০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


তেল-গ্যাসবিহীন আরব দেশগুলোয় অর্থনৈতিক সঙ্কট

-

পৃথিবীর প্রায় মধ্যস্থলে অবস্থিত এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপজুড়ে মোট ১৭টি দেশ নিয়ে গঠিত একটি অঞ্চল যা ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে ‘মধ্যপ্রাচ্য’ নামে খ্যাত। এর মধ্যে ইসরাইল ছাড়া সব ক’টি রাষ্ট্রের অধিবাসী মুসলিম। তাদের ভাষা যেমন আরবি তেমনি বর্ণ, সংস্কৃতি ও জাতিগত ইতিহাসও প্রায় অভিন্ন। এই অঞ্চলের অনেকগুলো দেশ যেমন- সৌদিআরব, কুয়েত, কাতার, ইরাক, ওমান, বাহরাইন, সিরিয়া, ইরাক, ইরান, লিবিয়া ইত্যাদি দেশে প্রচুর তেল-গ্যাসসহ অনেক খনিজসম্পদ রয়েছে। পাশাপাশি মিসর, আলজেরিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়া, সুদান, লেবানন, ফিলিস্তিন, জর্দান এবং তুরস্কের খনিজসম্পদ তেমন নয়; এই দেশগুলো অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে। এর মধ্যে লেবানন ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক সঙ্কটে পতিত। ধারণা করা হচ্ছে যে, ২৪ সালের দিকে লেবাননের পরিস্থিতি বরণ করতে হতে পারে এই অঞ্চলের তেল-গ্যাসবিহীন দেশগুলো। আর্থিক সঙ্কটের ফলে এই দেশগুলোর সার্বিক পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
ক্রমবর্ধমান ঋণ এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পতন : করোনাভাইরাসের প্রভাবে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের সম্মিলিত জিডিপি ২০১৯ সালের ৩.৪৭ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৩ সালে ৩.১২ ট্রিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এই অঞ্চলের বৈদেশিক ঋণ সঙ্কট শুরুর এটি একটি বড় কারণ। মহামারীজুড়ে আরোপিত পুনপুন লকডাউনের প্রভাবে এই দেশগুলোর সম্মিলিত অর্থনীতির আকার প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন ডলার হ্রাস পেয়েছে। এই অঞ্চলের দেশগুলোর প্রাপ্ত রেমিট্যান্সের পরিমাণ ২০১৯ সালের ৫৯.৬৩ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২-২৩ সালে ৫৩.৪২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। স্বদেশে রেমিট্যান্সের এই পতনের কারণ মূলত এসব দেশের প্রবাসীরা যেসব দেশে কাজ করেছে সেসব দেশে করোনা মহামারীর প্রভাবে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ হ্রাস পেয়েছে।

মূলত আরবের যেসব দেশ তেল আমদানি করে অর্থাৎ যারা প্রাকৃতিক সম্পদ রফতানি থেকে রাজস্ব আয় করে না সেসব দেশের ক্ষেত্রে এমনটি হচ্ছে। এই দেশগুলো দু’টি যুগপৎ সঙ্কটের সম্মুখীন, যেমন- অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মন্দার কারণে কর রাজস্ব হ্রাস এবং বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স হ্রাসের ফলে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ঘাটতি প্রায়ই স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হার হ্রাসের দিকে পরিচালিত করে মূলত আমদানির অর্থায়নের জন্য প্রয়োজনীয় গ্রিন ডলারের ঘাটতির কারণে। এ দিকে কর রাজস্ব হ্রাসের ফলে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর বাজেট ঘাটতি ২০১৯ সালে জিডিপির ৩.৮ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালে ১০.১ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
আরব অঞ্চলের দেশগুলো এভাবে তাদের বাজেট বাস্তবায়নের জন্য ২০২১ এবং ২০২২ সালে বৈদেশিক ঋণের সহায়তা নিতে বাধ্য হয়েছিল। এ ছাড়া মহামারীর সময় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সামাজিক সুরক্ষা নেটওয়ার্কগুলোর খরচ মেটাতে এবং সেই সাথে দেশের চলতি হিসাবের ঘাটতি মেটাতে গ্রিন ডলারের প্রয়োজনে বৈদেশিক ঋণ করতে বাধ্য হয়েছিল। সার্বিকভাবে, এই সব পরিস্থিতির কারণে, কেবল ২০২২-২৩ সালে আরব দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান মোট ঋণের পরিমাণ ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এই দেশগুলোর মধ্যে মিসর, অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি সরকারি ঋণ করেছে, যার পরিমাণ ৪০৯.৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে এবং এই ঋণের পরিমাণ ওই দেশের জিডিপির ৯৪ শতাংশ অতিক্রম করেছে। সুদানের ঋণ-টু-জিডিপি অনুপাত ২৮৪ শতাংশের বেশি যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বিদেশী ঋণের ক্রমবর্ধমান সঙ্কট : বিশ্বব্যাংক ২০২১ সাল থেকেই আরব অঞ্চলের তেল-আমদানিকারী দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক ঋণ যখন তাদের জিডিপির প্রায় ৯৩ শতাংশে পৌঁছে যাচ্ছিল তখন থেকেই এই দেশগুলো সম্পর্কে সতর্ক করে আসছিল। এই দেশগুলোর প্রায় সব অর্থনৈতিক সূচক ইঙ্গিত করছিল যে, ২০২৩-২৪ সালে এই দেশের ঋণগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি সঙ্কটে পরিণত হয়ে পড়বে যা এই দেশগুলো সামলাতে সক্ষম নাও হতে পারে। এমনকি ২০২৩ সালে ঋণের বেশ কয়েকটি ঘটনা এই দেশ এবং তাদের জনগণের ওপর এই ঋণের নেতিবাচক প্রভাব বাড়িয়েছে। বিশেষ করে, বৈদেশিক রিজার্ভের পতন এবং রেমিট্যান্সের সঙ্কোচন এবং ঋণ সঙ্কটসহ অন্যান্য সঙ্কটের কারণে, একটি সাধারণ উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে যে অনেক আরব দেশকেই লেবাননের ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে।

২০২২-২৩ সালে বিশ্ব অর্থনীতির ঘটনাগুলো বিশেষ করে করোনা উত্তর প্রভাব এবং রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিদেশী ঋণের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। এই সময় আরব অঞ্চলের দেশগুলো, বিশেষত যারা তেল আমদানি করে, তারা এই আরো বেশি ঋণের প্রভাব এবং ঝুঁকি উপলব্ধি করতে শুরু করে। ২০২২ সালের মার্চ মাস থেকে, মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়াতে শুরু করে, যা ২০২০ সালের শুরুতে মাত্র ০.২৫ শতাংশের তুলনায় ২০২৩ সালে প্রায় ৪.৫ শতাংশে পৌঁছে। মার্কিন মুদ্রায় ক্রমবর্ধমান সুদের হার বৃদ্ধির কারণে আরব অঞ্চলের সরকারগুলোর ঋণের পরিমাণ বাড়ানোটা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। ইউক্রেনের যুদ্ধে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির ঢেউ উঠে; ফলে, ডলারের দাম আরো বাড়তে থাকে যা তেল এবং খাদ্যদ্রব্যসহ সব কাঁচামাল এবং মৌলিক পণ্যের দাম বৃদ্ধি করেছিল। এর ফলে, খাদ্য ও তেল আমদানিকারী আরব দেশগুলোর চলতি হিসাবে ঘাটতি আরো বৃদ্ধি পায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের আরো ঘাটতিতে পড়তে হয়।
এভাবে উল্লিøখিত দেশগুলো তাদের চলতি হিসাবের ঘাটতি মেটাতে আরো ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছিল, যা বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি করে। তদ্ব্যতীত, এই উন্নয়নগুলোর সাথে নগদ ডলারের অভাবের কারণে, তাদের বিশাল ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য তাদের আরো বেশি ঋণ করতে হয়েছিল। ফলস্বরূপ, মিসর সরকার ৪৬ মাসের মেয়াদে কিস্তিতে শোধ করার শর্তে অতিরিক্ত তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার জন্য শেষ অবলম্বন হিসেবে ২০২২ সালে আইএমএফের কাছে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ইতোমধ্যে, তিউনিসিয়া, তার আর্থিক সঙ্কট মোকাবেলার জন্য, ১.৯ বিলিয়ন ডলার নতুন অর্থায়ন পেতে গত অক্টোবরে আইএমএফের স্টাফ পর্যায়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে, যা ৪৮ মাসের মেয়াদে দেয়া হবে।
সুদান কর্তৃপক্ষও ২.৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রাপ্তির জন্য আইএমএফের দ্বারস্থ হয়, যখন মার্কিন প্রশাসন বিশ্বব্যাংকের বকেয়া পরিশোধের জন্য দেশটিকে ১.১৫ বিলিয়ন একটি অন্তর্বর্তীকালীন ঋণ দিতে সম্মত হয়। দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে এই সব চুক্তি স্থগিত থাকা সত্ত্বেও, সুদান বেসামরিক লোকদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য, শর্ত অনুযায়ী, রাজনৈতিক চুক্তি বাস্তবায়ন শুরু করে এবং যার ফলে এই ঋণগুলো সম্পূর্ণ পাওয়া সম্ভব হবে বলে আশা করা যাচ্ছিল। তবে সুদানের বর্তমান অভ্যন্তরীণ সঙ্কট যা গৃহযুদ্ধে রূপ নিচ্ছে, তার ফলে সুদানের পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে পৌঁছবে তা সময় বলে দেবে।

লেবানন, যা ২০২০ সাল থেকে তার ঋণ পরিশোধে খেলাপি হয়েছে। ফলে, ২০২২ সালে তিন বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন পেতে আইএমএফের সাথে স্টাফ পর্যায়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। অন্য দিকে, মরক্কোর মতো কিছু দেশ ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া, জলবায়ু পরিবর্তন এবং করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাব মোকাবেলায় ঋণ পাওয়া নিশ্চিত করতে বিশ্বব্যাংকের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়েছে।
এই সব উদাহরণ থেকে বিষয়টি পরিষ্কার যে, আরব অঞ্চলের দেশগুলো কীভাবে আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক থেকে বিশাল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছিল। তারা ২০২২ সালে বিশ্ব অর্থনীতির পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে যেসব আর্থিক অসুবিধার মুখোমুখি হয়েছিল তাও প্রকাশ করে, যা তাদের এমন কঠোর শর্তে ঋণ নিতে বাধ্য করেছিল।
পরিশেষে বলতে হয়, কেবল তেল-গ্যাস আমদানিকারক আরব দেশই নয়; বরং অনেক অনারব দেশ, যেমন- বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও আফ্রিকার অনেক উন্নয়নশীল দেশ যাদেরকে তেল, গ্যাস, খাদ্য এবং সারের মতো জরুরি পণ্য আমদানির উপর নির্ভর করতে হয় তাদের সবার একই ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে ২০২৩ সালে। বিশেষ করে বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ যে হারে বাড়ছে, চলতি হিসাবের ঘাটতি যেভাবে বাড়ছে, রিজার্ভ যেভাবে কমছে, আমদানি বাড়ছে, রফতানি বাড়ছে না, রেমিট্যান্স কমছে; এক কথায় দেশের অর্থনীতিতে ভালো কোনো খবর নেই। ফলে, ইতোমধ্যে ঋণের জন্য দ্বারস্থ হতে হয়েছে আইএমএফের। অধিকন্তু, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থা বেড়ে চলেছেই, ফলে দেশটির জন্য ২০২৩ সাল থেকে সামনের দিকের অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে। সুতরাং জ্বালানি সরবরাহ বাড়িয়ে এবং আমদানি-নির্ভরতা কমিয়ে এ সমস্যাগুলোর অনেকটাই কমানো যায়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি দেশের খনিজসম্পদ আমদানি-নির্ভরতা কমাতে হবে। বিশেষ করে গ্যাসের উত্তোলন ব্যাপকভাবে বাড়ানোর প্রচেষ্টার পাশাপাশি নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র খুঁজে বের করতে হবে। গ্যাসের নিশ্চয়তা দিয়ে সারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের দেশীয় উৎপাদন নিশ্চিত করে আমদানি-নির্ভরতা কমাতে হবে; রফতানিমুখী শিল্পকারখানার উৎপাদন ঠিক রাখতে হবে। এক সময় আমরা শুনতাম, দেশ গ্যাসের উপর ভাসছে; গ্যাস রফতানির কথাও শুনেছি। এখন অনেক বছর ধরে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের বিষয়ে তেমন কোনো খবর আসছে না। পরদেশী গ্যাস উত্তোলনকারীদের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে এ দেশের সফল গ্যাস উত্তোলনকারীদের শক্তিশালী এবং আধুনিকায়ন করে নিজস্ব প্রযুক্তিতে গ্যাস উত্তোলন বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, জ্বালানির প্রয়োজনীয়তা সাময়িক নয়; বরং অসীম সময়ের জন্য।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : mizan12bd@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement