২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাংলা সাহিত্যে অন্ধকার যুগ মিথ বনাম বাস্তবতা

উৎসের উচ্চারণ
-

(পঞ্চম কিস্তি)

যখন বলা হয় মুসলিম বিজয়ের পরে অন্ধকার নেমে এলো বলে বাংলা ভাষায় সাহিত্যসম্ভার পাওয়া যাচ্ছে না, তখন প্রশ্ন আসে, মুসলিম বিজয়ের আগে কেমন সাহিত্যসম্ভার ছিল?
আমরা দেখি, তখনকার প্রাপ্ত একমাত্র সাহিত্যিক নিদর্শন চর্যাপদ। বস্তুত তখন বাংলা সাহিত্য তো দূরের কথা, বাংলা ভাষার নিজস্ব অবয়বও সৃষ্টি হয়নি। চর্যা হচ্ছে বৌদ্ধসাধকদের কতগুলো প্রহেলিকাপূর্ণ পদ, যা প্রাচীনতম বাংলা ভাষার লক্ষণাক্রান্ত, এতে বাংলা ভাষার ধোঁয়াশাপূর্ণ আদিরূপ লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে কিছু পদ এমন, যার ধ্বনি, ব্যঞ্জনা ও চিত্রগৌরব মুহূর্তেই মন ও কল্পনাকে অধিকার করে। মুসলিম বিজয়ের মধ্য দিয়ে চর্যাপদ রচনা বন্ধ হয়, এ ধারণা ভুল। রাহুল সাংকৃত্যায়ন (১৮৯৩-১৯৬৩) তার ‘পুরাতাত্ত্বিক নিবন্ধাবলী’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, অষ্টম থেকে শুরু হয় এর রচনাধারা, দ্বাদশ শতকেও জারি থাকে। মুসলিম বিজয়ের পরও রচিত হয় কিছু চর্যা। এরপর বাংলা ভাষা নতুন রূপ ও প্রকাশরীতি লাভ করে। চর্যার যুগ অবসিত হয়। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৮৯০-১৯৭৭) তার ‘দ্য অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থে (১৯২৬) দ্বাদশ শতককে চর্যা রচনার সমাপ্তি ধরেছেন। প্রবোধচন্দ্র বাগচী (১৮৯৮-১৯৫৬) তার ‘দোহাকোষ’ গ্রন্থে একই অবস্থান ব্যক্ত করেছেন; দেখিয়েছেন চর্যা রচনার সীমা দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল থেকে চারখানা প্রাচীন পুঁথি আবিষ্কার করেন বলে আমরা চর্যাপদের সাথে পরিচিত হই। ২২ জন কবির ৪৬টি চর্যাগীতির প্রায় সবই মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত এবং অন্তঃমিলে বাঁধা, প্রতিটি গীত এক একটি বিশেষ বিশেষ রাগে গাওয়া হতো। চর্যার ভাষায় কোথাও শৌরসেনী অপভ্রংশের এবং কোথাও কোথাও মৈথিলীর প্রভাব সুস্পষ্ট। বাংলা হিসেবে একে শনাক্ত করা কঠিন। এর পঙ্ক্তিগুলো স্পষ্ট দেখায়, মুসলিম বিজয়ের আগে বাংলাভাষার লেখ্য ধরনটা আসলে কেমন ছিল। কাহ্নপাদের একটি চর্যা থেকে পাঠ করা যাক :
নগরবাহিরিরেঁ ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ।
ছোই ছোই জাহ্ন সো বাহ্ম নাড়িআ॥ ধ্রু

নগরের বাইরে ডোম্বী তোর কুঁড়েঘর
ছুয়ে ছুয়ে যাস নেড়ে ব্রাহ্মণদের।

আলো ডোম্বী তোএ সম করিব ম সাঙ্গ।
নিঘিণ কাহ্ন কাপালি জোই লাগ॥ ধ্রু

ওলো ডোমনী, আমি তোর সঙ্গে সাঙ্গা করব।
আমি ঘৃণাহীন এক নগ্ন, কাপালিক যোগী।

নবম শতক থেকে দ্বাদশ শতক; এতগুলো শতাব্দীর সাহিত্যিক ফসল হিসেবে বাংলা ভাষায় পাওয়া গেল চর্যার ৪৬টি পদ। পদগুলো এমন, যা বাংলা ভাষায় রচিত কি না, সে নিয়েও তর্ক রয়েছে। বাংলা ভাষার লক্ষণ তাতে খুঁজে বের করতে রীতিমতো গবেষণা করতে হয়েছে। এগুলো গীত হচ্ছিল রাজলাঞ্ছিত বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের পরিসরে, যারা কুঁড়েঘরে, বিজন পাহাড়ে, চাষের খেতে জীবনের লড়াই করছিল। তাদের প্রেয়সীদের দ্বারে ঘুরঘুর করত অভিজাত ব্রাহ্মণরা, যাদেরকে তারা ঘৃণা করতেন নেড়ে বলে! তাদের পদগুলোতে উপস্থাপিত জীবনের হাঁড়িতে ভাত নেই, সংসারে নিরাপত্তা নেই, ক্ষুধাতুর সন্তান আর নিত্য আশ্রয়কামী অতিথির আনাগোনা।
তখনকার বাংলাভাষী মানুষের জীবন যেন শিবজায়া পার্ব্বতীর দারিদ্র্যময় দুঃখব্যাকুল করুণ কান্নার মতো ছিল নিরুপায়। যে বলছিল -
বাল কুমারো ছঅ মু-ধারী, উবা অহীণা মুই এক্ক ণারী।
অহংণিসং খাই বিসং ভিখারী গঈ ভবিত্তী কিল কা হামারী।

ছয় মুন্ডধারী বালকপুত্র আমার ছয়মুখে খায়, আর আমি এক উপায়হীনা নারী! আমার ভিখারী স্বামী অহর্নিশ কেবল বিষ খায়; কী গতি হইবে আমার!
অপর দিকে সমাজের উঁচুশ্রেণীর জীবন ছিল ভোগে ও দাপটে রাজকীয়। সব সুযোগ-সুবিধার উপর দাঁড়িয়ে মুষ্টিমেয় ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রভুত্বের সুবিধা ভোগ করছিল। নিজেদের তারা দেখাচ্ছিল পূত-পবিত্র বলে, যেখানে অনেক ধন, অনেক স্ত্রী, অনেক ভৃত্য, এত এত ভোগ সুখ রেখে স্বর্গে যেতে চায় কোন বর্বর?
তাদের কাছে বাংলাভাষা ছিল পরিত্যক্ত, লাঞ্ছিত।
মুসলিম আগমনের আগের বাংলা ভাষার করুণ মুখের বিবরণ আমরা পাই ভাষাতাত্ত্বিক দীনেশচন্দ্র সেনের ভাষ্যে। তিনি লিখেন, ‘মুসলমান আগমনের পূর্বে বঙ্গভাষা কোনো কৃষক রমণীর ন্যায় দীনহীন বেশে পল্লী কুটিরে বাস করিতেছিল।’ ‘বাঙ্গলা ভাষা মুসলমান প্রভাবের পূর্বে অতীব অনাদর ও উপেক্ষায় বঙ্গীয় চাষার গানে কথঞ্চিত আত্মপ্রকাশ করিতেছিল।’
সমাজের উচ্চশ্রেণী, অভিজাত ব্রাহ্মণ ও শাসকবর্গ মগ্ন ছিলেন সংস্কৃত নিয়ে। সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছিল সংস্কৃত। তার জন্য বরাদ্দ ছিল পবিত্রতা। তার চর্চা ও অনুশীলন হচ্ছিল ধর্মকেন্দ্রে, রাজকেন্দ্রে, সাহিত্যপরিসরে, সমাজের অভিজাত ঘরানায়। দীনেশচন্দ্র সেন জানাচ্ছেন, পণ্ডিতরা নস্যাধার হইতে নস্য গ্রহণ করিয়া শিখা দোলাইয়া সংস্কৃত শ্লোকের আবৃত্তি করিতেছিলেন এবং ‘তৈলাধার পাত্র’ কিংবা পাত্রাধার তৈল এই লইয়া ঘোর বিচারে প্রবৃত্ত ছিলেন।... সেখানে বঙ্গভাষার স্থান কোথায়?
না। এই বাংলায় বাংলা ভাষার স্থান ছিল না। সম্মান ছিল না। অধিকার ছিল না। তার সাথে চালানো হচ্ছিল নির্মম উপেক্ষা। সে ছিল তাচ্ছিল্যের শিকার, অনাদর, অবহেলার শিকার। দীনেশচন্দ্রের বিবরণী থেকে জানা যাক- ‘ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গভাষাকে পণ্ডিতমণ্ডলী ‘দূর দূর’ করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাড়ি-ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দূরে থাকেন বঙ্গভাষা তেমনই সুধী সমাজের অপাঙ্ক্তেয় ছিল-তেমনি ঘৃণা, অনাদর ও উপেক্ষার পাত্র ছিল।’
বাংলা ভাষা প্রধানত জীবিত ছিল বৌদ্ধদের মুখে মুখে। সেন শাসনে তাদের ওপর দিয়ে বয়ে যায় দুঃসময়। বৌদ্ধ-হিন্দু সঙ্ঘাত চলে আসছিল বহু আগ থেকে। বৌদ্ধরা এতে পরাজিত হন। ব্রাহ্মণরা বৌদ্ধদের মঠগুলো ভেঙে ফেলে, বৌদ্ধদের রচিত সাহিত্যগুলো ধ্বংস করে। বাংলা ভাষার চর্চাকারী বৌদ্ধরা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অত্যাচারে টিকতে পারছিল না। তাদেরকে তাই বিজন পাহাড়ে দেখতে পাই, পলাতক জীবনে দেখতে পাই। এই সত্য প্রমাণিত হলেও ভূদেব-অসীতের বয়ানে তা অনুপস্থিত। মুসলিম বিজয়ের আগে চর্যার কিছু পঙ্ক্তি ছাড়া বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন নিশ্চিত করে পাওয়া যায় না। দীর্ঘ কাল ধরে কিছুই রচিত হয়নি। কিন্তু কেন? তখন কি ব্রাহ্মণ্যবাদী অত্যাচারের ভয়াবহতায় বাংলাভাষীদের পক্ষে সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব হয়নি?
সেনদের রাজভাষা ছিল সংস্কৃত। বাংলার চর্চা ছিল নিন্দিত। বাংলাভাষীদের আশীর্বাদ গ্রহণকেও শাস্ত্রমতে নিষিদ্ধ করা হয়। তাচ্ছিল্য করে বলা হয়-
আশীর্বাদং ন গৃহীয়াৎ পূর্ববঙ্গ নিবাসিনঃ
শতায়ুরিতি বক্তব্যে হতায়ুর্বদতি যতঃ
অর্থ হচ্ছে, পূর্ববঙ্গের লোকদের আশীর্বাদ গ্রহণ করো না। কারণ তারা শতায়ু বলতে গিয়ে হতায়ু বলে বসে। ঐতরেয় আরণ্যকে বাংলা ভাষাকে ইতর ভাষা হিসেবে দেখানো হয়। পাখির ভাষার মতো দুর্বোধ্য বলে একে আখ্যা দেয়া হয়।
বাংলা ভাষা তাদের চোখে এতই হেয় ছিল যে, এ ভাষায় আঠারোটি পুরাণ কিংবা রামের জীবনী পাঠ করলে, শুনলে নিশ্চিত হতো নরক। এমন বাংলাভাষীদের জন্য বরাদ্দ নরকের নাম ছিল রৌরব।
ধর্মের দোহাই দিয়ে বলা হতো -
অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানিচ।
ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ
অর্থাৎ আঠারোটি পুরাণ আর রামের জীবনচরিত দেশীয় ভাষায় শুনলে রৌরব নামক নরকে যেতে হবে। নরকে শাস্তির জন্য বাঙালিদের রৌরবে যাওয়া লাগত না। এ দেশই তাদের জন্য হয়ে উঠেছিল নরক। রাজসভায় আদর পেতেন সংস্কৃতের পণ্ডিত ও কবিরা। এ দেশে প্রধান পণ্ডিত তখন হলায়ূধ। লক্ষ্মণ সেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। যত দিন সেন শাসন ছিল, বাংলায় তিনি লেখেননি। তার কলমে বাংলা হাজির হলো, পরে-যখন অবসিত হয়েছে লক্ষ্মণ সেনের রাজত্ব। সে রাজত্বে প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী ছিলেন পুরোষতম, পশুপতি, ঈষাণ প্রমুখ। তারা বাংলাকে করতেন ঘৃণা, এর বিরুদ্ধে দেখাতেন পাণ্ডিত্য। এ দেশে প্রধান কবি তখন ধুয়ো, শরণ, গোবরধন, উমাপতি প্রমুখ। তারা বাংলা ভাষায় কবিতা লিখতেন না। লিখতেন সংস্কৃতে।
এই যখন বাস্তবতা, তখন ঘটল মুসলিম বিজয়। বাংলার কতটা জয় করলেন মুসলিমরা? বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘ বখ্খিলিজি বহুতর সৈন্য লইয়া বাঙ্গালা সম্পূর্ণরূপে জয় করিতে পারে নাই। বখ্খিলিজির পর সেনবংশীয় রাজগণ পূর্ব্ববাঙ্গালায় বিরাজ করিয়া অর্দ্ধেক বাঙ্গালা শাসন করিয়া আসিলেন। তাহার ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে। উত্তরবাঙ্গালা, দক্ষিণবাঙ্গালা, কোন অংশই বখ্খিলিজি জয় করিতে পারে নাই। লক্ষ্মণাবতী নগরী এবং তাহার পরিপার্শ্বস্থ প্রদেশ ভিন্ন বখ্খিলিজি সমস্ত সৈন্য লইয়াও কিছু জয় করিতে পারে নাই।’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : বাঙ্গালীর ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা, বঙ্গদর্শন, ১২৮৭, অগ্রহায়ণ।
এর মানে গোটা বাংলার একটি অংশমাত্র মুসলিম দখলে এসেছিল। বাঙালি অধ্যুষিত প্রধান অঞ্চলগুলো এ বিজয়ের আওতার বাইরে ছিল। অর্ধেক বাংলা শাসন করছিলেন সেন বংশীয় রাজারা, সেখানে জারি ছিল হিন্দু শাসন। সেই সব অঞ্চলে কেন সাহিত্যসম্ভার সৃজিত হয়নি? এ বিজয়ের আওতায় না থাকা বাঙালি প্রায় দেড় শত বছর ধরে কেন সাহিত্যসম্ভার উপহার দেয়নি? গৌড় জয় করে স্থিত হতে হতে মুসলমানদের অনেক সময় লাগে। রাঢ় বা বঙ্গ মুসলিমদের অধিকারে আসে অনেক বিলম্বে। সমস্ত বাংলা মুসলিম শাসনের অধীনে আসে প্রায় ১৫০ বছর পরে।
এই যে ১৫০ বছর, এ সময়ে রাঢ় ও বঙ্গের হিন্দু-বৌদ্ধরা কী এমন সাহিত্যিক নিদর্শন উপহার দিয়েছেন? তারা তো মুসলিম বিজয়ের কথিত ভয়াবহতার সম্মুখীন হননি। তাদের হাতে একটি শতাব্দী ধরে রচিত কোনো সাহিত্যিক নিদর্শন পাওয়া যায় না কেন? এ প্রশ্নের জবাব আমরা পাইনি অন্ধকার যুগের ভাষ্যকারদের তরফে।
কিন্তু আসলেই কি মুসলিম বিজয় বাংলা ভাষার জন্য খারাপ বার্তা নিয়ে এসেছিল? জবাব হচ্ছে, একদম না। এবং এর তফসিল শোনা যাক দীনেশচন্দ্র সেনের কাছ থেকে। তিনি লিখেন, ‘হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন জহুরীর আগমনের প্রতীক্ষা করে, শুক্তির ভিতর মুক্তা লুকাইয়া থাকিয়া যেরূপ ডুবুরীর অপেক্ষা করিয়া থাকে, বঙ্গভাষা তেমনই কোন শুভদিন, শুভক্ষণের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিল। মুসলমান বিজয় বাঙ্গলা ভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল। গৌড়দেশ মুসলমানগণের অধিকৃত হইয়া গেল। তাঁহারা ইরান-তুরান যে দেশ হইতেই আসুন না কেন, বঙ্গদেশ বিজয় করিয়া বাঙ্গালী সাজিলেন। আজ হিন্দুর নিকট বাঙ্গলাদেশ যেমন মাতৃভূমি, সেদিন হইতে মুসলমানের নিকট বাঙ্গলাদেশ তেমনই মাতৃভূমি হইল। তাঁহারা এদেশে আসিয়া দস্তুরমত এদেশবাসী হইয়া পড়িলেন। হিন্দুর নিকট বাঙ্গলা ভাষা যেমন আপনার, মুসলমানদের নিকট উহা তদপেক্ষা বেশী আপনার হইয়া পড়িল।’
বাংলার মুসলমান আগমনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের বিচার কেমন? বস্তুত সেনদের কাছ থেকে মুসলিম তুর্কিরা বাংলা দখল করলেন কূটনীতি শৌর্যবীর্য ও জ্ঞানগরিমার শ্রেষ্ঠত্বে। নির্যাতিত ও নিগৃহীত মানুষ মানুষের প্রাপ্য ইসলামী মর্যাদা পেল; সংস্কৃতের দৈব-আসন টলে গেল; ফারসি এসে তার স্থান দখল করল; আর বাংলা ভাষা ও সাহিত্য তার আপনভূমে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো। এ সময় বাংলার মানুষ নিজের সুখদুঃখের কাহিনী নিজের ভাষায় লেখেনি, কিংবা নিজের বিরহমিলনের গান নিজের কথায় রচনা করেনি; ড. মুহম্মদ এনামুল হকের মতে, ‘এমন একটা অদ্ভুত পরিস্থিতির কথা ভাবতেও পারা যায় না।’
আসলে কঠিন সময়ে সাহিত্য সৃষ্টি হতে পারে না, এ ধারণাটাই একটি বিভ্রম। কিন্তু মুসলিম শাসন কঠিন সময় নিয়ে আসেনি, বরং নিয়ে এসেছিল নিষ্কৃতি। মুসলিম শাসন এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে। অত্যাচারজর্জরিত ব্রাত্য মানুষ মুক্তির জন্য স্বাগত জানিয়েছে তুর্কিদের। বিজয় যখন সম্পন্ন হয়ে গেল, শাসন ও আচারের পর্বে এসে প্রকৃত বিজয় অর্জন করতে হলো বিজয়ীদের। তাদের রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার, ইসলামী মানবতা-ভ্রাতৃত্ব ইত্যাদির সৌহার্দ্যে স্থানীয়রা আশ্বস্ত হলো। এর সংস্পর্শে সঞ্জীবিত হলো। বিজয়ীরা সমাজের প্রাণপাতালে নিজেদের উপস্থিতি নিয়ে গেলেন, নতুন সাংস্কৃতিক বাস্তবতা তৈরি করলেন, যার ভাব ও প্রভাবে ব্রাহ্মণ্য একাধিপত্য অপসারিত হলো, তাদের কর্তৃত্ব দূরীভূত হতে থাকল। ভাষা ও সংস্কৃতি যে উচ্চবর্ণের পাথুরে পাচিলে আড়ষ্ট ছিল, তা দেয়াল ভেঙে গণস্তরে নিজস্ব বিকাশ অর্জন করল। ভাষায় এলো প্রাণাবেগ, সংস্কৃতিতে এলো প্রবাহ ও বিস্তার। সংস্কৃতির এই পালাবদল সাহিত্যে নিয়ে এলো রূপান্তর। ফলে অচিরেই আমরা দেখলাম, সাহিত্য ও চারুকলার পরিপোষক আবহাওয়া সৃষ্টিতে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে মুসলিম সালতানাত। স্থানীয়দের সৃজনশীলতাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে, সাংস্কৃতিক নবউন্মীলনকে প্রণোদিত করছে, নতুন গতিতে চিত্তবৃত্তির ধারায় সামাজিক মানসবদল ঘটছে, মানসগঠন হচ্ছে। ভাষা ও সাহিত্যে লাগছে এর দোলা। জাগছে নতুন দৃষ্টি ও সৃষ্টি, নতুন প্রাণ ও প্রণালী, নতুন স্থিতি ও বিস্তৃতি। এই পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম সংস্কৃতি এই মাটিতে প্রাথমিক অবস্থায় নিজের শেকড় ছড়িয়ে দেয়। সেই শেকড় আহরিত রসকে কাজে লাগায় প্রাণের অনুকূলে, জীবনের সুষ্ঠু বিকাশের অনুকূলে। ফলে মুসলিম সাংস্কৃতিক জীবনে একটি উর্বর জমি ও আদরশীল জলবায়ু লাভ করল এখানকার চিরলাঞ্ছিত মানুষ। তাদের বোধ-বিশ্বাস, জীবনের একান্ত যাপন এবং মন ও মানসের উচ্চারণে এই আবহাওয়া মোটেও প্রতিকূল ছিল না। ফলে মুসলিম সংস্কৃতি ও দেশীয় ঐতিহ্যের আত্মীয়তা নিশ্চিত হলো প্রাথমিক লগ্নেই। তৈরি হলো বোঝাপড়া ও সহাবস্থানের উদার পটভূমি, সংস্কৃতির নতুন বাতাবরণ। এই নববিকশিত সংস্কৃতির কেন্দ্রে ছিল স্থানীয় জীবনবাস্তবতা আর ইসলামী জীবনভেদ ও মানবতাবাদ।
যখন হিন্দু সমাজের গোঁড়াপন্থীদের ধর্ম প্রবাহে সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বাংলা ভাষায় শাস্ত্রজ্ঞান বিস্তারে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছিল, যখন শাস্ত্রানুবাদকারীদের নিগৃহীত করা হতো শাস্ত্রের নামে, তখন মুসলমান শাসকদের সান্নিধ্যের প্রভাবেই শাস্ত্রানুবাদ ও অন্যবিধ কাব্যচর্চা অবাধ হয়, মুক্তি লাভ করে। ইসলামের প্রভাব রোধ করার জন্য ব্রাহ্মণরা তাদের বিধিনিষেধ শিথিল করতে বাধ্য হয়। ফলে গোটা হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তনের সূচনা হয়। দেশীয় ভাষাকে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি হয়। সুতরাং অন্ধকার যুগ মুসলমানদের সৃষ্ট নয় বরং বাংলাভাষাকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার পণ্ডিতদের প্রচেষ্টার ফলে যে অন্ধকার যুগের সূচনা হয়েছিল, মাত্র দেড় শ’ বছরের মধ্যে সেই অন্ধকার যুগকে অপসারিত করে বাংলা চর্চার ফল্গুধারা সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিল এই মুসলিম শক্তি। মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়াতেই বাংলা সাহিত্য বিকাশের পথ সুগম হয়।
লেখক : কবি, গবেষক
71.alhafij@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement