আমরা কি কলঙ্কিত জাতি হতে যাচ্ছি
- মোদাসসের হোসেন খান, বীরপ্রতীক
- ০৮ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
দেশের বর্তমান সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে সম্ভবত ভাববার সময় এসেছে, আমরা কি ক্রমেই একটি মিথ্যাচারী, বিকৃতরুচির প্রতারক জাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে পড়ছি? এ প্রশ্ন কেবল বহির্বিশ্বের অধিকতর শিক্ষিত ও সভ্য মানুষেরই নয়, স্বদেশের সচেতন সব নাগরিকের মুখেও অহরহ উচ্চারিত হচ্ছে, তাদের করে তুলছে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
এ কথা সর্বজনবিদিত যে, বিশ্বমানচিত্রে প্রতিটি দেশ ও জাতির মর্যাদা এবং সম্মান প্রাপ্তির শ্রেণিবিন্যাসের মাপকাঠি সেই দেশের প্রকৃত ইতিহাস। মানবসভ্যতার ইতিহাস মানেই উত্থান-পতন, উন্নতি ও অবনতির ইতিহাস। যেখানে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে ধ্বংস ও সৃষ্টির কাহিনী, কলঙ্ক ও খ্যাতি, কীর্তিমান ও আলোকিত ব্যক্তিদের অবদান, তাদের বীরগাথা আর একই সাথে খলনায়ক ও বিশ্বাসঘাতকদের ঘৃণিত কার্যকলাপের বিবরণ। ইতিহাসে স্থান পায় দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল বিবরণ, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, সাহিত্য, বিজ্ঞানসহ নানাবিধ ক্ষেত্রে পূর্বসূরিদের অবদান, বর্তমান সময়ে তার ধারাবাহিকতা ও অতীতের সফলতা-ব্যর্থতার নিরিখে উত্তরসূরিদের কল্যাণে ভবিষ্যতের কার্জকম ও প্রত্যাশা।
বর্ণিত উপাদানগুলো বিবেচনায় এনে প্রতিটি জাতির সঠিক ইতিহাস রচনা ও তার সহজলভ্যতার গুরুত্ব অনুধাবন করা কোনো কষ্টসাধ্য বিষয় নয়। তবে জাতিকে ইতিহাসে নথিভুক্ত তথ্যাদি থেকে উপকৃত হতে হলে তা হতে হবে নির্জলা ও নির্ভেজাল সত্য। অসত্য, মিথ্যাচার ও বিকৃত ইতিহাস কেবল মঙ্গল ও সমৃদ্ধি তিরোহিতই করে না, এই কদর্য প্রক্রিয়া পুরো জাতিকে অকল্যাণ ও দেউলিয়াত্বের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে।
এ কথা অবিশ্বাস্য ও বেদনাদায়ক হলেও অনস্বীকার্য, আমরা জাতি হিসেবে মানবসভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত ইতিহাসের প্রকৃত সংজ্ঞা সজ্ঞানে ও সুপরিকল্পিতভাবে আমূল পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছি। স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পর থেকে আজ অবধি ক্ষমতাসীন সব শাসক গোষ্ঠী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা জাতীয় জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই দলীয় এবং গোষ্ঠীর প্রয়োজনে ও সুবিধার্থে ধারাবাহিকভাবে সত্য ঘটনাকে দুমড়েমুচড়ে ভূলুণ্ঠিত করে ইতিহাসকে আপন সাজে সাজিয়েছেন। ব্যক্তি, পরিবার, সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বৃহত্তর সমাজসহ পুরো জাতি তাই আজ মিথ্যার আবরণে আচ্ছাদিত। বইপুস্তক, নথিপত্র, ইতিহাসের পাতা যেন সত্যকথনকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে মিথ্যাকে আলিঙ্গন করার এক সর্বনাশা প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তাই অনতিবিলম্বে মিথ্যাচার ও ইতিহাস বিকৃতির সংমিশ্রণের এই বিপদাশঙ্কাপূর্ণ প্রবণতা সমূলে উৎপাটনে ব্যর্থ হলে, জাতি শুধু এক অপ্রতিরোধ্য অবক্ষয়ের দিকেই ধাবিত হবে না, অদূর ভবিষ্যতে মুখ থুবড়ে পড়ে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে।
সুশীল পাঠক ও সচেতন নাগরিকদের স্মরণার্থে, দেশের সব প্রান্তে ও সব স্তরে মিথ্যাচার এবং ইতিহাস বিকৃতির ভয়াল থাবায় ক্ষত-বিক্ষত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের কিছু খণ্ডচিত্র তুলে ধরছি-
১. বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সম্মুখকাতারে অংশগ্রহণকারী ভাষাসৈনিকদের নির্ভুল তালিকা তৈরিতে প্রতারণার আশ্রয়।
২. স্বাধীনতাযুদ্ধের ত্রুটিপূর্ণ প্রেক্ষাপট বর্ণনা এবং প্রকৃত মুক্তিযাদ্ধা ও প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতাবিরোধী কার্র্যক্রমে জড়িত ব্যক্তিদের বিভিন্ন সরকার আমলে ভ্রান্ত ও ঘনঘন তালিকা প্রণয়ন। অসংখ্য প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র ও সরকার ঘোষিত সুবিধাদি থেকে বঞ্চিত করে বিপুল অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ভুয়া সার্টিফিকেট বিতরণ।
৩. দলীয় বিবেচনায় যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযাদ্ধাসহ দেশব্যাপী নিহত ও আহত গণমানুষের বিভিন্ন সময় একাধিক সরকার কর্তৃক দুরভিসন্ধিমূলক সংখ্যা নিরূপণ।
৪. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যপুস্তকে কিংবদন্তি ও দেশবরেণ্য সব ব্যক্তির কীর্তিগাথার পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জীবনকাহিনী অন্তর্ভুক্তকরণ।
৫. অর্থনীতির ক্ষেত্রে অজ¯্র উন্নয়ন প্রকল্পের আকাশচুম্বী ক্রমবর্ধমান ব্যয় সম্পর্কিত অসত্য তথ্য প্রচার এবং সর্বজনবিদিত অবিরাম ও নজিরবিহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে গ্রহণযোগ্য প্রমাণাদির অনুপস্থিতিতে কার্যকর ও দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে এ যাবৎ সব সরকারের অপারগতা।
৬. বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন রাষ্ট্র্রের সাথে অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষাসহ নানাবিধ ক্ষেত্রে সম্পাদিত চুক্তি সম্পর্কে সব সরকারের আমলেই অসত্য তথ্য প্রচার ও দেশের জনগণ, এমনকি জাতীয় সংসদ থেকেও তা গোপন রাখা।
৭. সংবিধানে প্রতিশ্রুত জাতীয় সংসদসহ সব পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে অবাধ, নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীন নির্বাচনের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে, বল প্রয়োগ, কারচুপি ও তথ্য বিকৃতির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সব রাজনৈতিক দল কর্তৃক প্রহসনমূলক নির্বাচনকে এক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও রীতিতে পরিণত করা।
উপরোল্লিখিত উদাহরণ ছাড়া এ প্রকার অগণিত লজ্জাকর ও বেদনাদায়ক দৃষ্টান্ত রয়েছে যা আমাদের দেশকে, দেশের নেতৃত্বকে, তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও সুশীলসমাজ, তথা দেশের পুরো জনগোষ্ঠীকে পৃথিবীর সভ্য সমাজের কাছে শুধু হেয়প্রতিপন্নই করেনি, অকুতোভয়, অসম সাহসী এক মুক্তিযাদ্ধা জাতিকে রূপান্তরিত করেছে এক ঘৃণিত জাতিতে। এ ক্ষোভ, এ যন্ত্রণা নিয়ে কোথায় গিয়ে লুকাই, কিভাবে মুছি এ গ্লানি?
তবে সঙ্কট যতই তীব্র আর জটিল হোক না কেন, তা সমাধানের পথ চিরকালই খোলা থাকে। প্রয়োজন কেবল ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠী ও দলের ঊর্ধ্বে উঠে নির্লোভ মানসিকতা নিয়ে শুধু দেশের স্বার্থ এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের কল্যাণের কথা মনে রেখে মীমাংসা ও প্রতিকারের উপায় সন্ধান করা। এ দেশে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ দক্ষ দেশপ্রেমিকের অভাব নেই। দেশের বর্তমান দুঃসময় ও ক্রান্তিলগ্ন অতিক্রম করার একমাত্র উপায় ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন সব নেতাকে একত্রিত হয়ে দেশবরেণ্য উপরে বর্ণিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে পরামর্শক কমিটি তৈরি করে তাদের সুপারিশ অনুযায়ী দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
এ কর্মসূচি গ্রহণেই স্বঘোষিত জনগণের সেবক, রাজনৈতিক নেতাদের অহরহ মুখে আওড়ানো স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস, দেশপ্রেম ও স্বাধীনতাযুদ্ধে লাখ লাখ আত্মাহুতি দেয়া প্রাণের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রমাণিত হবে, অন্যথায় আমাদের সবাইকে জনরোষের এক মহাবিস্ফোরণে ভস্মীভূত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা