০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫
`


১৭ দিন ধরে সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণের লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন মাদরাসাছাত্রী

১৭ দিন ধরে সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণের লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন মাদরাসাছাত্রী - প্রতীকী ছবি

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এক কিশোরী তার সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়া এবং ১৭ দিন আটক থাকার লোহমর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। মেয়েটি অষ্টম শ্রেণির এক মাদরাসা ছাত্রী। নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের ওই কিশোরীকে স্থানীয় তিন যুবক তুলে নিয়ে গিয়ে আটকে পাঁচ দিন ধরে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে। এরপর দুটি বাড়িতে রাখা হয় ঘটনা না বলার জন্য মৃত্যুর হুমকি দিয়ে। পরে এক বাড়িওয়ালার সহযোগিতায় ১৭ দিন পর নিজ বাড়িতে গিয়ে ওই ঘটনা প্রকাশ করে দিয়েছে কিশোরী। স্থানীয় হাসপাতাল হয়ে মঙ্গলবার তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য নেয়া হয়েছে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাাতলের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে। সেখানেই তিনি এই রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। এ ঘটনায় কিশোরীর বাবা অনেক আগেই থানায় অভিযোগ দেয়ার কথা বললেও পুলিশ বলছে এজাহার প্রক্রিয়াধীন।

ঘটনার শিকার কিশোরীর বাড়ি নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের কালিকাপুর গ্রামে। স্থানীয় একটি মাদরাসার অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী তিনি। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গাইনি বিভাগে কথা হয় মেয়েটির সাথে। মেয়েটি আতঙ্কিত, ভীতসন্ত্রস্ত। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, গত ২৩ এপ্রিল আমার বাড়ির পাশের উত্তরপাড়ায় খালাবাড়িতে ইফতার দিতে যাই। সেখান থেকে ইফতার শেষে আমি আমার দুই খালাত ভাইয়ের সাথে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হই। পথিমধ্যে একটি দোকানের সামনে থাকা স্থানীয় যুবক জীবন, মানিক ও রশিদুল আমার পথরোধ করে।

কিশোরী বলেন, এসময় মানিক আমাকে প্রথমে জাপটে ধরে, আর জীবন আমার মুখে চিপে ধরে, এবং রশিদুল পা ধরে আমাকে ভুট্টাক্ষেতের অনেক ভেতরে নিয়ে যায়। তারপর ভুট্টাক্ষেতে তিনজনেই প্রথমে আমাকে ধর্ষণ করে। পরে সেখান থেকে একটি গভীর নলকূপের ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে তারা আমাকে পালাক্রমে পাঁচ দিন ধরে ধর্ষণ করে। আমি ওদের পা ধরেছি, বলেছি কাউকে কিছু বলব না। আমাকে ছেড়ে দাও। তারপরও ওরা আমাকে রেহাই দেয়নি। আমাকে এই কয়েক দিনে ওরা শুধু রুটি খাইয়েছে।

কিশোরী বলেন, পাঁচ দিনের মাথায় ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় একটি অপরিচিত লোক আসে ওই ঘরে। আমাকে ওরা তিনজন বলে, ওদের সাথে চলে যা। তখন আমি দেখি ওই অচেনা লোকটা রশিদুলকে অনেকগুলো টাকা দিলো। রশিদুল তখন বলল, তুই ওদের সাথে চলে যা। তোর কিছু হবে না। আর এই কয়দিনে যা কিছু হয়েছে তা ভুলে যা। কাউকে কিছু বলবি না। বললে তোকে র‌্যাপ করার ভিডিও আছে, সেগুলো নেটে ছেড়ে দেবো। তোর বাবা-মাকে মেরে ফেলব।

কিশোরী বলেন, ওই অপরিচিত লোকটার কাছে গরুর গোশত ছিল। আর ঘরটিতে একটা খাট এবং মদের বোতল ছিল। লোকটা পানি আনার জন্য বাইরে গেলে দরজা আটকে যায়নি। তখন আমি দরজা খুলে দৌড়াই। এসময় জীবন ও মানিকও আমার পিছু পিছু আসে। কিন্তু সামনে আরেকজন লোক দেখে তারা পালিয়ে যায়।

অষ্টম শ্রেণির ওই ছাত্রী প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়ে আরো জানায়, আমি তখন ওই লোকটাকে সব খুলে বলি। তখন তিনি আমার ঠিকানাসহ সব কিছু শুনতে চান। আমি তাকে বলি। কিন্তু কোনো নম্বর আমার ছিল না। পরে আমার মাদরাসার সামনে ঝালমুড়ি বিক্রেতা সায়তারা বেগমের নম্বর জোগার করে ওই লোকটা আমার সাথে সয়তারার কথা বলিয়ে দেন। আমি সায়তারা আপুকে সব খুলে বলি, কিন্তু ওর স্বামীও যে আমাকে ধর্ষণ করেছে সেটা বলিনি। আমাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে ডাকি। তখন রাত ১০টা। কিন্তু সায়তারা আপু বলেন, তোর দুলাভাই যাচ্ছে। তার সাথে আয়। পরে রশিদুল ভাই সেখানে আসে এবং আমাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোকটার কাছ থেকে নিয়ে যায়। কিন্তু পথিমধ্যে রশিদুল ভাই বলে, এই অবস্থায় তোকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যাবে না। কিশোরগঞ্জে আমার পুরাতন বাড়ি আছে। সেখানে রাতে থেকে কাল সকালে তোকে বাড়িতে রেখে আসবো। তখন আমি তার সাথে কিশোরগঞ্জের ওই বাড়িতে যাই।

কিশোরী বলেন, পরের দিন (২৮ এপ্রিল) সকাল বেলা সায়তারা আপু ওই বাসায় আসে। আমি আপুকে বলি বাড়ি রেখে আয়। কিন্তু তখন আপু বলে, তোর জন্য পাত্র দেখেছি। তোকে বিয়া দিবো। তখন আমি তাকে বলি। আমি এখন বিয়ে করবো না। পড়ব। তখন আপু আমাকে বলে, তোর বাপ তো তোকে যৌতুক দিতে পারবে না। তুই বিয়ে কর। তখন আমি না করলে আপু ও রশিদ ভাই আমাকে মারে। একপর্যায়ে বলে, এখন তোর বাপ আমাদের নামে মামলা করেছে। তোকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যাবে না।

কিশোরী বলেন, ওই দিন (১৮ এপ্রিল) বিকেলের দিকে সায়তারা আপু বলে, রংপুরের শঠিবাড়িতে আমার ননদের বাড়ি আছে। সেখানে গিয়ে তুই কিছু দিন থাক। আর কেউ কিছু বললে, তুই বলবি, নিজেই তুই ওখানে গেছিস বিয়ে করার জন্য। যদি এটা না বলিস, তাহলে তোর বাপ-মা ভাই বোনসহ তোকে মেরে ফেলবো। পরে তারা আমাকে শঠিবাড়িতে সায়তারা আপুর ননদের স্বামী মাহাবুলের বাড়িতে নিয়ে যায়। আমি সেখানে গিয়ে মাহাবুল ভাইকে তাদের শেখানো কথা বলি। পরে রশিদুল, মানিক এবং জীবন আমাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দেয়। একপর্যায়ে বলে, প্রতি রাতে তোকে এক হাজার করে টাকা দেব। তোকে যেখানে পাঠানো হবে সেখানে যাবি। তাহলে তুই ভালো থাকবি। তোর বাপ-মাকেও টাকা পাঠাতে পারবি। আমি তাতেও রাজি না হওয়ায় তারা আমাকে আবারো টর্চার করে। পরে বিষয়টি আমি মাহাবুল ভাইকে খুলে বলি। মাহাবুল ভাই ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি তখন আমাকে বললেন, তোর কিছুই করতে পারবে না ওরা। তোকে বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো।

কিশোরী আরো বলেন, এরমধ্যে একদিন রশিদুল এলে মাহাবুব রশিদুলকে বলে, তোদের সব কথা আমি শুনেছি। তোরা মেয়েটিকে তার বাড়িতে রেখে আয়। তার বাপ-মা এবং চেয়ারম্যান মেম্বারকে নিয়ে আয়। তখন এর মধ্যে একদিন আমাকে মাহাবুল ভাই তাদের কাছে দেয়ার জন্য রংপুর আনেন। কিন্তু তারা আসেনি। পরে গত ৮ মে মাহাবুল ভাই রংপুরে এনে তার বন্ধুর গাড়িতে তুলে দেয়। আমি গাড়ি থেকে কিশোরগঞ্জে গিয়ে নেমে দেখি খাইরুল মেম্বার, রশিদুল, মানিকের ভাই, জীবনের ভাই, জীবনের মা, বাবা সেখানে আছে। তখন তারা আমাকে প্রথমে খাইরুল মেম্বারের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখান থেকে তারা সবাই আমাকে নিয়ে আমার বাড়ির দিকে রওনা দেয়। তখন মানিকের মা , বাবা ও ভাই আমাকে বলে, তুই বড়িতে গিয়ে বলবি, আমি নিজ ইচ্ছায় বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছি। যদি না বলিস তা হলে শুধু লাশ দেখতে পাবি। আমি শুধু বাড়িতে যাওয়ার জন্য তাদের কথায় সায় দিয়েছি। বাড়িতে যাওয়া মাত্রই আমি আমার পরিবারের কাছে সব কথা খুলে বলেছি। তখন তারা পুলিশকে জানায় এবং আমাকে কিশোরগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি করায়। সেখান থেকে মঙ্গলবার (১০ মে) আমাকে বিকেলে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এখানকার চিকিৎসকরা আমার সব কিছু শুনেছেন। পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন।

কিশোরী বলেন, এর আগেও জীবন এবং মানিক আগে থেকেই আমাকে উত্ত্যক্ত করত। আমাকে বিয়ে করতে চাইত। সে বিষয়ে আমি বাড়িতে জানালে তাদের অভিভাবককে বলে কিন্তু, তবুও তারা আমার পিছু ছাড়েনি। রশিদুল আর সায়তারা আপু সহযোগিতা করে আমাকে সবাই মিলে ধর্ষণ করেছে। আমি এদের সবার ফাঁসি চাই।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মোঃ ফিরোজ মিয়া জানান, সেক্সুয়াল এসাল্ট নিয়ে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ হাসপাতাল থেকে মঙ্গলবার বিকেলে ওই কিশোরী রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। প্রথমে তাকে গাইনি ওয়ার্ডে ভর্তি করে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা ও চিকিৎসাপত্র দেয়া হয়েছে। এরপর তাকে হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে নেয়া হয়েছে। সেখানে তার উন্নত চিকিৎসা এবং সকল ধরনের আইনি সহযোগিতা দেয়া হবে।

হাসপাতালে আসা কিশোরীর দাদি হামিতোননেছা জানান, ওরা তিনজনে মিলে আমার নাতিকে শেষ করে দিলো। এখন আমি আমার এই নাতনিকে কোথায় বিয়ে দেবো? আমি চাই ওদের ফাঁসি হোক।

হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে কিশোরীর দাদা মজিবুর রহমান বলেন, আমার খুব গরিব। আমার ছেলেটাকে দুজনে তুলে হাঁটাচলা করতে হয়। এখন ওর মেয়েটার এই সর্বনাশ করল ওরা। ওদের ফাঁসির ব্যবস্থা করে দেন।

ওই কিশোরী জানিয়েছেন, অভিযুক্তদের তিনজনই বিবাহিত। তারমধ্যে জীবন ও মানিক ট্রলিচালক এবং রশিদুল স্ত্রী সায়তারাকে নিয়ে স্থানীয় কাকিলাপুর দাখিল মাদরাসার সামনে ঝালমুড়ি বিক্রি করে।

এ ব্যাপারে কিশোরীর পিতা জানান, ঘটনার পরপরই আমি অভিযোগ দায়ের করেছি। কিন্তু আমার মেয়েকে পুলিশ উদ্ধার করতে পারেনি। আমার মেয়েকে মেম্বার চেয়ারম্যান বাড়িতে দিয়ে গেছে। আমার স্ত্রী মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে থানায় গেছে। এখন পুলিশ কী করবে আমি জানি না।

এদিকে মঙ্গলবার (১০ মে) রাত ৯ টায় নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ থানার ওসি রাজিব কুমার দাস জানান, ঘটনাটি আমরা শুনেছি। ওদের তিনজনের মধ্যে একজনের সাথে মেয়েটির সম্পর্ক ছিল। এখনো মেয়ের মুখে তার বক্তব্য শুনিনি। মেয়েটিকে কিশোরগঞ্জ হাসপাতাল থেকে রংপুর মেডিক্যালে নেয়া হয়েছে। এখনো পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ দেয়া হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।


আরো সংবাদ



premium cement