২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মাহফিলগুলো আওয়াজের নয় ওয়াজের হোক

মাহফিলগুলো আওয়াজের নয় ওয়াজের হোক - ছবি : সংগৃহীত

ওয়াজ-নসীহত নিঃসন্দেহে দাওয়াতের একটি বিরাট অঙ্গন। দ্বীন প্রচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারিমে উত্তম নসীহতের মাধ্যমে দাওয়াতের নির্দেশ দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও সমাবেশে ওয়াজ-নসীহত করেছেন। ওয়াজ নসীহতের এ ধারা যুগযুগ ধরে চলে আসছে।

বলা যায়, ওয়াজ-মাহফিল মুসলিম সমাজের ঐতিহ্য। ইসলামের শিআর। একদিকে যেমন রয়েছে এর ঐতিহাসিক প্রামাণ্যতা, আরেকদিকে রয়েছে এর অনেক সুখকর প্রভাব। এই ওয়াজের প্রভাবে কত পাষাণ অন্তর বিগলিত হয়েছে; স্নিগ্ধ হয়েছে হিদায়েতের আলোয়! এর সঠিক সংখ্যা কোনো ঐতিহাসিক বলতে পারবে না।

দুঃখের বিষয়, বর্তমানে এ সকল ওয়াজ মাহফিল ফেতনার কেন্দ্র, অর্থ উপার্জনের পেশা এবং প্রচলিত বিনোদনের অন্যতম রঙ্গমঞ্চে পরিণত হয়েছে। নানা ধরনের মানুষ এ সকল মঞ্চে এসে নিজেদের অভিনয় দক্ষতা-সূর দক্ষতা প্রদর্শন করে সেলিব্রিটিজম অর্জন ও মোটা অংকের অর্থ কামানোর লালসাকে চরিতার্থ করতে গিয়ে দাওয়াতের এই গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমটিকে কলুষিত করছেন। ভাসাভাসা জ্ঞান আর নিজেদের ইলমী দীনতার কারণে সমাজের মাঝে নতুন নতুন ফেতনা এবং প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছেন।

আজকের এ অবস্থার জন্য হকপন্থী মুহাক্কিক ওলামায়ে কেরামও অনেকাংশে দায়ী। তারা এ অঙ্গনে অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকানোর কিংবা চিহ্নিত করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। ইলম ও দাওয়াতি অঙ্গনকে কলুষমুক্ত রাখার জন্য যুগযুগ ধরে চলে আসা ‘জারাহ ও তাদীল’ এর পদ্ধতি গ্রহণ করেননি। একজন ওয়ায়েজ বা বক্তার আলোচনার পরিধি কতটুকু সেটা বক্তাদের সামনে পরিষ্কার না। লা-ইলমীর ও জ্ঞান স্বল্পতার কারণে বক্তা নিজেও জানেন না, আবার তাকে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আকারে জানিয়েও দেয়া হয়নি।

রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে যুক্ত ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে বলার পরিধি লিমিটেড। এগুলোর ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন সাধারণত কেউ করে না। করলেও এর পাহারাদারী করার জন্য রাষ্ট্রীয় আইন এবং প্রশাসনের লোকেরা তৎপর আছে। কিন্তু ইসলামের মৌলবিশ্বাস, গুরত্বপূর্ণ ব্যক্তি, স্বীকৃত ফতোয়া ও প্রতিষ্ঠিত বিধিবিধানের বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে এদের কোনো লিমিটেশন নেই। এগুলোর পাহারাদারি করারও কেউ নেই। ফলে এরা যাচ্ছেতাই করে বেড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনধিকার চর্চা করছে।

ওলামায়ে কেরাম যেটি করেন, তা হলো, অযোগ্য ও ফেতনা সৃষ্টিকারীরা অবাধে এ অঙ্গনে অনুপ্রবেশের পর যখন ফেতনার রণাঙ্গন তৈরি করে ফেলে, তখন তাদের ঘুম ভাঙে। অথচ এতক্ষণে জল অনেকদূর গড়িয়েছে।

রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট না করে কেউ নিজেকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার দাবি করতে পারেন না। এ অঙ্গনে পদচারণা তো দূরের কথা! একটা সিনেমা পর্যন্ত পাবলিকলি প্রদর্শিত হওয়ার জন্য সেন্সর বোর্ডের অনুমতি লাগে। সেন্সর বোর্ড সার্টিফিকেট দিলেই সেটি পাবলিকের সামনে প্রদর্শিত হতে পারে।

অথচ দীনি বিষয়ে স্কলার সেজে যাওয়ার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষের কোনোরকমের সার্টিফিকেটেরই প্রয়োজন পড়ে না। মুর্খ, অর্ধশিক্ষিত, জেনারেল শিক্ষিত, অকৃতকার্য, অভিনেতা, গলাবাজ, ফাঁপরবাজ, ছাব্বিশ ইঞ্চি বক্তা, শিশুবক্তা, নারীবক্তা, নারী থেকে পুরুষ হওয়া (!) বক্তা, কমেডিয়ান, অশুদ্ধ তেলাওয়াতের অধিকারী, অক্ষরজ্ঞানহীন, কূপমণ্ডূক সবাই এ অঙ্গনে অনায়াসে প্রবেশ করতে পারে।

সম্ভবত শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ: বলেছেন,

نصف الطبيب يفسد الأبدان و نصف العالم يفسد الأديان

‘হাতুড়ে ডাক্তার যেমন ভুল চিকিৎসা করে কারো জীবন বরবাদ করে দিতে পারে, তেমনি হাতুড়ে আলেম দ্বীনি বিভিন্ন বিষয়ের ভুল ব্যাখ্যা করে দ্বীনের বারোটা বাজিয়ে দিতে পারেন।’

মনে রাখতে হবে, এ সকল ওয়াজ মাহফিল ফলপ্রসূ তখনই হবে যখন এগুলোর আয়োজন হবে রাসূলের সুন্নাহ অনুসারে। কেননা,

الفضل كله منحصر في اتباع النبي صلى الله عليه
وسلم وان لم يكن ذلك في صورة العبادة لا في الابتداع و اتباع الهوى و إن كان ذلك طاعة و عبادة ظاهرا.

‘নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণের মাঝেই সকল কল্যাণ নিহিত; বাহ্যত সেটি ইবাদত মনে না হলেও। নিজস্ব উদ্ভাবিত পন্থা এবং প্রবৃত্তির অনুসরণে কোনো কল্যাণ নেই; বাহ্যিকভাবে যদিও সেটিকে ইবাদত এবং কল্যাণকর মনে হয়।’ এটি শরীয়তের একটি উসূল ও মূলনীতি।

কুরআন, হাদিস ও ইতিহাস ঘাটাঘাটি করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লসমের ওয়াজের মাঝে যে কয়টি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়, সেগুলো হলো-

১. শ্রোতার প্রতি নিঃস্বার্থ দরদ। রাসূলের ওয়াজে শ্রোতার প্রতি দরদ ফুটে ওঠতো। তিনি মনেপ্রাণে শ্রোতার হেদায়েত কামনা করতেন।

২. সংক্ষিপ্ততা। রাসূলের নসীহতের মজলিস ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। সারারাতব্যাপী বা সারাদিনব্যাপী ওয়াজ নসীহত তিনি কখনো করেননি।

৩. শ্রোতার বোধগম্যতা। শ্রোতা বিষয়টি বুঝলো কি না, এ ব্যাপারে রাসূলের বিশেষ দৃষ্টি ছিলো। প্রয়োজন অনুপাতে একই শব্দ তিনবার উচ্চারণ করতেন। অনবরত বলে যেতেন না। তিনি এতটাই ধীরেধীরে কথা বলতেন যে, আম্মাজান আয়েশা রা: বলেন, কেউ যদি রাসূলের শব্দগুলোকে গুনতে চাইতো তাহলে গুনতে পারতো।

৪. দ্বীনি বিষয়ের তালিম। তার একেকটি ওয়াজ ছিল দ্বীনি কোনো বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ তালিম। বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ছিল তার ওয়াজের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

৫. কোনো বিষয়ের প্র্যাকটিক্যাল প্রদর্শনী। রাসূল সা: মাঝেমধ্যে সমাবেশে কোনো একটি আমলকে প্র্যাকটিক্যাল প্রদর্শন করতেন।

৬. রাসূলের ওয়াজে কোনো সুর ছিল না, ছিলো না কোনো হাসি-তামাশা, কৌতুক-কমেডি। ছিল শুধু তাযকিয়া- তালিম, ওয়াদা-ওয়ায়ীদ, সুসংবাদ-সতর্কীকরণ, গাম্ভীর্যতা, রোনাজারি।

৭. রাসূলের মাহফিলে না ছিল কোনো চাকচিক্য, জৌলুশতা, আড়ম্বরতা, না ছিলো মোটা অংকের কোনো বাজেট। আর না ছিল পৃথক কোনো সাজসজ্জা।

বড়ো আফসোসের বিষয়, বর্তমানের দ্বীনী মাহফিলগুলোতে এ সকল বৈশিষ্ট্য একেবারেই অনুপস্থিত বলা চলে। বৈধ অবৈধের প্রসঙ্গে আমি বলছি না। আমি তা’ছির বা প্রভাবের কথা বলছি। এসব গুণ না থাকায় ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে শ্রোতার কানসুখ, বক্তার পাবলিসিটি এবং পরিচালনা কমিটির নাম খ্যাতি অর্জন হলেও যে জিনিসটা হওয়ার কথা সেটিই হচ্ছে না। বক্তার টার্গেট থাকে শ্রোতাকে খুশি করে মার্কেট ধরা। শ্রোতার দৃষ্টি থাকে বক্তার সুর, অঙ্গভঙ্গি, বাহ্যিক রূপ-সৌন্দর্য ও সাজসজ্জার প্রতি। ফলে মানুষের মনোজগতে এর ইতিবাচক প্রভাব আস্তে আস্তে হ্রাস পাচ্ছে।

অনেকেই ভাবতে পারেন, এগুলো ছাড়া কি আর জনগণকে ওয়াজ গেলানো যাবে? তাদের জন্য সারাবিশ্বে সাড়া জাগানো কোটি কোটি মানুষের হেদায়েতের উপলক্ষ্য দাওয়াত ও তাবলিগের বয়ানগুলোর দৃষ্টান্ত পেশ করতে চাই।

পরিশেষে কামনা করি! ওয়াজ মাহফিল তার মূল মাকসাদের দিকে ফিরে আসুক। আল্লাহভোলা মানুষগুলো আল্লাহর পথের দিশা পাক। হেদায়েত আর ইহদা ও পথপ্রাপ্তি ও পথ প্রদর্শন হোক বক্তা শ্রোতা সবার মূল লক্ষ্য। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দান করুক। আমিন

(লেখাটি লেখকের একান্তই ব্যক্তিগত মতামত। এর দায়িত্বও তার)


আরো সংবাদ



premium cement