০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫
`


একদিন পানাম নগরে

-


একদিন খুব ভোরে দে-ছুট ভ্রমণ সঙ্ঘের বাইক রাইড গ্রুপের বন্ধুরা ছুটলাম, ইতিহাস ঐতিহ্যের নগরী সোনারগাঁও উপজেলার পানাম নগর। যাত্রাপথে যাত্রাবাড়ী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল ঘরের পাশে, সবাই আবার একত্রিত হলাম। মূলত মূল রাইড এখান থেকেই শুরু। পথে কাঁচপুর থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট বেস্ট অর্গানাইজার আরাফাত হাসান আমাদেরকে রিসিভ করে নেয়। দে-ছুট ছুটছে। মনের মাঝে এক অন্যরকম অনুভূতি। কারণ পাহাড়-পর্বত-বন-জঙ্গল-নদী-হাওর-জলাশয়-সাগর বহু দূর-দূরান্ত আর গহিন থেকে গহিনে প্রকৃতির নির্জাস নিতে ঘুরে বেড়াই। গিয়েছি দেশের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলের রাজবাড়ি, জমিদারবাড়ি ও ঐতিহাসিক প্রতœতত্ত্ব স্থাপত্য দর্শনে। কিন্তু বাড়ির পাশেই পানাম নগর, আজো দেখা হয়নি। একেই বলে বাতির নিচে অন্ধকার। তাইত দেশ দর্শনে অবিরাম ছুটে চলা। সেই সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রাবস্থা হতে ঘোরাঘুরি শুরু, কিন্তু আজো মনে হয়Ñ প্রকৃতির দান আমার এই সুন্দর বাংলাদেশের, এখনো যেন কিছুই দেখা হয়নি।
ফ্লাইওভার থেকে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাই সোনারগাঁও লোক ও কারু শিল্প জাদুঘরের সদর ফটকে। পাশেই এক রেস্তোরাঁর রান্নাঘরে, পাকানো হবে রনি আর কাইউম ভাইর সৌজন্যে খিচুড়ি আর রাজহাঁস ভুনা। অ্যান্টারমেইন্ট অর্গানাইজার ফারুকের কাছে বাজার সদাই সব বুঝিয়ে দিয়ে, গেলাম স্বল্প দূরত্বের পানাম নগরে। নগরের ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখ ছানাবড়া। অনেকটা আমাদের আদি ঢাকার মতো সরু রাস্তা। ধীরগতিতে হাঁটতে থাকি। অধিকাংশ ভবনেই ঝুঁকিপূর্ণ লেখা সাবধান বাণী। আর না লিখেই বা উপায় কী। সেই ১৫ শতকে বাংলার স্বাধীন শাসক ঈশা খাঁ সোনারগাঁতে প্রথম বাংলার রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। প্রাচীন সোনারগাঁওতে বড় নগর, খাস নগর ও পানাম নগর, এই তিনটি নগরের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল পানাম নগর। প্রায় ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছিল এই নগরী; যা এখন প্রায় বিলুপ্ত। যতটুকুন আছে তাই দেখে এই প্রজন্ম ঐতিহাসিক প্রতœতত্ত্ব স্থাপনা সম্পর্কে ধারণা নিতে পারে। ২০০৬ সালে ওয়ালর্ড মনুমেন্ট ফান্ডের তৈরি বিশ্বের ধ্বংসপ্রায় ১০০টি ঐতিহাসিক স্থাপনার তালিকায় আমাদের হারিয়ে যাওয়া পানাম নগরীও স্থান পায়। বাংলার বারো ভুঁইয়াদের মাঝে অন্যতম শাসক ঈশা খাঁর পদচারণাও ছিল এখানে। নগরীর পূর্ব দিকে রয়েছে মেঘনা নদী আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা। এই নদীপথেই পাশ্চাত্যে মসলিন রফতানি হতো। নগরের রয়েছে বিশাল ফটক। সূর্যাস্তের পরপরই ফটক লাগিয়ে দেয়া হতো; যা এখনো কোনো দর্শনার্থী সূর্যাস্তের পর ভেতরে থাকতে পারে না। পানাম নগরের দৃষ্টিনন্দন কারুকার্যময় বাড়িগুলোর অধিকাংশই এক ও দ্বিতল বিশিষ্ট। পানামে ছিল হিন্দু ধনী ব্যবসায়ীদের বসতি। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য কলকাতা পর্যন্ত বিসৃত ছিল। মূলত তারাই গড়ে তুলে ছিল এই পানাম নগরী। বর্তমানে টিকে থাকা বাড়ির সংখ্যা ৫২ টি। প্রতিটি বাড়ির নকশাই আকর্ষণীয় স্থাপত্যের প্রাচীন নিদর্শন। নগরের ভেতরে রয়েছে পাঁচটি পুকুরসহ, প্রতিটি বাড়িতেই সুপেয় পানির জন্য ছিল কূপ। পানাম নগরে মসজিদ, মন্দির, বিচারঘর, নাচঘরসহ ইত্যাদি রয়েছে প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো টাকশাল বাড়ি। রয়েছে আরো অনেক সমৃদ্ধ ইতিহাস। কিন্তু যা না লিখলেই নয়, পারস্যের খ্যাতিমান কবি হাফিজকে পানাম নগর বেড়ানোর আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তৎকালীন বাংলার সুলতান গিয়াসুদ্দিন আযম শাহ। কিন্তু বৃদ্ধ কবি আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েও আসতে না পারার কারণে, গজল রচনা করে উপহার পাঠান সুলতানকে। সেই গজলের সূত্র ধরেই ফর্সি এক পর্যটক আসেন সোনারগাঁওতে। আর তিনি পানাম নগরের সৌন্দর্য দেখে বেশ মুগ্ধ হন। যে মুগ্ধতার রেশ এখনো কাটেনি।এই প্রজন্মের দেশ-বিদেশের পর্যটকরাও বেশ পানাম নগরের প্রতি বেশ আকর্ষণ বোধ করেন। এবার আমরা শওকত আজমের তথ্যমতে ছুটি গোয়ালদী। অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে যাই গোয়ালদী গায়েবি মসজিদ। সোনারগাঁওতে অবস্থিত এটি একটি অন্যতম প্রাচীন মসজিদ। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে মোল্লা হিজবর খান ১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিটির ভেতরে-বাইরের দেয়ালে রয়েছে চমৎকার দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য। ১৯৭৫ সালে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের কিছু অংশ সংস্কার করে। এবং তখন হতেই প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর প্রাক-মোগল যুগের ঐতিহাসিক প্রাচীন নিদর্শন গোয়ালদী মসজিদটির দেখভাল করে আসছেন। এরপর সোনারগাঁওর জনপ্রিয় ভোকাল সাহেদ আহম্মেদ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাই লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে। সেই গল্প আজ থাক, তুলে রাখলাম আগামী কোনো এক সংখ্যার জন্য।

যেভাবে যাবেন : ঢাকার গুলিস্তান থেকে নারায়ণগঞ্জ জেলার মোগড়াপাড়া পথে চলাচলকারী দোয়েল, স্বদেশ বা বোরাক পরিবহনে মোগড়াপাড়া চৌরাস্তায় নামতে হবে। সেখান থেকে অটো কিংবা রিকশায় পানাম নগর।

প্রবেশ ফি : জনপ্রতি ২০ টাকা। সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

ছবি : দে-ছুট ভ্রমণ সঙ্ঘ

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল