০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


রমাদানের প্রস্তুতি : এবারের রমাদান হোক টার্নিং পয়েন্ট

রমাদানের প্রস্তুতি : এবারের রমাদান হোক টার্নিং পয়েন্ট - ছবি : সংগ্রহ

যেকোনো সফলতার জন্য আমরা সব সময় লোকজনকে কিছু উপদেশ দিয়ে থাকি বা উপদেশ নিয়ে থাকি। হোক সেটা ধর্মীয় কিংবা অন্য কোন পথের প্রচেষ্টা, উপদেশগুলো প্রায় একই থাকে। এরকম একটা উপদেশ হলো আগেভাগে প্রস্তুতি গ্রহণ করা।

মুসাফির তার যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়, কৃষক জমিতে ফসল ফলানোর জন্য প্রস্তুত হয়। ছাত্র ছাত্রীরা তাদের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আমরা যারা চাকরিজীবী আছি বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল কোর্স করে থাকি প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য অর্থাৎ কোনো কাজ সফল হওয়ার জন্য ভালো প্রস্তুতির কোন বিকল্প নেই।

রমাদান মাস, রমাদান কারিম আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। এইতো অল্প কিছুদিন পরেই রামাদান মাস। রমজান মাসকে ঘিরেই আমাদের প্রস্তুতির কোন ব্যতিক্রম হবে না।

 রমাদান মাসকে ঘিরে আল্লাহ সুবাহানাহুওয়া তা'আলার প্রস্তুতি :

 আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের জন্য রমজান মাসকে প্রস্তুত করেন। ইসলামের এই মাসটিকে এত বেশি পুরস্কার আর সুযোগ দিয়ে ভরে রেখেছেন যে আর কোন মাসকে তেমনটা রাখেননি।

 এক কথায় বলতে গেলে মুসলমানদের জন্য রমাদান মাস হচ্ছে ইবাদতের জন্য বসন্তকাল। আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা'য়ালা রামাদান মাসকে করেছেন সামান্য কয়েক দিনের জন্য আল্লাহ সুবহানাতায়ালা সূরা বাকারায় বলেন" مَّعۡدُوۡدٰتٍؕ اَيَّامًا ‘সীমিত কয়েকটা দিন মাত্র’। এটা হলো আল্লাহ সুবাহানাহুওয়া তা'আলার পক্ষ থেকে আমাদেরকে উপর অসীম অপার অনুগ্রহ। মাত্র কয়েকটি লিমিটেড দিন আমরা যদি সিয়াম কিয়াম পালন করি তাহলে আমাদের জন্য রয়েছে আনলিমিটেড পুরস্কার।

হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, বান্দার সকল ভাল আমলের প্রতিদান ১০ থেকে ৭০০ গুণ কিন্তু রোজা কেবল আমার জন্য এবং আমি নিজে এর প্রতিদান দিব। অর্থাৎ রমাদানের প্রতিদানের হিসাব কোন স্বাভাবিকের গণিতের হিসাব নিকাশে হবে না, এর প্রতিদান হবে অফুরন্ত, ইনশাআল্লাহ্‌।

 মানুষের সবচেয়ে ভয়ংকর শত্রু শয়তান এ সময়ে শিকলবন্দী থাকে। যাতে করে বছরের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এই সময়টাকে ইবাদতের জন্য ঈমানদারদের অন্তর সহজ হয় হালকা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 'যখন রামাদানের প্রথম রাত্রি আসে তখন শয়তান এবং বিদ্রোহী জিনদেরকে শিকলবন্দি করে ফেলা হয় আর জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়।' হাদিসটি বুখারি, মুসলিম ও তিরমিজি শরিফে এসেছে।

 রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম বলেন, 'আল্লাহ সুবাহানাতালা এ মাসের প্রতি রাতে অনেক লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন।' তিরমিজি শরিফের হাদিস।

 আল্লাহ সুবহানাতায়ালা এই মাসে এমন একটা রাত রেখেছেন যে রাত আল্লাহর দাসত্বে কাটিয়ে দেয়া হাজার মাস আল্লাহর দাসত্ব করার চেয়েও বেশি। ওই রাতটাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে হাজারটা মাসের চেয়ে বেশি পুরস্কারের হাতছানি। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন রমাদানে এমন একটি রাত রয়েছে যে রাত হাজার মাসের চেয়ে উত্তম এবং যে এই রাতের ফজিলত থেকে বঞ্চিত হলো সেই জন্য সবকিছু থেকেই বঞ্চিত হলো।

 কুরআনুল কারীমে আল্লাহ সুবাহানাতালা বলেন, 'লাইলাতুল কদরি খাইরুম মিন আল ফি শাহর।'

 দুনিয়াদার লোকেরাও রমাদানের প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন :

 এদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে ফ্রিজের ভেতর খাওয়ার স্তুপ করে রাখার মধ্যে। যেন তারা 'মান্থ অফ ফাস্টিং' সাওমের মাস পালনের পরিবর্তে 'মান্থ অফ ফিস্টিং' ভোজনের মাস উদযাপন করতে যাচ্ছে।

 এছাড়া আমাদের অতিরিক্ত চাহিদা আমাদের স্ত্রীদের সময় নষ্ট করে ফেলে বেশিভাগ ক্ষেত্রেই তারা অন্তহীন সময় ধরে নানা ধরনের খাবার দাবার তৈরিতে তাদের সময় ব্যয় করেন, যখন তাদের উচিত ছিল প্রভুর ইবাদতে বেশি সময় ব্যয় করা। খেয়াল করে দেখব আমরা রমাদানে আমরা কিভাবে খানাপিনা করি।

 আল্লাহ সুবহানাতায়ালা আমাদের সবাইকে খুব ভালো করে জানেন। আমাদের মনের অবস্থা খুব ভালো করে জানেন। রমাদানে এমন কিছু মানুষ সিয়াম পালন করে যাদের সিয়াম পালনের একমাত্র কারণ হলো তাদের আশেপাশের লোকজনের সিয়াম পালন করা। তারা অধীর হয়ে অপেক্ষা করে যে কখন রমাদান মাস শেষ হবে। এ ধরনের লোকেরা এই ভয় করে না যে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাদেরকে বলবেন, 'তোমার উপবাস থাকার কোন দরকার আমার নেই, তুমি আমার এবাদতকে ঘৃণা করতে তাই আজকের দিনে তোমার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।'

 দুনিয়াতে লোকেরা এমন সব লোক তারা এমন সব মসজিদ খুঁজে নেয় যেগুলোতে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে তারাবীর সালাত আদায় করা হয়। আমি বলছি না যে, সংক্ষিপ্ত আকারে তারাবির সালাত আদায় করলে তারাবীর সালাত আদায় হবে না। তবে রাসুল সা. সংক্ষিপ্ত আকারে রাতের সালাত আদায় করতে নিরুৎসাহিত করেছেন। রাসুল সা. বলেন, 'রাতের বেলা নামাজে দ্বাড়িয়ে সালাত আদায়কালীন কমপক্ষে ১০ আয়াত পাঠ করলে তাকে গাফেল গণ্য করা হবে না, আর ১০০ আয়াত পাঠ করলে তাকে আল্লাহ্‌ সুব হানাহু ওয়া তায়ালা বিশেষ পুরস্কার এ ভূষিত করবেন।' তাই সংক্ষিপ্ত আকারে নামাজ আদায় করতে রাসুল সা. নিরুৎসাহিত করেছেন।

 ঈমানদার লোকেরাও রমাদানের প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন:

 ঈমান্দারদের রমাদানের প্রস্তুতি একবারে আলাদা। তাদের প্রস্তুতি হয় দুনিয়াদার লোকদের থেকে সম্পুর্ন আলাদা। তারা রমাদান মাসের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। তারা আগে থেকেই নিখুত নিয়ত নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যায়। রমাদানের প্রতিটি দিনেই তারা সতেজ হয়ে উঠে। রমাদানে এমন এমন সুযোগ থাকে যার মাধ্যমে নিজের গুনাহের বোঝা সম্পুর্ন শুন্য হয়ে যায়। কিন্তু এর জন্য অত্যন্ত গুরত্বপুর্ন শর্ত থাকে, যেটা তিনটি বর্ননায় পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে।

 প্রথম সুযোগের ক্ষেত্রে রাসুল সা. বলেন, 'যে ব্যক্তি রমাদানের পুরো মাসে ঈমান নিয়ে ও পুরস্কারের আশায় সিয়াম পালন করবে তার পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।'

 দ্বিতীয় সুযোগের ক্ষেত্রে রাসুল সা. বলেন, 'যে ব্যক্তি রমাদানের রাতে ঈমান নিয়ে ও পুরস্কারের আশায় সালাত আদায় করবে তার পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।'

 তৃতীয় সুযোগের ক্ষেত্রে রাসুল সা. বলেন, 'যে ব্যক্তি লাইলাতুল ক্বদরে ঈমান নিয়ে ও পুরস্কারের আশায় সালাত আদায় করবে তাঁর পুর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।'

 তিনটি সুযোগই নিয়তের সাথে সম্পর্কিত। তাই আমাদেরকে নিয়তকে প্রাধান্য দিয়ে উপরের আমল করতে হবে।

 আখিরাতপ্রেমী যারা তারা রমাদান আসার আগেই কুরানের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে। একই সাথে রমাদান আসার আগেই তারা শুরু করে সিয়াম আর রাতের ইবাদত। অনেকেই দেখা যায়, রমাদানের প্রথম কয়েক দিনে খুব উৎসাহ উদ্দীপনা থাকে, কিন্তু এক সপ্তাহ পরেই দেখা যায় উদ্দীপনার জোয়ারে ভাটা পড়তে থাকে। বেশিভাগ সময় এটা হয় সঠিক প্রস্তুতি না থাকার কারণে।


 কিভাবে প্রস্তুতি নেব?

 রমাদান আসার আগেই আমরা আমাদের প্রত্যেকটি গুনাহের মূল্যায়ন করবো এবং সেগুলোর প্রতি মনোযোগ দেব। আমরা আল্লাহর কাছে সে সমস্ত গুনাহের জন্য তওবা করে নেব। সবকিছুই আমরা রমাদান আসার আগেই সেট করে নেব রামাদানের প্রস্তুতি হিসেবে। আমরা সেসব লোকদের মতো আল্লাহর সাথে তামাশায় লিপ্ত হব না যারা বলে রমাদান আসার আগে যত পারি গুনাহ করে নেই, রমাদান মাস আসলে তখন সবকিছু ছেড়ে দিয়ে ভালো হয়ে যাব। এটা আমরা কখনোই করব না। আমরা রমাদান আসার আগেই আমাদের সমস্ত গুনাহগুলোকে মূল্যায়ন করব এবং সেগুলো থেকে আল্লাহর কাছে তওবা করে নেব, ইনশাআল্লাহ্‌।

 রমাদানের জন্য প্রস্তুত হতে আমরা একটু সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে নিব। রমাদানে আমরা অনেক সময় নিজেদের সামর্থের বাইরে পরিকল্পনা নিয়ে থাকি। একথা ঠিক যে ইবাদতের ব্যাপারে উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করা খারাপ কিছু না বরং আমলের উত্তরোত্তর উন্নতির জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণের পাশাপাশি চেষ্টা করতে হবে। তবে আমাদের নিজেদের সামর্থের ব্যাপারে বাস্তব সম্মত ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি। এমন কোন পরিকল্পনা নেয়া উচিত নয় যা আমাদের মানসিক চাপ সৃষ্টি করবে। অবাস্তব লক্ষ্য নির্ধারণের পর যদি লক্ষ্য পূরণের সামান্য পরিমাণও ঘাটতি সৃষ্টি হয় তবে আশাহত হয়ে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। তখন মাঝপথে পরিকল্পনা নেয়ার বদলে মনে হবে এবার আর হবে না, থাক দেখা যাবে পরের বছর রমজানে।

 প্রস্তুতির প্রথমে আসে ফরজ নামাজের কথা, ফরজ ইবাদতের কথা। দিনে পাঁচ বার অবশ্যই ফরজ নামাজে শরিক হবো আমরা জামাতের সহিত, এটি অত্যাবশ্যক। মিস দেয়ার প্রশ্নই আসে না। আমরা যদি ফরজ নামাজে নিয়মিত না হয়ে থাকি তাহলে এখনই সময় সে অভ্যাস গড়ে তোলার।

 রমজানের আদর্শ রুটিন কেমন হতে পারে তার একটি সিডিউল নিয়ে আমি একটু কথা বলতে চাই :

 প্রথমে আসি সাহরি। আমরা সাহরির জন্য উঠবো। যদি এ সময় খেতে আপনার ভালো না লাগে তাও উঠতে হবে। অল্প কিছু হলেও খেয়ে নিতে হবে, যাতে প্রতি রাতে সাহরীর সুন্নাহ পালন করার প্রতিদান আমরা পেয়ে থাকি। কেননা সাহরির মধ্যে রয়েছে বারাকাহ। (বুখারি শরিফ)

 এ সময় আমরা চেষ্টা করব দু'রাকাত, চার রাকাত বা ছয় রাকাত নফল নামাজ আদায় করার। যাতে রাতের শ্রেষ্ঠ অংশে মানে তিন ভাগের শেষ ভাগে আমরা সালাত আদায়ের আর দোয়া করার সওয়াব অর্জন করতে পারব। নিজের গুনাহর দিকে লক্ষ্য রেখে এই সময়টাকে ব্যবহার করব এবং এরপর ইস্তেগফার করতে থাকবো। যারা রাতের এই সময়টাতে ইবাদতে রতে থাকে আল্লাহ স্বয়ং তাদের প্রশংসা করেন। রাতের শেষ অংশে আল্লাহ্‌ মানুষের কাছে আসে আর বান্দা যখন সিজদা করে তখন বান্দা আল্লাহর কাছে চলে যায়। তাই রাতের শেষ অংশে সিজদা করলে বান্দা আল্লাহর সবচেয়ে নিকটে থাকে। এটা একটা পরম সৌভাগ্যের বিষয়।

 আমরা এই জিনিসটা অন্তত নিশ্চিত করবো যে কমপক্ষে ফজর আর ইশার সালাত আমরা মসজিদে জামাতের সাথে আদায় করব। বেশিভাগ মানুষের কাজের সময়ের সাথে এই দুই ওয়াক্তের কোন ঠোকাঠুকি যেহেতু লাগেনা তাই এই দুই ওয়াক্তে জামাতে সালাত আদায় করা সহজ। যদি এটা আমরা করতে পারি তাহলে আমাদেরকে পুরো রাত সালাতে দাঁড়িয়ে থাকার সওয়াব দান করা হবে।

 ফজরের নামাজের পরে আমরা অবশ্যই কোরআন তেলাওয়াত করব। রমাদানে আমরা প্রায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পরে কোরআন তেলাওয়াতের চেষ্টা করব, তবে বিশেষ করে ফজরের কোরআন তেলাওয়াতের কথা আল্লাহ সুবাহানাতালা কোরআনে বর্ণনা করেন 'আক্বিমিস স্বলাতা লি-দুলুকিশ শামছি ইলা গছাকিল্লাইলি ওয়া কুরআনাল ফাজরি, ইন্না কুরআনাল ফাজরি কানা মাশহুদা।' সুরা ইসরা

 প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার হজ আর উমরাহ আদায় করা। না আমি আসলে সপ্তাহে সপ্তাহে হাজ্ব আর উমরা করার কথা বলছি না। আমি বলছি নিচের হাদিসের কথা। হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম বলেছেন, 'যে ব্যক্তি জামাতের সাথে ফজরের সালাত আদায় করবে তারপর সূর্য ওঠা পর্যন্ত বসে বসে আল্লাহর জিকির করবে তারপর উঠে দুই রাকাত সালাত আদায় করবে তার জন্য একটা হজ্ব আর একটা ওমরার সওয়াব দান করা হবে।'

 তারপর আমরা বের হয়ে পড়ি আমাদের অফিস আদালত বা যে যে কাজ করি সে কাজের জন্য। ঘরে ফিরে এসে একটু বিশ্রাম নেবার পর আমরা কিছুক্ষণ আল্লাহর মহিমান্বিত কোরআন তেলাওয়াত এবং এর অর্থ নিয়ে পড়াশোনায় নিজেকে নিয়োজিত করবো ইনশাআল্লাহ। ইফতারের আগে আধা ঘন্টা কাটাবো একটু দোয়ার মাধ্যমে। কেননা পুরো রমজানে রোজাদার দোয়া কবুল হয়ে থাকে বিশেষ করে ইফতারের সময়। হযরত মুসা আ.-এর সময় একবার তিনি ইফতারের কিছু আগ মুহুর্তে এক রোজাদার ব্যক্তির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ওই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে দোয়া করছিলেন, 'হে আল্লাহ্‌, এখন আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় হল এই ইফতার সামগ্রী। আমি তোমার জন্য রোজা রেখেছি এবং তুমি যদি চাও এই ইফতারগুলো আমি তোমাকে দিয়ে দিব। মুসা আ. তার এই দোয়া শুনে খুব রাগ করলেন। তখন আল্লাহ্‌ মুসা আ.-কে মেসেজ পাঠালেন হে মুসা আমার বান্দা আমার জন্য রোজা রেখেছে। এখন এই ইফতারের সময় আমার বান্দা যা বলবে তা আমার বান্দা এবং আমার মাঝেই সীমাবদ্ধ।' তাই ইফতারের সময় আমরা দোয়া করতে ভুলবনা।

 একদিনও যাতে তারাবির সালাত মিস না হয় সেটা নিশ্চিত করব ইনশাআল্লাহ। সেই মসজিদটি আমরা বেছে নেব যেখানকার তেলাওয়াত আমার অন্তরকে সবচেয়ে বেশি স্পর্শ করে।

 রমাদান কোরআনের মাস। এই কুরআনের মাসে আমরা নিয়ত করব চেষ্টা করব নতুন নতুন কিছু আয়াত, নতুন নতুন কিছু সূরা মুখস্ত করার। এবং এই কুরআন মুখস্তের জন্য আমাদেরকে বাস্তবসম্মত টার্গেট নিতে হবে। এ মাসে কোরআন নাজিল হয়েছে। এই মাসে কুরআনের সাথে আমাদের সম্পর্কের উন্নতি না হলে মাস শেষে এটা আমাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলবে। তাই বাস্তবতার সাথে মিল রেখে প্ল্যান করতে হবে। কিন্তু আল্লাহর দানশীলতা আর সাহায্যকে ভুলে যাব না। খুব বেশি আবেগে হওয়া যাবে না আবার একেবারেও আশা ছেড়ে দেয়া যাবে না। তিলাওয়াত আর হিফজ দুটির জন্যই বাস্তবসম্মত একটা টার্গেট সেট করব আমরা ইনশাআল্লাহ।

 মৃত্যু শয্যায় শায়িত একজন আল্লাহর বান্দার একটি কথা আমাকে ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছে ।সে আল্লাহর বান্দা তার সন্তানকে ডেকে বললেন যে, আমার মৃত্যুর পরে আমাকে সবাই ভুলে যাবে। আমার আত্মীয়-স্বজন যারা আছে বন্ধু-বান্ধব কিছুদিন শোক পালন করে সবাই আমাকে ভুলে যাবে, কিন্তু বাবা তুমি আমাকে ভুলে যেও না। তোমার প্রতিদিনের সালাতের দোয়ায় আমাকে শরিক রেখো। আমরা আমাদের দোয়ায় আমাদের বাবা মাকে স্মরণ করব বাবা-মার জন্য দাদা-দাদি, নানা-নানির জন্য আমরা দোয়া করব। মা-বাবার জন্য দোয়া করতে পারা এটাও একটি সৌভাগ্য বিষয়। আপনি দেখবেন আপনি যদি আপনার বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করেন আপনার অন্তরের ভিতর একটা প্রশান্তি অনুভব করবেন, ইনশাআল্লাহ।

 আল্লাহ তাআলা কে খুশি করার জন্য নিজের আরাম আয়েশকে বিসর্জন দিয়ে রাতের বেলা সালাতে দাঁড়ানো এমন একটা আমল যা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত এখলাসপূর্ণ এবং সেইসাথে অনেক বেশি আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ একটা কাজ। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু সাল্লাম বলেন, 'যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং আল্লাহর কাছে পুরস্কারের আশায় সালাত আদায় করবে আল্লাহ তাআলা তার সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।' আবু দাউদ শরিফের একটি হাদিস রাসুল সা. বলেন যদি কেউ রাতের বেলায় সালাতে দাঁড়িয়ে দশ আয়াত তেলাওয়াত করে তাহলে তাকে গাফিলদের মধ্যে গণ্য করা হবে না আর যদি কেউ রাতের সালাতে দাঁড়িয়ে একসময় তেলাওয়াত করে তবে তাকে আল্লাহর বাধ্যগত বান্দাদের একজন ধরে নেয়া হবে।

 রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম রমাদানের মধ্যভাগে বের হয়ে মসজিদে গিয়ে তারাবির সালাত আদায় করেন তার সঙ্গে সাহাবিরাও সালাত আদায় করেন। পরদিন সকালে তারা এ নিয়ে অন্যদের সাথে আলাপ আলোচনা করেন। পরের রাতে আগের চেয়ে অধিক সাহাবী একত্র হন এবং নবিজীর সাথে সালাত আদায় করেন। ফলে তৃতীয় রাতে মসজিদে লোকের সমাগম অত্যাধিক বেড়ে যায় আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাম এর সঙ্গে সালাত আদায় করেন। পরের রাতে লক সমাগম আরও বেড়ে যায়, কিন্তু ওই দিন রাসুল সা. রাতের সালাতে আসেনি। তারপর ফজর সালাতে মসজিদে আসেন, ফজর নামাজ পরেন এরপর কালিমাতুশ শাহাদাহ পাঠ করে বলেন এখানে তোমাদের উপস্থিতির বিষয়টি আমার অজানা ছিল না কিন্তু আমার আশঙ্কা ছিল তোমাদের জন্য তা ফরজ করে দেয়া হলে তোমরা তা আদায় করতে অপারগ হয়ে পড়বে। (বুখারি শরিফের হাদিস)।

 একাধিক হাদিস গ্রন্থে আবুজর রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন নবীজির সাথে আমরা সিয়াম পালন করছি তিনি আমাদের নিয়ে রামাদানের মাসে কোনো নফল সালাত আদায় করেননি। অবশেষে রমাদানের সাত দিন বাকি থাকতে তিনি আমাদের নিয়ে সালাতে দাঁড়ান। এতে রাতের এক তৃতীয়াংশ চলে যায়। আমাদের নিয়ে তিনি রমজানের শেষ দিকে ষষ্ঠ রাতে সালাতে দাঁড়াননি। তবে পঞ্চম রাতে সালাতে দাঁড়ান। এতে রাতের অর্ধেক চলে যায়। আমরা তাকে বলি হে আল্লাহর রাসূল যদি বাকি রাতও সালাতে কাটিয়ে দিতেন! রাসুল সা. বলেন, ইমামের সাথে যদি কেউ সালাতে শামিল হয় এবং ইমামের সাথে সালাত শেষ করে তাহলে সে সারারাত সালাত আদায়ের সওয়াব পাবে।

 রমাদানের শেষ দশক : শেষ মুহূর্তে জেনে থাকি প্রোডাক্টিভিটির চূড়ায়

 কখনো কি দৌড় প্রতিযোগিতা দেখেছেন? শেষ মুহূর্তে দেখবেন সবাই গতি বাড়িয়ে দেয়। আবার পরীক্ষার হলেও দেখবেন শেষ আধা ঘণ্টা সময় সাধারণত কেউ কারো দিকে তাকায় না। সবাই যত বেশি সম্ভব উত্তর খাতায় লিখতেই মনোনিবেশ করে। কিন্তু যে সম্পূর্ণ রেসে পেছনে ছিল সে সাধারণত শেষ মুহূর্তের গতি বাড়িয়ে ও প্রথম হতে পারে না।

রমজান মাসের ব্যপার ও অনুরূপ। আপনি যদি সমগ্র মাস জুড়ে প্রোডাক্টিভ থাকতে না পারেন তবে শেষ অংশে এসে হঠাৎ করে আপনি আমলের গতি বাড়িয়ে দিতে পারবেন না। এখানে অভ্যস্ত হওয়ার একটা ব্যাপার আছে, মনোযোগ ধরে রাখার একটা ব্যাপার আছে। তাই রমাদানের শেষ দশকে আরো বেশি প্রোডাক্টিভ আমল করার জন্য সমগ্র রামাদান মাস জুড়ে ভালো আমল করতে হবে। আর রমাদান মাস জুড়ে আমলের সর্বোচ্চ স্তরে থাকতে হলে আগেভাগে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করতে হবে। কিন্তু তাই বলে কি রমাদানের শেষভাগে আমার গতি বাড়িয়ে দেব না, অবশ্যই দেব। লাইলাতুল কদর নামের হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম রাত্রি সামনে যেহেতু আছে তাই এখনই আসা হারানোর কিছু নেই তাই রমজানের শেষ দশকে আটঘাট বেঁধে আমলে নেমে পড়তে হবে। আগের ১০ দিনের সব ঘাটতি উঠিয়ে দিন এই শেষ দশ দিনের আমলে। আপনার সম্পূর্ণ রমাদান মাসের আমলের সবচেয়ে বড় একটি সময় তা যেন কাটে এই শেষ ১০ দিনে।

 ইতিকাফ কেন জরুরি

 নবী রাসূলরা ও আগের নবীদের উম্মতেরাও ইতিকাফ করতেন
 আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা. প্রত্যেক রমাদান মাসে ইতেকাফ করতেন
 নবীজিকে অনুসরণ করে সাহাবিরাও ইতিকাফ করতেন
 হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম রাত্রি লাইলাতুল কদর পাওয়ার সুযোগ রয়েছে
 সম্পূর্ণ ইতিকাফের সময় নেক আমল হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়
 ফেরেশতারা ইতিকাফকারীর জন্য দোয়া করতে থাকেন
 মসজিদের সাথে সম্পর্ক তৈরি হয়
 লাইলাতুল কদর মিস হওয়ার কোনো সুযোগ নেই
 তাহাজ্জুদ ও নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াতে অভ্যস্ত হওয়া যায়।
 সময়কে খুব প্রোডাক্টিভ ভাবে কাজে লাগানো যায়
 অন্তর নরম ও প্রশান্ত হয়
 গুনাহের কাছ থেকে দূরে থাকা যায়
 নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ট্রেনিং হয়।

 যারা ইতিকাফ করব না তারা কিভাবে রামাদানের শেষ দশকে প্রোডাক্টিভ আমল করব

 খুব প্রয়োজন ছাড়া এই দশ দিন সোশ্যাল মিডিয়া একদম বাদ দিয়ে দিব
 দুনিয়াবি কাজ কমিয়ে ফেলতে হবে
 সময় পেলে আমল করতে হবে
 পারলে নফল ইবাদতের, নফল ইতিকাফের নিয়ত করে মসজিদে চলে যেতে হবে যতক্ষণ থাকলেন নফল ইতিকাফের নেকি হলো

 রাত্রিগুলো যত বেশি সম্ভব মসজিদ থাকার চেষ্টা করব, তার সম্ভব না হলেও নিজের কক্ষে নির্জনে বসে ইবাদত করব
 গরিব রোজাদারদের ইফতারের ব্যবস্থা করতে পারেন।
 দান, সাদাকা করুন। নবীজি সাল্লাল্লাহু সাল্লাম রামাদানে প্রবাহিত বাতাসের মতো দান করতেন।

 নিচের দোয়াটি বেশি বেশি পড়ার চেষ্টা করব :

আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফু’উন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’আফু আন্নি।
হে আল্লাহ্‌ তুমি ক্ষমাকারী আর ক্ষমা করাকে তুমি পছন্দ করো অতএব তুমি আমাকে মাফ করে দাও।

আর আমরাও মানুষকে ক্ষমা করে দেব। কারণ আমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইব আর অপর মানুষের জন্য নিজের অন্তরে ক্ষোভ রেখে দিব তা হতে পারে না। আমরা অপরকে ক্ষমা করে দিব যেমন আমরা চাই আল্লাহ্‌ আমাদেরকে ক্ষমা করে দিক।

সবশেষে বলতে চাই এবারের রমাদান হোক আমাদের জীবনের টার্নিং পয়েন্ট, আমাদের জীবনের সবচেয়ে সেরা রমাদান, সবচেয়ে প্রডাক্টিভ রমাদান। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদেরকে তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক : ব্যাংকার, গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ


আরো সংবাদ



premium cement