২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`
ড. আবদুল আলীম তালুকদার

চাই সুখী সমৃদ্ধ এক মানবিক বাংলাদেশ

-

২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের জনগণের কাছে এই দিনটি অত্যন্ত গৌরবের এবং বাঙালি জাতির জন্য প্রভূত গুরুত্ব বহন করে এ দিনটি। ১৯৪৭ এ ভারতবর্ষ ভাগের পর থেকেই ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয় আমাদের। অবশেষে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে বিজয় অর্জিত হয় এবং বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই-সংগ্রাম একদিনে সংঘটিত হয়নি; বহুদিন ধরে ধীরে ধীরে এ সংগ্রাম একসময় মহীরুহ রূপ পরিগ্রহ করেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম সোপান। ইতিহাসবিদদের মতে, ভাষা আন্দোলনেই আমাদের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল। এরপর ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা প্রণয়ন ও তৎপরবর্তী আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান প্রভৃতি ঘটনার মধ্যেই স্বাধীনতার স্বপ্ন নিহিত ছিল। সর্বশেষে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। দফায় দফায় বৈঠক করার পরও ক্ষমতালিপ্সু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে কালক্ষেপণ করতে থাকে। এমতাবস্থায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। সাথে সাথে পুরো বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে এই ডাক। দেশের সর্বত্র শুরু হয় তুমুল প্রতিরোধ-আন্দোলন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর। দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চলে এই হত্যাযজ্ঞ।
স্বাধীনতা শব্দটির তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক। স্বাধীনতা মানে নতুন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আয়োজন নয়; স্বাধীনতা হলো স্বাধীন রাষ্ট্রে সার্বভৌম জাতি হিসেবে টিকে থাকার আয়োজন। স্বাধীনতা মানে ইচ্ছে প্রকাশের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, রাজনীতির স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তি তথা শৃঙ্খলমুক্ত জীবনাচারকে বোঝায়। একটি দেশের স্বাধীনতা সেদিনই সার্থক হয় যেদিন সে দেশের আপামর জনগণ প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক পরিবেশে নিজেদের নাগরিক অধিকার নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ক্ষমতা অর্জন করে। স্বাধীনতা যে কোনো জাতির পরম আকাক্সিক্ষত বিষয়, আরাধ্য ধন। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার লাভ, গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ন্যায়নীতিভিত্তিক সমাজ গঠন, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন, জানমালের নিরাপত্তা বিধান, ধর্ম পালন, নিজস্ব সংস্কৃতি-মূল্যবোধ-বিশ্বাসের অবারিত চর্চা নিশ্চিত করা ইত্যাদি সাধারণ জাতীয় আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের জন্য স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রতিটি জাতির জন্য অপরিহার্য।

অকুতোভয় বীর বাঙালিরা বুকভরা স্বপ্ন-আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে ১৯৭১ সালের রণাঙ্গনে লড়েছিল। তারা এমন একটি কল্যাণকামী স্বাধীন রাষ্ট্র চেয়েছিল যা প্রতিষ্ঠিত হবে কতিপয় আদর্শের ভিত্তির ওপর। স্বাধীনতা দিবস আবার আমাদের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে সাগরসম রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সেসব আদর্শের দিকে ফিরে তাকানোর দাবি নিয়ে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক, উদার, কল্যাণমুখী, মানবিক, প্রগতিশীল স্বতন্ত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। মানুষের মৌলিক ও মানবিক অধিকার এবং ন্যায়সঙ্গত অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে জাতীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠা, শোষণ, বৈষম্য, অন্যায়ের অবসান ঘটিয়ে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত একটি সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
আমাদের জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। এই দিনটি বাঙালির জীবনে বয়ে আনে একই সাথে আনন্দ-বেদনার অম্লমধুর অনুভূতি; এক দিকে হারানোর কষ্ট অন্য দিকে প্রাপ্তির আনন্দ। তবে শেষ পর্যন্ত সর্বস্ব হারিয়েও স্বাধীনতা প্রাপ্তির অপার আনন্দই বড় হয়ে ওঠে প্রতিটি বাঙালির কাছে। গৌরবোজ্জ্বল এই দিনটি প্রতি বছর আসে আত্মত্যাগ ও আত্মপরিচয়ের বার্তা নিয়ে। স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য। নব উদ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা ও দিকনির্দেশনা নিয়ে আসে প্রতি বছর এই দিন।
নাগরিক জীবনে স্বাধীনতার মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সর্বোচ্চ মর্যাদাদান করা উচিত সবার। স্বাধীনতার অর্জন যাতে কোনোভাবেই ম্লান না হয়, সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ রাখা উচিত প্রতিটি নাগরিকের। মহান স্বাধীনতা দিবস শুধু স্মৃতিচারণ নয়, জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা অর্থবহ, তাৎপর্যময় করে তোলার পাশাপাশি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণে অঙ্গীকার করার দিনও। স্বাধীনতা অর্জন যত কঠিন, স্বাধীনতা রক্ষা করা তার চেয়ে আরো বেশি কঠিন। চলমান বিশ্ব প্রেক্ষাপট এবং আমাদের বাস্তবতায় এ বিষয়টি নানাভাবে বিবেচিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। জাতির স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব।

দেখতে দেখতে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অতিক্রম করে ৫৩তম বর্ষে পদার্পণ করেছি। স্বাধীনতা লাভের অর্ধ-শতাব্দীরও বেশি সময় পার করলেও আজো দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত সুখী-সমৃদ্ধ শান্তিপূর্ণ ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে আমরা পারিনি। দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা প্রায় প্রতিটি শাসনামলে প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্লজ্জ দলীয়করণ ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুণ্ঠন এখনো অব্যাহত আছে যা একেবারেই থামানো যাচ্ছে না। নৈতিকতার অবক্ষয়, অসৎসঙ্গ, মোবাইল ও ইন্টারনেট আসক্তি, বেকারত্বের দুর্বিপাকে দিশেহারা হয়ে আজকের যুবসমাজ লিপ্ত হচ্ছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অথবা আসক্ত হচ্ছে মরণনেশা মাদকের দিকে। দারিদ্র্য, মূল্যবোধের অবক্ষয়, স্বজনপ্রীতি, হিংসাত্মক অপরাজনীতি, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি, ঘুষ, সীমাহীন দুর্নীতি প্রভৃতি স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লাগাম টেনে ধরে আছে। তবে বর্তমান সঙ্কট উত্তরণের জন্য যে কাজটি সর্বাগ্রে করা উচিত বলে মনে করি তা হলো শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা গ্রহণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে নৈতিক স্খলন থেকে বাঁচানোর এর থেকে ভালো বিকল্প কোনো পথ আছে বলে আমার জানা নেই। যেহেতু বিশ্বের সব ধর্মের মূলমন্ত্র হলো মানবজাতিকে খারাপ-অশ্লীল-অন্যায় কাজ থেকে বিরত রেখে ন্যায় ও মানবীয় পথে পরিচালিত করা, সে জন্য যার যার ধর্মীয় রীতি-নীতি শিক্ষা গ্রহণ ও প্রত্যেকের নিজ জীবনে তা বাস্তবায়ন ছাড়া সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনা অসম্ভব।
আমাদের বর্তমান তরুণ প্রজন্ম অত্যন্ত সচেতন ও স্বাধীনতার ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী। এই প্রজন্মকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে দেশকে এগিয়ে নেয়ার মন্ত্রে দীক্ষিত করতে হবে। এ জন্য তাদের সামনে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে তুলে ধরতে হবে। পরস্পরে কাদা ছোড়াছুড়ি পরিহার করে দল কিংবা ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জনকল্যাণমুখী রাজনীতি চর্চার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি জননী জন্মভূমিকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে নিজ স্বার্থকে বড় করে না দেখে দেশের কল্যাণে, দেশের আপামর জনগণের কল্যাণে মিলে মিশে কাজ করতে হবে; তবেই না গড়ে উঠবে ক্ষুধামুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত সুখী-সমৃদ্ধ এক মানবিক বাংলাদেশ। আজকের অধরা সেই স্বপ্নকে বুকে ধারণ করেই বীর বাঙালিরা একাত্তরে জীবন বাজি রেখে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নেমেছিলেন।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল