২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইসলামী অর্থনীতি : প্রয়োগ ও বাস্তবতা

ইসলামী অর্থনীতি : প্রয়োগ ও বাস্তবতা - ছবি : নয়া দিগন্ত

ইসলামী অর্থনীতির প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রথমেই বলতে হয়, এটা কোনো নতুন অর্থনীতি নয়। এর মূল ভিত্তি রয়েছে কুরআনুল করিমে যা পনেরোশত বছর আগে নাজিল হয়েছিল। এর অপর মূল ভিত্তি রয়েছে রাসূলুল্লাহ সা:-এর শিক্ষায়। এর প্রয়োগও শুরু হয় রাসূলুল্লাহ সা:-এর সময়ই।

রাসূল সা: মদিনায় গিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন। সেখানে বিভিন্ন জাতির লোকেরা ছিল। বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন গোষ্ঠীর লোকেরা ছিল। রাসূলুল্লাহ সা: নবী ছিলেন; একই সাথে তিনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন। সব বিষয়ে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন, মৌলিক সিদ্ধান্তগুলো। তাঁর আমলে তাঁরই নির্দেশনায় সে দেশের অর্থনীতিসহ সবকিছু পরিচালিত হয়েছে। তখন থেকেই স্বাভাবিকভাবে মদিনা রাষ্ট্রে ইসলামী অর্থনীতির প্রয়োগ শুরু হলো।

রাসূল সা: যে সব ব্যবসা-বাণিজ্য পেয়েছিলেন তাতে দেখলেন, তার মধ্যে কিছু ব্যবসা জুলুমভিত্তিক। সেগুলো সুবিচারমূলক নয়। সেগুলোকে তিনি বাতিল করে দিলেন (যেমন : মুলামাসা এবং মুনাবাদা : দ্রষ্টব্য : বুখারি, কিতাবুল বাই)। তেমনি কৃষির ক্ষেত্রেও কিছু ব্যবসা ত্রুটিপূর্ণ থাকায় তিনি তাও বাতিল করে দেন। তিনি অনেক উৎপাদনকে বাতিল করে দিয়েছেন। যেমন সে দেশে মদ উৎপাদন করা সম্ভব ছিল না। তিনি কিছু পেশাকেও অবৈধ ঘোষণা করলেন। জুয়া খেলা সেখানে যেমন সম্ভব ছিল না, তেমনি অশ্লীল কোনো কিছুর উৎপাদনও সম্ভব ছিল না। এভাবে ইসলামী অর্থনীতির প্রয়োগ রাসূলুল্লাহ সা:-এর যুগেই শুরু হলো।

রাসূল সা:-এর জীবনের শেষ দিকে এসে সুদ সম্পূর্ণরূপে উৎখাত হয়ে যায়। তখন সুদমুক্ত একটি অর্থনীতি এসে যায়-যার মূল ভিত্তি ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য। তখন থেকেই ব্যক্তিমালিকানা কিংবা শরিকানায় ব্যবসা হতো।

শরিক মালিকানায় লাভ-লোকসানকে ভাগ করে নেয়া হতো। কিংবা একজনের মূলধন থাকলে অন্যজনের শ্রম হতো-যাকে মুদারাবা বলা হয়। সেই ব্যবস্থাতেও লাভ বা লোকসান ভাগ করে নেয়া হতো। এই মূলনীতির ভিত্তিতেই উমাইয়া (এর সময় প্রায় একশ বছর) এবং আব্বাসীয় (প্রায় সাত আটশ বছর)- এই সম্পূর্ণ যুগে ইসলামী অর্থনীতি চালু ছিল। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, উমাইয়াদের শাসন বিস্তীর্ণ এলাকায় ছিল। উত্তর আফ্রিকাসহ ভারতের একটা অংশ তাদের অধীনে ছিল। মধ্য এশিয়া ও গোটা মধ্যপ্রাচ্যও তাদের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে আব্বাসীয়দের আমলে এটা আরো বিস্তার লাভ করে। কাজেই সেটা ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে বড় শক্তি। তারা ছিল তখনকার সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রশক্তি,আন্তর্জাতিক শক্তি এবং সামরিক শক্তি।

আমরা জানি, সেই সময়ে অর্থনীতির ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছিল। শিল্পের, ব্যবসার, যোগাযোগের ক্ষেত্রে উন্নয়ন হয়েছিল। শিক্ষা, সাহিত্যের উন্নয়ন হয়েছিল। স্থাপত্যের উন্নয়ন হয়েছিল। সুতরাং বলা যায়, তারা একটি উন্নত সভ্যতার অধিকারী ছিলেন। তাদের সে রাষ্ট্রেরও আইনগত ভিত্তি ছিল ইসলামী শরিয়াহ। সেই রাষ্ট্রের বৈধতার ভিত্তি ছিল ইসলাম বা আল কুরআনুল কারিম। কাজেই সেই রাষ্ট্র ইসলামী অর্থনীতিকে ফলো করেছিল।

‘ইসলামী অর্থনীতি’ বলতে কি বুঝায়? সেই যুগে যে প্রযুক্তি ছিল সেটাই কি ইসলামী অর্থনীতি? নাকি অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইসলামের যে শিক্ষা, ইসলামের যে লক্ষ্য এবং ইসলামের যে মূল্যবোধ সেগুলোকেই কার্যকর করার নাম ইসলামী অর্থনীতি? আবার ইসলামী অর্থনীতির প্রশ্নে বলা যায়- কী অর্থে সেখানে ইসলামী অর্থনীতির প্রয়োগ করা হয়েছিল? এটা স্বীকার করতেই হবে যে, টেকনোলজিই ইসলামী অর্থনীতির মূল কথা নয়। কারণ টেকনোলজি যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়ে যায়। তেমনিভাবে যে ব্যবসায় সংগঠন, সেটাও মূল কথা নয়। আজকের দিনে আমরা করপোরেশন দেখছি, যেটা আগের দিনে ছিল না। এই করপোরেশন সিস্টেম মাত্র একশ-দুইশ বছর আগে এসেছে। অর্থাৎ বোঝা যায়, ব্যবসা সংগঠনের শেপ কী বা কী পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যবসাকে বা প্রতিষ্ঠানটিকে সংগঠিত করা হয়েছে- সেটা মূল বিষয় নয়। মূল বিষয় হলো, কোন জিনিসে ব্যবসা করা বৈধ আর কোন জিনিসে ব্যবসা করা বৈধ নয় এবং কোন পদ্ধতিতে ব্যবসা করা বৈধ আর কোন পদ্ধতিতে ব্যবসা করা বৈধ নয়।

কাজেই আমরা যখন ইসলামী অর্থনীতির কথা বা এর প্রয়োগের কথা বলছি তখন আমরা বুঝাচ্ছি তার নীতিগুলোকে; তার মূল্যবোধ, তার লক্ষ্য কী। এটা কি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তন চাচ্ছে- এই ভিত্তিতে আমরা বিষয়টিকে দেখছি।

আজকের দিনে যে ইসলামী অর্থনীতি কায়েম হবে, সেখানে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করা হবে। নতুন যে বিজনেস অর্গানাইজেশন, যেমন আগে উল্লিখিত করপোরেশন অথবা জয়েন্ট স্টক কোম্পানি এগুলো সেখানে থাকবে। এখানে শেয়ার ব্যবস্থা থাকবে। আগের দিনে শেয়ারের ধারণা ছিল না। বাস্তবে বিভিন্ন মালিকানা থাকলেও তখন শেয়ার সার্টিফিকেট ছিল না, শেয়ারের ভিত্তিতে মালিকানা ভাগ করা হতো না। এগুলো সবই গ্রহণ করা হবে। এ প্রসঙ্গে আমরা জানি, ওআইসির ফিকাহ একাডেমি এগুলোকে বৈধ ঘোষণা করেছে। শ্রেষ্ঠ আলিম দ্বারা সকল যুগেই এ সব অর্গানাইজেশন নতুন টেকনোলজি বা শেয়ার সার্টিফিকেট (যদি তা বৈধ ব্যবসার হয়) কে তারা বৈধ ঘোষণা করেছেন। (চলবে)

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার


আরো সংবাদ



premium cement