১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা উঠল : এবারে কেমন হবে উৎপাদন

নিষেধাজ্ঞা শেষে ভোলায় ইলিশ আহরণ করছেন জেলেরা - ছবি : সংগৃহীত

ভোলার জেলে মো: আব্দুল হাশেম আঞ্চলিক ভাষায় বলেছেন, ‘এবার গতবারের তুলনায় ইলিশ কম পাওয়া গেছে। ট্রলারের তেল খরচ, বাজার খরচ ও আনুষঙ্গিক খরচ কৈরা যে মাছ পাইছি তাতে খরচ পোষায় নাই। ছোট ছোট মাত্র চারটা ইলিশ পাইছি, বিক্রি করছি পনেরেশো টাকায়।’

ইলিশ ধরার ওপর টানা দু’মাসের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর বুধবার ভোররাতে তিনি বেরিয়েছিলেন মেঘনায় মাছ ধরতে। বেলা ১২টা নাগাদ ফিরে এলে নদীর ঘাট থেকেই তার সাথে কথা হচ্ছিল।

তিনি বলেন, ‘ছোট ট্রলারে আট শ’ টাকা খরচ করে পনের শ’ টাকার মাছ পাইছি এটা পোষায় না। গতবার আরো বেশি মাছ পাইছিলাম।’

জেলেদের এই আক্ষেপের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মৎস্য কর্মকর্তারা বলেন, ইলিশ প্রাপ্তি অমাবস্যা-পূর্ণিমা ও বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে। ফলে অমাবস্যা ও বৃষ্টি হলে দু-এক দিনের মধ্যেই অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে।

ভোলার মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দে জানান, ‘দু’মাস বন্ধ থাকার পরে জেলেদের আকাঙ্ক্ষা থাকে অনেক ইলিশ পাবে। কিন্তু বৃষ্টি না আসা পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়বে না। এখনো একফোঁটা বৃষ্টি নেই ভোলাতে।’

তিনি বলেন, ‘আবহাওয়া অফিস বলেছে দু-এক দিনের মধ্যেই বৃষ্টি হবে। প্রত্যাশা করছি, বৃষ্টির সাথে সাথে ইলিশ উঠবে। আর অমাবস্যা-পূর্ণিমা জোয়ারের বিষয়ও রয়েছে। সামনে অমাবস্যা শুরুর সাথে সাথে আর যদি একটু বৃষ্টি হয় তবে আশা করছি তারা কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ ইলিশ মাছ তারা পাবে।’

তবে এ বছর ইলিশের উৎপাদন পৌনে ছয় লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন ইলিশ গবেষক ড. মো: আনিছুর রহমান।

যা বলছেন জেলে ও আড়তদাররা
দু’মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে আবারো ইলিশ মাছ শিকার করতে অনুমতি পেয়েছেন জেলেরা। তবে বেশ কয়েকজন জেলেই আশানুরূপ ইলিশ মাছ না পাওয়ার আক্ষেপ করেছেন।

ভোলা সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের তুলাতুলি গ্রামের জেলে মোহাম্মদ জামাল মাঝি বলেন, ‘পাঁচ জেলেকে নিয়ে ভোর থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ইলিশ শিকার করছি। প্রায় এক হাজার ২০০ টাকার তেল খরচ করে বিভিন্ন সাইজের ছয়টা ইলিশ পাইছি। ওই ইলিশ তুলাতুলি মৎস্য ঘাটে আড়তদার নিলামে বিক্রি করে তিন হাজার ৬০০ টাকা দিছে। তেলের খরচ বাদে বাকি দুই হাজার ২০০ টাকা পাঁচ জেলে ভাগ কৈরা নিছি। খরচই পোষায়নি।’

আরেক জেলে মো: মোস্তফা মাঝি বলেন, ‘আশা ছিল নদীতে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার ইলিশ ধরা পড়ব। আটটা ইলিশ পাইছি। তুলাতুলি ঘাটে বিক্রি কৈরা পাঁচ হাজার টাকা পাইছি।’

তুলাতুলি মৎস্য ঘাটের আড়তদার মো: আব্দুল খালেক বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার সময় চাঁদপুর ও ঢাকার আড়ত থেকে দাদন এনে জেলেদের সংসার খরচ ও ঈদ করতে দিছি। আর নিষেধাজ্ঞা শেষে জেলেরা নদীতে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ ইলিশ এনে আমাদের কাছে বিক্রি করে। ওই ইলিশ পাইকারি আড়তে বিক্রি করে দাদন পরিশোধ করি। কিন্তু এবার জেলেরা নদীতে যথেষ্ট পরিমাণ ইলিশ না পাওয়ায় পাইকারি আড়তে মাছ কিভাবে পাঠাব?’

যা বলছেন মৎস্য কর্মকর্তারা
দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশ মাছের অবদান প্রায় ১২ শতাংশ। বার্ষিক উৎপাদন প্রায় তিন লাখ ৪৬ হাজার টন, যার বাজার মূল্য ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

আর জিডিপিতে ইলিশ মাছের অবদান প্রায় এক শতাংশ।

ভোলার মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দে বলেন, ‘মার্চ-এপ্রিল এই দু’মাস ইলিশ নদীতে খুব বেশি মুভ করে না। এই সময় শুধু জাটকাগুলো বিচরণ করে। জাটকাগুলোর বিচরণকালের জন্যই অভয়াশ্রমে শিকার নিষিদ্ধ। জাটকাগুলো ম্যাক্সিমামই ফিরে গেছে। ইলিশ টুকটাক আসতেছে কমবেশি। একেবারেই খারাপ না। তবে এখনো পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ পাইনি। হয়তো আরো দু-এক দিন সময় লাগবে।’

তিনি বলেন, ‘অভয়াশ্রমে নিষেধাজ্ঞার আগে যে পরিমাণ ইলিশ পাওয়া যাচ্ছিল এখনো সে পরিমাণই পাওয়া যাচ্ছে। বৃষ্টি পড়লে বা ইলিশের মাইগ্রেশন দৃশ্যমান হলেই বলতে পারব কী পরিমাণ ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে, যেহেতু জেলেরা নেমেছে। এছাড়া দৌলতখান, লালমোহন, ভোলা সদরে খবর নিয়েছি, মাছ মোটামুটি পাওয়া গেছে বলা যায়।’

তবে জেলেদের ইলিশ মাছ কম পাওয়ার এমন অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন ইলিশ গবেষক ও মৎস্যবিজ্ঞানী ড. মো: আনিছুর রহমান। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরিচালক ও চাঁদপুরে ইলিশ গবেষণা কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘প্রান্তিক পর্যায়ের জেলেদের এটা বরাবরের অভিযোগ। সামগ্রিকভাবে কিন্তু ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। অভিযোগ সত্য হলে বাস্তবে ইলিশের মোট উৎপাদন বাড়ত না। এখন সারাবছরই ইলিশ পাওয়া যায়। প্রত্যেকবারই জেলেরা বলে উৎপাদন কম ... তাহলে তো বাজারেও কম থাকত ইলিশ।’

তিনি আরো বলেন, ‘এ বছর ইলিশের উৎপাদন পৌনে ছয় লাখ টনে পৌঁছাবে বলে আমরা আশা করছি। কারণ এ বছর যে পরিমাণ প্রোটেকশন তারা পেয়েছে সে কারণে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন ভালো হবে।’

ইলিশ মাছ আহরণের সময় বেশ কয়েকটি বিষয় অনুসরণের জন্য ইতোমধ্যেই মৎস্য বিভাগ থেকে নির্দেশনা দেয়া রয়েছে।

অক্টোবরের যে ২২ দিন মা ইলিশ ডিম ছাড়ে সে সময় মাছ না ধরা, জাটকা না ধরা এমন নির্দিষ্ট নিয়মগুলো জেলেরা মানলে ইলিশ মাছ উৎপাদন বাড়বে বলে মনে করছেন গবেষকরা।

বর্তমানে আবহাওয়ার যে পরিবর্তিত পরিস্থিতি তাতে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘পানির গুণাগুণ, তীব্র তাপদাহ এসব ইলিশের জন্য বিরূপ প্রভাব ফেলবে না। কারণ ইলিশ গভীর জলের মাছ। তাপদাহ হলেও এটা অনেকখানি নিরাপদ থাকে। প্রাকৃতিক বড় কোনো ধরনের বিপর্যয় বা মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যা না হলে এবার ইলিশের কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন বাড়বে বলে আশা করি। বাড়বে বৈ কমবে না।’

ইলিশের অভয়াশ্রম এবং প্রজনন কেন্দ্র
ওয়ার্ল্ডফিশের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে।

বাংলাদেশে ইলিশের চারটি প্রজনন ক্ষেত্র এবং ছয়টি অভয়াশ্রম আছে।

চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে শুরু করে ভোলার লালমোহন উপজেলা পর্যন্ত ইলিশের সবচেয়ে বড় প্রজনন ক্ষেত্র।

বিশেষ করে মনপুরা, ঢালচর, বালিরচর, মৌলভীরচর- এগুলো হচ্ছে ইলিশের ডিম ছাড়ার সবচেয়ে বড় পয়েন্ট।

চট্টগ্রাম, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চাঁদপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা মিলিয়ে প্রায় সাত হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ইলিশ মাছ সবচেয়ে বেশি ডিম ছাড়ে। এর বাইরের উপকূলের অন্যান্য নদীগুলোতেও ইলিশ ডিম ছাড়ে।

ইলিশের অভয়াশ্রমগুলো মূলত মেঘনা নদী ও তার অববাহিকা এবং পদ্মা ও মেঘনার সংযোগস্থলে অবস্থিত।

এর মধ্যে চাঁদপুরে মেঘনা নদীর নিম্ন অববাহিকার ১০০ কিলোমিটার এলাকা, ভোলায় মেঘনা নদীর শাহবাজপুর শাখা নদীর ৯০ কিলোমিটার এলাকা, তেঁতুলিয়া নদীর প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকা অন্যতম।

এছাড়া পদ্মা নদীর ২০ কিলোমিটার এলাকা, বরিশালের হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জে মেঘনা নদীর প্রায় ৮২ কিলোমিটার এলাকাও এর ভেতরে পড়ে।

যে সময় ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা
দেশের ইলিশ রক্ষায় সরকার প্রতি বছর ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত দু’মাসের কর্মসূচি ঘোষণা করে।

এই নির্দিষ্ট সময়ে ইলিশের অভয়াশ্রমে মাছ ধরা, পরিবহন, বিক্রি ও মজুত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

সরকার বলছে, ওই সময়ে ইলিশ ধরা থেকে বিরত থাকার প্রধান উদ্দেশ্য মা ইলিশ রক্ষা করা, যাতে তারা নিরাপদে নদীতে ডিম ছাড়তে পারে। একটি মা ইলিশ চার থেকে পাঁচ লাখ ডিম ছাড়ে।

এই ডিম রক্ষা করতে পারলে তা নিষিক্ত হয়ে জাটকার জন্ম হবে। সেই জাটকা রক্ষা করা গেলে দেশে বড় আকারের ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।

এ সময়ে সরকার জেলেদের ইলিশ মাছ না ধরতে প্রণোদনাও দেয়। নিষেধাজ্ঞার সময় জেলেদের খাদ্য সহায়তা করা হয়।

এছাড়া নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন সময়ে অভয়াশ্রম এলাকাগুলোতে অভিযান চালায় মৎস্য বিভাগ।

কেউ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ইলিশ মাছ ধরলে মৎস্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইনে সর্বোচ্চ দু’বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উভয় দণ্ড দেয়ার বিধানও রয়েছে।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচারে ৫৩ নাগরিকের উদ্বেগ ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে দুর্নীতি কে প্রশয় দেয়া হবে না : জাতীয় নাগরিক কমিটি ফতুল্লা থেকে অপহৃত ২ শিশু বরিশাল থেকে উদ্ধার মহানবী সা:-কে নিয়ে কটূক্তি করা শিক্ষককে চাকরিচ্যুতের দাবি টাইম ম্যাগাজিনের বর্ষসেরা ব্যক্তি ট্রাম্প আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য দিবসে রিকের র‌্যালি ও মানববন্ধন অনলাইন এডিটরস অ্যালায়েন্সের সভাপতি হাসান শরীফ, সাধারণ সম্পাদক সোহেল চুয়েটে র‌্যাগিংয়ের দায়ে ১১ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার ঢাকায় উচ্চমাত্রার হর্ন ব্যবহার না করতে ডিএমপির নির্দেশনা তামিমের ঝড়ে জয় পেল চট্টগ্রাম তথ্য উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়ে ধোঁয়াশা, কর্মকর্তা প্রত্যাহার

সকল