কারণে। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ুর পরিবর্তনই বেশির ভাগ দাবানলের কারণ।

গত বছর ইন্দোনেশিয়ার সাতটি প্রদেশের ১৬ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর এলাকা দাবানলে পুড়েছে, এর বেশির ভাগই ‘আইডল ল্যান্ড’, অর্থাৎ এগুলো আগে ছিল বনভূমি, যেগুলোতে কয়েক দফা আগুনে পুড়িয়ে গুল্ম রোপণ করে পরিবর্তিত করা হয়েছিল ঝোপঝাড়ে। যদিও দেশটিতে বেশির ভাগ আগুন লাগানো হয়েছিল নতুন কৃষিজমি সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে, বাস্তবে এ আগুন আরো বেশি এলাকায় পড়ে কার্যত দাবানলে রূপ নেয়।
‘গ্রিনপিস রাশিয়া’র বনাঞ্চলের আগুন সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞ অ্যান্টন বেনেসল্যাভেস্কি বলেছেন- সাইবেরিয়া ও রাশিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শীতকালের পরিধি আগের চেয়ে কমে আসছে; আবহাওয়া শুষ্কতর ও ঝড়ো হাওয়াময় হয়ে উঠছে। এ পরিস্থিতির কারণে আরো বড় বড় এলাকাজুড়ে দাবানলের ঘটনা ঘটছে। অতি সম্প্রতি আরো অনেক দেশে দাবানলের ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে। চলমান উষ্ণায়ন প্রক্রিয়া বন্ধ করতে না পারলে দাবানল বিস্তৃতি যে আরো দেশে সম্প্রসারিত হবে, সেটুকু নিশ্চিত।

দক্ষিণ গোলার্ধে আমাজন রেইনফরেস্ট হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর এক মুখ্য হাতিয়ার। এই বনভূমি বছরে শুষে নেয় ২০০ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড, যা বিশ্বে উদগীরিত কার্বন ডাই-অক্সাইডের ৫ শতাংশের সমান। কিন্তু বনভূমিটিকেও আজ উষ্ণায়ন ও খরার মাধ্যমে করে তোলা হয়েছে দাবানলের সহজ শিকার। এখন এ বনে গাছগুলোর পাতা শুকিয়ে যাচ্ছে। যখন-তখন ঘটছে দাবানল। মানুষও বনভূমি পুড়িয়ে এগুলোতে কৃষিজমি কিংবা চারণভূমি তৈরি করছে। একসময় আমাজন পরিচিত ছিল একটি ‘কার্বন সিঙ্ক’ নামে। আগামী এক দশকের মধ্যে তা পরিণত হতে যাচ্ছে একটি ‘কার্বন ইমিটারে’।

অনেক প্রাকৃতিক দৃশ্যসমৃদ্ধ এলাকায় আগুন দিয়ে চেষ্টা চলছে সেগুলোকে কৃষিজমিতে পরিণত করতে। এর ফলে প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। তা বিনষ্ট করছে পরিবেশের ভারসাম্য। সহায়তা করছে জলবায়ু পরবর্তনে। এমনটি ঘটছে রাশিয়ায়। সেখানে অনেক দাবানল সৃষ্টি হচ্ছে পরিত্যক্ত এলাকায়, যেগুলো সোভিয়েত আমলে ব্যবহার হতো কৃষিকাজে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব জমি কৃষকদের দিয়ে দেয়া উচিত চাষবাস কিংবা বনভূমি সৃষ্টির জন্য।

প্রকৃতির ওপর মানুষের নির্বিচার আচরণের ফলে দাবানল সৃষ্টি হওয়া ইন্দোনেশিয়ার জন্য একটি বড় ধরনের সমস্যা। সেখানে গত বছর ব্যাপক পিটল্যান্ড পোড়ানো হয়েছে এসব জমিকে বৃক্ষরোপণের জমিতে পরিণত করতে। এসব আগুনের কারণে বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়েছে ৭০ কাটি ৮০ লাখ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড- যা ২০১৯ সালে আমাজনের ছড়ানো কার্বন ডাই-অক্সাইডের দ্বিগুণের সমান। অনুমান করা হয় ইন্দোনেশিয়ার পিটল্যান্ডে রয়েছে সর্বমোট ২৮.১ গিগাটন কার্বন। আমাজনের বেলায় একই কথা খাটে। সেখানেও বনভূমি ইচ্ছাকৃতভাবে পুড়িয়ে চেষ্টা চলছে কৃষিজমি কিংবা চারণভূমি তৈরির। গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের দেয়া পরিসংখ্যান মতেÑ ব্রাজিলিয়ান আমাজন অঞ্চলের প্রায় ৭ শতাংশ বনভূমি হারিয়ে গেছে ২০১৯ সালে। ২০০২ সালে বনভূমি হারানোর এই হার ছিল মাত্র ০.৫ শতাংশ।

বিশ্বের বৃহত্তম নাতিশীতোষ্ণ আর্দ্রভূমি হচ্ছে প্যান্টানাল। এখানে বসবাস রয়েছে বিলুপ্তির হুমকির মুখে পড়া অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর। ২০১৯ সালে জানুয়ারি- আগস্ট সময়ে এ এলাকায় ঘটেছে রেকর্ড পরিমাণ অগ্নিকাণ্ড। এর ফলে এ সময়ে দক্ষিণ আমেরিকার ২০ হাজার ৩৬০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা পুড়ে ছাই হয়েছে। সয়া ও পশুখামারিরা গ্রীষ্মকালে এসব আগুন লাগায়। কিন্তু এ বছর খরা ও ঝড়োহাওয়ার কারণে এ আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। অনেক সড়ক ও খালবিল টপকিয়ে এর ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে অনেক আবাসিক এলাকায়ও। বলসোনারার প্রশাসনের শাসন শুরু হওয়ার এক বছরের মধ্যে ব্রাজিলিয়ান আমাজনে বননিধন ৯৬ শতাংশ বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। এভাবেই আমরা বিশ্বজুড়ে প্রকৃতি নিধন করে উষ্ণায়ন বাড়িয়ে তুলছি। তাই প্রকৃতি প্রস্তুত হচ্ছে আমাদের ওপর নানা ধরনের প্রতিশোধ নিতে। এ জন্য বলছি- আমরা এখন ষষ্ঠ বিলুপ্তির হুমকির মুখে। বিশ্বের প্রতিটি দেশ তথা সমগ্র মানবজাতির সম্মিলিত আন্তরিক প্রয়াসই কেবল বাঁচাতে পারে সম্ভাব্য এ বিলুপ্তি থেকে।


আরো সংবাদ



premium cement
গ্রিড লাইনের ত্রুটিতে সিলেট বিভাগে বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ভুক্তভোগী নারী ও তার পাশে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের হয়রানির প্রতিবাদ বাড্ডায় নারীর অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার কথিত স্বামী পলাতক গ্রেফতারকৃতদের পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করবে খতমে নবুওয়ত ঝিনাইদহ-১ আসনে উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নায়েব আলী জাতীয় গ্রিডে ত্রু‌টি, সিলেট বিভাগে বিদ্যুৎ বিপর্যয় ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য ঢাবিতে নিয়মিত ২০ আসন বরাদ্দ রেকর্ড গড়ে সাদিক খান আবারো লন্ডনের মেয়র আগামী ২ মাসের মধ্যে ভাঙ্গা-খুলনা-যশোর পর্যন্ত ট্রেন চালু হবে : জিল্লুল হাকিম ফতুল্লায় ব্যবসায়ী অপহরণ, গ্রেফতার ৭ তাপদাহের কারণে গোসল করতে গিয়ে কলেজছাত্রের মৃত্যু

সকল