রাজধানীর একটি প্রধান সড়ক। দু’টি রেস্তোরাঁ পাশাপাশি। দুটোই বেশ চালু, সরগরম থাকে রাতদিন। মাহে রমজান আসার সাথে সাথে সম্পূর্ণ বদলে গেল দৃশ্যপট। একটি রেস্তোরাঁ ‘পর্দানশীন’, অপরটি একদম বন্ধ। এই পর্দা ধর্মভীরুতা কিংবা রক্ষণশীলতা নয়, অনেকের ধারণা অনুযায়ী, ‘প্রগতিশীলতার পর্দা’। অর্থাৎ পর্দার আড়ালে রোজার মাসেও দিনের বেলায় চলে খানাপিনা। বন্ধ রেস্তোরাঁটির সামনে ব্যানার ঝুলছে। এতে লেখা- ‘মাহে রমজান তাকওয়া অর্জনের মাস। এ মাসই হোক আপনার জীবনে পরিবর্তন আনয়নের মাস। নেকি হাসিল করুন; অন্যকে নেকি হাসিল করতে উৎসাহিত করুন।’ রোজার মাসে দিনের বেলায় খাবার দোকান বন্ধ রাখার আহ্বানও রয়েছে ব্যানারটিতে।
ঢাকা নগরীর কোনো কোনো জনাকীর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ সড়কে এমন হোটেল রেস্তোরাঁও রোজার মাসে বন্ধ থাকে, যেগুলো বছরের অন্যান্য সময়ে দিনরাত কাস্টমারের ভিড়ে থাকে সরগরম। কোথাও কোথাও অমুসলিমের মালিকানাধীন খাবার দোকানও থাকে রোজার মাসে বন্ধ। এর বিপরীতে, মুসলিম মালিকদের অনেককে ‘টু ইন ওয়ান’ হিসেবে পর্দা ব্যবহার করতে দেখা গেছে। অর্থাৎ, রমজানে দিনভর হোটেল-রেস্তোরাঁর সামনে ব্যানারের পর্দা ঝোলে। এতে লেখা থাকে- ‘এখানে বিশাল ইফতারের আয়োজন।’ এরপর হয়তো সুস্বাদু সব আইটেমের উল্লেখ। এহেন পর্দায় ইফতারের প্রচারণা আর রোজার মাসে দিনের বেলায় ‘গ্রাহকসেবা’- দুটোই চলে অবাধে। তেজারতের এই লাভজনক তরিকা দেখে বাঙালির বুদ্ধির তারিফ করতে হয়।
রোজার মাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো সংযম। আল কুরআনে তাকওয়া অর্জন করতে বলা হয়েছে, যা সংযম ছাড়া সম্ভব নয়। বাস্তবে নানা রকমের খাবার আর পোশাকের প্রচারণায় মনে হয়, রোজার মাস মানে খাদ্যে অসংযম প্রদর্শনের মোক্ষম উপলক্ষ। সেই সাথে হরেক ফ্যাশনের সাজ পোশাকের পেছনে ব্যয়ের বহর বেলাগাম করার উপযুক্ত মওসুম।
এ মাসে মসজিদেও ভিড়, মার্কেটেও। খতম তারাবির জামাতে লোক ধরে না। রোজার দিনগুলো যত পার হয়, ততই শপিংমল আর মার্কেটে সমাগম বাড়তে থাকে। অথচ কোনো কোনো মসজিদে রোজার প্রথম দিকের মতো উপচানো ভিড় পরে চোখে পড়ে না। কারণ তখন অনেকে বেচাকেনায় অর্থাৎ ব্যবসায় ও মার্কেটিংয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আল্লাহ তায়ালা তার কিতাবে বলেছেন, মোক্ষম তেজারত বা ব্যবসার কথা, যা পরজীবনে অনন্তকালের জন্য মুনাফার নিশ্চয়তা দেবে। আমরা কিন্তু অপেক্ষা করতে রাজি নই মোটেও। তর সয়না তেজারতে। ‘নগদ যা পাও, হাত পেতে নাও,/ বাকির খাতা শূন্য থাক।’ তাই তো মাহে রমজানে পুণ্য হাসিলের চেয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়ার দিকে অনেকের মনোযোগ বেশি।
প্রতি বছর রোজা আসে আর সীমিত আয়ের মানুষ, সৎ নি¤œ ও মধ্যবিত্তদের জন্য এক ধরনের বোঝার আতঙ্ক দেখা দেয়। এটা হলো, নিত্যপণ্য থেকে বিলাসদ্রব্য- সবকিছুই আগুন দামে কেনার দুশ্চিন্তা ও দুর্ভোগ। অন্যান্য দেশে রোজার মাসে জিনিসের দাম কমে। অথচ বিশ্বের অন্যতম প্রধান মুসলিম অধ্যুষিত এ দেশে দাম শুধু বেড়ে যায়। আজকাল রমজানকে পবিত্র রাখার জন্য এ মাসে দ্রব্যমূল্য না বাড়িয়ে অনেক ক্ষেত্রে মাসটি আসার আগেই দাম অকারণে বাড়িয়ে দেয়ার মতো অপবিত্র কর্মটি সম্পন্ন করা হয়।
এবার পত্রিকার একটি খবর বাংলাদেশের মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের জন্য শিক্ষণীয় হওয়া উচিত। খবরটি হলো, ‘আমিরাতে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় রমজানে।’ অবশ্য আরো বেশ ক’টি মুসলিম রাষ্ট্রে এ মাসে বিশেষ ছাড় দেয়ার ঐতিহ্য রয়েছে। এভাবে রোজাদারদের জন্য বিশেষ উপহারের মাধ্যমে পুণ্য হাসিলের প্রয়াস পান অনেক বিক্রেতা। বাংলাদেশে কোনো কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ছাড় দেয়, তবে তা মাহে রমজান নয়, দেয়া হয় ঈদ উপলক্ষে। তদুপরি দৃশ্যত লোভনীয় সেই ছাড় পেতে যত শর্তের বেড়া পার হতে হয়, তা দেখে বলা যায়, ‘খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি।’
পত্রিকা জানিয়েছে, পবিত্র রমজান উপলক্ষে আরব আমিরাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে শতকরা ৭৫ ভাগ পর্যন্ত ছাড় পাচ্ছেন ক্রেতারা। এ মাসে পণ্যের দাম যাতে কম থাকে, সে জন্য অতিরিক্ত ভর্তুকি দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশ্বখ্যাত চেইনশপ ‘ক্যারেফুর’সহ বড় বড় বিক্রেতারা অন্তত এক হাজার খাদ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছে। ‘ক্যারেফুর’ জানায়, তারা রমজানে তিন কোটি দিরহাম ভর্তুকি দিচ্ছেন। ফলে তাদের দোকানে কেনাকাটায় ভোক্তাদের মোট পাঁচ কোটি দিরহাম বেঁচে যাবে। রমজান মাসের শুরুতে আমিরাতের অর্থ মন্ত্রণালয় খুচরা পণ্য বিক্রেতাদের সাথে বৈঠক করে তাদের আহ্বান জানায়, যাতে ১০ হাজার আইটেমে ছাড় দেয়া হয়। আর আমাদের বাংলাদেশে রোজার সময়ে কেনাকাটার চিন্তা করলে পণ্যের আগুন দামে গায়ে যেন জ্বর চলে আসে। এ দেশের সরকার কখন রমজানে দাম কমানোর ওয়াদা কার্যকর করবে আর সীমিত আয়ের রোজাদাররা স্বস্তির সাথে সিয়াম সাধনার সুযোগ পাবেন?
মার্কেট প্রসঙ্গে বলতে গেলে রমজানে জুমার নামাজ আদায়ের সমস্যা নিয়ে বলা জরুরি। এ মাসে শপিংয়ের ভিড় যেমন বাড়ে, তেমনি মার্কেটগুলোর ক্রেতা ও বিক্রেতাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠই অন্তত জুমার জামাতে শামিল হতে আগ্রহী। কিন্তু শপিংমলের কাছের মসজিদগুলোতে এত বেশি সমাগম হয় যে, মসজিদের ছাদ, আশপাশের রাস্তাঘাট, মার্কেটের প্রাঙ্গণ, বারান্দা- সব জায়গা মুসল্লিতে ভর্তি হয়ে যায়। তবুও অনেকে স্থানাভাবে জুমার নামাজ আদায় করতে ব্যর্থ হন। গত শুক্রবার দেশের বৃহত্তম ও সর্বাধুনিক মার্কেটগুলোর একটি, রাজধানীর বসুন্ধরা শপিং সিটিতে দৃশ্য দেখা গেছে। অনেকে বাধ্য হয়ে এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েছেন যে, তারা ছিলেন মসজিদের ইমাম সাহেবের বেশ কিছুটা সামনে বা পশ্চিমে। অথচ বড় শপিংমলগুলোতে সর্বদাই নামাজের সুপরিসর ব্যবস্থা থাকে; সেখানে অন্তত রোজার দিনে জুমারও ব্যবস্থা করা গেলে জনগণের দুর্ভোগ কমবে।
দেশে গত কয়েক বছর ধরে উন্নয়নের মহাজোয়ার। এই ‘ডিজিটাল ডিল্যুজ’ বা ডিজিটাল মহাপ্লাবনে গণতন্ত্র, সুশাসন, স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা কোথাও ডুবেছে, কোথাওবা হাবুডুবু খাচ্ছে। আর দেশবাসী পানিবন্দী অবস্থায় কোনো মতে ভেসে থেকে ‘উন্নয়ন বটিকা’ সেবন করে বেঁচে আছে। এমন বেহাল দশার মাঝে এবার ‘রমজান তোহফা’ হিসেবে এসেছে গ্যাস সঙ্কট। অতীতে এমনটা না হলেও এ বছর রোজার মাসের সাথে গ্যাস দুর্ভোগেরও আগমন ঘটেছে। ফলে খোদ ঢাকা শহরে অনেককে হোটেলে সারতে হয়েছে সেহরি।
ইফতারির বাজার নিয়ে কিছু বলতেও ভয় হয়। কারণ, বিভিন্ন আইটেমের যে লাগাম ছাড়া দাম, তাতে নি¤œ ও মধ্যবিত্ত মানুষ চোখে সর্ষেফুল দেখতে বাধ্য। উন্নতমানের রেস্তোরাঁয় ইফতার করা মানে, মাথাপিছু কয়েক শ’ টাকা পকেট থেকে খসাতে হবে। যেখানে একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে পাঁচটি আইটেমের বুফে খাবার ২৩০ টাকা, সেখানে ইফতারি বাবদ বিভিন্ন দোকানে ঢালতে হচ্ছে এর চেয়ে বেশি। এক জায়গায় দেখা গেল, ‘অভিজাত’ রেস্তোরাঁর গায়ে ব্যানারে জানানো হয়েছে ইফতার করার খরচের পরিমাণ। এর মধ্যে ওঋঞঅজ ঋজঊঊউঙগ-এর চার্জ সবচেয়ে বেশি, ৪০০ টাকা থেকে এক টাকা কম! ‘ফ্রিডম’ বলতে হয়তো ইচ্ছেমতো খাওয়ার স্বাধীনতাকে বোঝানো হচ্ছে। এ দিকে বাজারে খেজুরের কেজি ২০০ থেকে ৫০০ টাকা। রোজার দিনে কলা ছোটগুলোর দাম ডাবল আর বড়গুলোর দাম তিন গুণ হয়েছে অন্য সময়ের তুলনায়।
রোজার মাসে সংযমের তাগিদ দেয়া হয়েছে। যেসব দেশে মুসলমান বনাম মুসলমান যুদ্ধ-সঙ্ঘাত, সেখানেও হানাহানি ও খুনাখুনিতে সংযমের দেখা মেলে কমই। সে ক্ষেত্রে এ সময়ে ইসরাইলের হত্যাযজ্ঞ আর কাশ্মিরে ভারতীয় বর্বরতা যে চলবে, তা একপ্রকার নিশ্চিত।
অবরুদ্ধ গাজাবাসী ইহুদিবাদীদের পৈশাচিকতায় যখন প্রতিনিয়ত মৃত্যুর প্রহর গুনছেন, তখন গাজা থেকে মিসর যাতায়াতের টানেল রমজানে খোলা রাখার সংবাদ কিঞ্চিৎ স্বস্তি দিচ্ছে। এ দিকে মাহে রমজানে কাশ্মিরে স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহীদের সাথে দিল্লির অব্যাহত সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের সাময়িক বিরতির ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। তার কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদির বিজেপি। তবুও প্রধানমন্ত্রী মোদি এতে রাজি হননি। ভারত সরকার রোজা উপলক্ষে কাশ্মিরে ‘যুদ্ধবিরতি’র প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় পরিস্থিতি আগের মতোই সন্ত্রাস-সহিংসতাপূর্ণ। এ অবস্থার আরো অবনতি ঘটলে কাশ্মিরি মুসলমানদের ঈদ উদযাপন করা সম্ভব না-ও হতে পারে। বছর দুয়েক আগে তেমনটাই হয়েছিল সেখানে।
মুই কী হনুরে
রোজার মাসে কেবল ইফতারসামগ্রী নয়, সেই সাথে সবজির দামও বেড়ে যায় অনেক। বোধ হয়, ‘জাতে ওঠা’র জন্য এটা করা হয়। এবারো রমজানের শুরুতে পেঁয়াজের ঝাঁজ আর মরিচের ঝাল অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে পেঁয়াজের বিপুল সরবরাহে দাম কমেছে। অবশ্য ভারত থেকে এর চেয়ে অনেক কম দামে এনে বিক্রেতারা বেশ মুনাফা লুটছে। কাঁচামরিচের বাজারে বিস্ফোরণ এখনো না ঘটলেও দামটা বেশ চড়া। আর রমজানে বেগুনের আকাশছোঁয়া দাম বাড়ানো যেন বেপারির প্রেস্টিজ ইস্যু। বেগুনি ছাড়া ইফতার জমে না- এমন ভুল ধারণার দরুন চিকন লম্বা বেগুনের দাম ‘সেঞ্চুরি’ করেছে ইতোমধ্যেই।
একটি ছড়ায় সবজি বাজারের রমজানি রমরমার ছবি ফুটে উঠেছে এভাবে- শতেক পূর্ণ করল বেগুন, লংকাটা ছুঁই ছুঁই/পাল্লা দিয়ে ছুটছে ভীষণ শসা, উচ্ছে-দুই।/আলু পটোল শিম করলা লালশাক এবং পুঁই/ইচ্ছে যেন, নি¤œ দরে কেনো মাথা নুই?/কাঁচকলা ও মুলা ভেণ্ডির দামের কথা থুই/চিচিঙ্গা আর পেঁপের হাতে যেন দরের সুঁই/ত্রিগুণ দামের বরবটির ভাব, এটা বিদেশ ভুঁই/ রোজা এলে সবজিদের ঠাট, কী হনুরে মুই।
(জাকির আজাদ/ইত্তেফাক-২৪.৫.১৮)হ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা