২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তরুণীর লাশ যেভাবে ট্রাকের কেবিন থেকে তিস্তা নদী

তরুনীর লাশ যেভাবে ট্রাকের কেবিন থেকে তিস্তা নদী - নয়া দিগন্ত

পৈশাচিকতারও একটা পরিসীমা থাকে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে সেটিও হারিয়ে যাচ্ছে মানব সভ্যতা থেকে। করোনা মাহমারি যখন মানুষকে মানবিক হওয়ার প্রণোদনা জোগানোর শিক্ষা দেয়ার কথা। তখন ঠিক হলো তার উল্টোটা। করোনাকালেই নির্মম নিষ্ঠুর অমানবিকতার নজির তৈরি করা হলো এক গার্মেন্টসকর্মী তরুনীর লাশের সাথে। সেকারণে রংপুরে ট্রাকের কেবিনে ১৬ ঘন্টা থাকার পর ময়না তদন্ত হয়ে ২ দুইদিন তিস্তা নদীতে ভেসে পুলিশের সহযোগিতায় হয়েছে তার দাফন। করোনা এবং ধর্ষণ সন্দেহে লালমনিরহাটের বুড়িমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আওয়ামীলীগ নেতা আবু সাঈদ নওয়াজ নিশাতের হুমকিতে হাসপাতাল থেকে লাশ বাড়ি নিয়ে যেতে পারে নি ওই তরুনীর পরিবার। নিষ্ঠুর এই ঘটনায় ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন।

পুলিশ, পরিবার এবং ট্রাক চালক ও হেলপার সূত্র মতে, গত ২১ মে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে এগারোটায় গাজিপুরের টঙ্গীর হারিকেন এলাকা থেকে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়নের আমবাড়ী গ্রামের মোস্তফার কন্যা গার্মেন্টস কর্মী মাহমুদা আক্তার মৌসুমীকে বুড়িমারীর শফিকুল ইসলাম নামের এক চালকের ফোন কলে ট্রাকের (নং ঢাকা মেট্রো-২-২২-২৫৯৮) কেবিনে উঠায় বুড়িমারী ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামের মৃত আলতাফ হোসেনের পুত্র ট্রকা চালক আজিজুল ইসলাম(২৭) ও একই গ্রামের শাহ আলমের পুত্র হেলপার রতন মিয়া (২৭)।

এরপর তাকে নিয়ে ঢাকায়গাউছিয়া হয়ে মুন্সীর পাম্পে গিয়ে ট্রাকে গরুর মশারি ভর্তিকরে রংপুরের উদ্দেশে রওনা দেয়। পথিমধ্যে আব্দুল্লাহপুরে এসে ওই ট্রাকে ওঠে আজিজুলের ভাতিজা একই ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের কালাম ভাটিয়ার পুত্র বদি মিয়া (২২)। এরপর চান্দুরা এলাকা পার হওয়ার পর চালক ও হেলপারকে বদি মিয়া জানায় যে মেয়েটি মারা গেছে। তারপর ২২ মে শুক্রবার সকাল সাতটায় রংপুর ক্যাডেট কলেজের সামনে এসে ট্রাকটি দাঁড় করায় ড্রাইভার। এরই মধ্যে লাশটি শুরু হয় নজীরবিহীন নিষ্ঠুরতা। মেয়েটির পৈত্রিক নিবাস লালমনিরহাটের বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নিশাত ও ফোন কলে তুলে দেয়া অপর চালক শফিকুল এবং ট্রাকটির চালক আজিজুল, হেলপার রতন ও বদি মিয়া বিষয়টি পুলিশকে অবহিত না করেই বুড়িমারীতে মেয়েটির পিতা মোস্তফার সাথে সমঝোতার চেষ্টা করে।

ট্রাক চালক আজিজুল ইসলাম ও হেলপার রতন জানান, মেয়েটিকে যখন ট্রাকে তুলে দেয়া হয়, তখন সে কাঁদছিল। একজন বয়স্ক মানুষ তাকে ট্রাকে তুলে দিয়েছিল। শুনেছি তার দুটি বিয়ে হয়েছিল। গার্মেন্টেসে কাজ করতো। কিভাবে মারা গেলো আমরা বিষয়টি বুঝতে পারি নি। আমরা তার সাথে কোন অন্যায় করিনি। তারা আরো জানান, সকালে ক্যাডেট কলেজের সামনে ট্রাক দাঁড় করাই। পরিবারে খবর দেয় বদি। মেয়েটির পিতা মোস্তফা দুপুরে রংপুরে এসে ট্রাকের কেবিনে মেয়ের লাশ দেখে জানায়, তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এরপর তিনি লাশ না নিয়েই পাটগ্রাম ফিরে যায়। পরে বিষয়টি সন্ধ্যায় আমরা পুলিশ জানাই। এরপর সেখানে পুলিশের পাহারা বসানো হয় এবং ড্রাইভার ও হেলপারকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করে পুলিশ। এরই মধ্যে পুলিশের সাথে বিশেষ সমঝোতায় ট্রাক থেকে গরুর মশারিগুলো নামিয়ে নেয়ার জন্য রংপুর মহানগরীর স্টেশন রোডের খান বেডিংয়ের মালিক অন্য একটি ট্রাক আনে। রাত সাড়ে ১০ টায় সেখানে সাংবাদিকের ক্যামেরা দেখে দ্রুত গতিতে মাল আনলোড করার জন্য আনা একটি কাভার্ড ভ্যান পালিয়ে যায়।

রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের তাজহাট থানার ওসি রোকন উদ দৌলা জানান, আমরা প্রাথমিক তদন্তে জানতে পারি তরুনীর পিতা লাশটি গ্রহণ করতে অস্বীকার করায় ২২ মে সন্ধ্যায় খবর দেয়া হয় ‍পুলিশকে। আমরা সেখানে পাহারা বসাই। এবং লাশ পোস্ট মোর্টেমের জন্য রাত পৌনে ১২ টায় রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালের মর্গে পাঠাই। পরের দিন ২৩ মে ময়না তদন্ত শেষে লাশটি তার পিতা মোস্তফার হাতে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা হস্তান্তর করি। একই সাথে মেয়েটির নমুনা সংগ্রহ করে পিসিআর ল্যাবে পাঠাই।

এরপরের গল্প আরও নিষ্ঠুর। ১৬ ঘন্টা কেবিনে থাকার পর ময়নাতদন্ত হলেও লাশ হস্তান্তরের পর যে ঘটনা ঘটেছে তা অমানবিকতার সকল দৃষ্টান্তকে বদলে ফেলে দিয়েছে। হাসপাতাল থেকে লাশ বুঝে নিয়ে বিপাকে পড়েন পিতা মোস্তফা। স্থানীয় বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত লাশ বাড়িতে আনতে বারণ করে অন্যত্র দাফনের নির্দেশ দেন। বাড়িতে আনলে তাকে গ্রাম ছাড়া করার হুমকি দেন। কি করবেন বুঝে উঠতে না পারায় চেয়ারম্যানই তাকে একটি এম্বুলেন্স ঠিক করে দিয়ে ৫ হাজার টাকা দিতে বলেন। এম্বুলেন্স ওয়ালাকে বলে হয় আনজুমানে মফিদুল ইসলামে লাশটি দিয়ে আসতে। এরপর লাশ এ্যম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে অসহায় পিতা চলে যান বাড়িতে। আর নিষ্ঠুর এম্বুলেন্স চালক লাশটি আনজুমানে মফিদুল ইসলামের কাছে না দিয়ে গঙ্গাচড়ার শেখ হাসিনা তিস্তা সেতুর পার্শ্বে তিস্তা নদীতে ফেলে দেয়।

২৪ মে লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিশখোচা ইউনিয়নের চরগোবর ঘাট চরে স্থানীয়রা সাদা কাফনে একটি লাশ ভেসে থাকতে দেখেন। খবর দেয়া হয় পুলিশ। আদিতমারী থানার ওসির কাছে সেই লাশ উদ্ধারের ঘটনাটি শুনলে সবার শরীর শিউরে উঠবে বারবার।

আদিতমারী থানার ওসি সাইফুল ইসলাম জানান, স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর পেয়ে যাই চরগোবরার চরে সন্ধার আগে আগে। গিয়ে দেখতে পাই বাংলাদেশ ‍পুলিশ লেখা একটি কাফনের কাপড়ে মোড়ানো এক তরুনীর মরদেহ। খুলে দেখতে পাই ময়না তদন্ত করা। নিয়মানুযায়ী লাশটি দাফন হওয়ার কথা। কিন্তু নদীতে কেন বিষয়টি সাথে সাথেই এসপিকে জানানো হয়। রাতেই খুঁজে বের করা হয় বুড়িমারির আমবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা মৌসুমীর পিতা মোস্তফাকে। তাকে থানায় নিয়ে এসে মরদেহ শনাক্ত করা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে জানান, স্থানীয় চেয়ারম্যান নিশাত হুমকি দিয়েছে লাশ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যাবে না। চেয়ারম্যান বলেছে তোমার মেয়ের করোনা আছে নয় তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। তাকে গ্রামে দাফন করা যাবে না। আনজুমানে মফিজুল ইসলামে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সেখানে লাশ দিয়ে বাড়ি আয়।
ওসি জানান, অসহায় পিতা এসব কথা বলতে বলতে কাঁদতে থাকেন। এরই মধ্যে আমরা রিপোর্ট পাই তরুণীর করোনা নেগেটিভে এসেছে। বিষয়টি এসপিসহ জেলা প্রশাসনকে জানানো হলে পাটগ্রামের ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যান, ওসি সহ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের উপস্থিতিতে নিজ বাড়িতে লাশ দাফন করা হয়। তিনি জানান, চেয়ারম্যান সব সময় মোবাইলে কথা বলতো মোস্তফার সাথে। সব নম্বর ট্রাকিং শুরু করা হয়েছে।

লালমনিরহাটের পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানা মর্মন্তুদ এই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জানান, আদিতমারীর ওসি আমাকে ফোন করার সাথে সাথেই আমার মাথায় আসে রংপুর ক্যাডেট কলেজের সামনে ট্রাকের কেবিনে থাকা তরুনীর মরদেহের বিষয়টি। সাথে সাথে আমি বিষয়টি রংপুর মেটোপুলিশের সাথে যোগাযোগ করে পাটগ্রাম থানার ওসিকে নির্দেশ দেই খোঁজ নিতে। তিনি খোঁজ নিয়ে জানান মর্গ থেকে লাশ হস্তান্তর করা হলেও সেটি পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়নি। পরে আমরা লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করি।

তিনি জানান, পিসিআর ল্যাবে পরীক্ষায় মেয়েটির করোনা সন্দেহ এসেছে নেগেটিভ। বাকী থাকলো ধর্ষনের ঘটনা। পুরো ঘটনাতেই ঘুড়ে ফিরে আসছে স্থানীয় চেয়ারম্যান নিশাতের নাম। তিনিই বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দাফন করতে বাঁধা দিয়েছিলেন। সে কারণে অসহায় ছিল পরিবার। পুরো বিষয়টি তদন্ত করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার হবে।

এদিকে প্রশাসন নড়েচড়ে বসায় ঘটনার গল্প পরংপরা থেকে নিজেকে বাঁচাতে উঠেপড়ে লেগেছে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত। তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতা হওয়ায় এখনও তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে। এবং পুরো ঘটনাটিই পরিবারের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছেন তিনি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

নির্মম এ ঘটনায় ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করছে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন। যে ট্রাকের কেবিনে ছিল লাশ, সেটির গায়ে খাদ্য পরিবহনের কথা লেখা থাকলে বহন করা হচ্ছিল গরুর মশারি। যা রংপুর মহানগরীর স্টেশন রোডের খান বেডিংয়ে আনার জন্য লোড করা হয়েছিল। ট্রাকটি মালামালসহ এখন পুলিশের হেফাজতে আছে। এ ঘটনায় রংপুর তাজহাট থানায় একটি ইউডি মামলা এবং লালমনিরহাটে সংশ্লিষ্ট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করা হয়েছে। পুলিশ, র‌্যাবসহ চারটি সংস্থা বিষয়টি তদন্ত করছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।


আরো সংবাদ



premium cement