২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

উন্নয়নের স্বার্থেই সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি

-

‘সুশাসন’ ও ‘জবাবদিহি’ একটি রাষ্ট্র বা জাতির উন্নয়নের পূর্বশর্ত। এই দুটো না থাকলে দেশ ও জাতির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে, এটিই স্বাভাবিক। আমরা যতই উন্নয়নের কথা বলি, সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে না পারলে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের দেশে সুশাসন ও জবাবদিহির ব্যবস্থা কতটা নিশ্চিত করা হয়েছে বা আদৌ আছে কি না, এ প্রশ্ন থেকেই যায়। যখন যে সরকারই ক্ষমতায় আসে, সেই সরকারের পক্ষ থেকে জোর গলায় বলা হয়, ‘আমরা বা আমাদের সরকার সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করবে’। এমনকি নির্বাচনী ইশতেহারেও এ কথাটি বলা হয়। পরে আর সে কথা মনে থাকে না। আর মনে থাকলেও এ বিষয়ে কোনো কথাই বলা হয় না।
প্রশাসনে জবাবদিহির ব্যবস্থা না থাকলে প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়বেÑ এটিই স্বাভাবিক। চেইন অব কমান্ড না থাকলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা যেমন ভেঙে পড়ে, পাশাপাশি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়। সেই সাথে দুর্নীতিও বেড়ে যায়। মনে রাখা দরকার, জনপ্রশাসন তত্ত্বের সাথে জবাবদিহির বিষয়টি সম্পর্কিত। জবাবদিহির ধরন ও জনপ্রশাসনের বিভিন্ন ধরনের উদ্বেগের মধ্যে সম্পর্ক আছে। বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ আরোপের মাধ্যমে এবং স্বনিয়ন্ত্রিত মূল্যবোধের প্ররোচনার মাধ্যমে জবাবদিহির প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। ক্ষমতা, বিচক্ষণতা, কর্মচারীর আচরণ নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া যেমনÑ নিয়ন্ত্রক, তদারকি, প্রভাব এবং পরিচালনা ও অন্যান্য অতিরিক্ত আমলাতান্ত্রিক মূল্যবোধ জবাবদিহি নিশ্চিত করে। তা না হলে দুর্নীতি ও দুর্নীতির সমস্যা এবং জনস্বার্থের সাথে সরকারি পদক্ষেপের অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। জবাবদিহি ছাড়া কোনো কাজেই স্বচ্ছতা আনা অসম্ভব। এর সাথে মানবাধিকারের বিষয়টিও জড়িত। জবাবদিহির একটি বড় বিষয় হলো দায়িত্ববোধ। জবাবদিহির ব্যবস্থা না থাকলে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা করা অস্বাভাবিক নয়। আর সুশাসন হলো ন্যায়নীতি অনুসারে উত্তমরূপে সুষ্ঠুভাবে ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেশ বা রাষ্ট্র প্রশাসন পরিচালনা। সুশাসন একটি কাক্সিক্ষত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতিফলন। সময়ের প্রয়োজনে ও শাসিতের সম্পর্কের ভিত্তিতে কোনো দেশের শাসন পদ্ধতির বিবর্তন হয়ে থাকে। শাসিতের কাম্য শুধু শাসন নয়; সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক শাসনÑ যাকে আমরা সুশাসন বলতে পারি। কোনো দেশে সুশাসন আছে কি না, তা বোঝার জন্য প্রথমে দেখতে হবে সে দেশে শাসকের বা সরকারের জবাবদিহি আছে কি না এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ প্রশাসন আছে কি না। সুশাসন একটি রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থাকে কাক্সিক্ষত উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছে দেয়। সুশাসনকে একপ্রকার মানদণ্ডও বলা যায়, যে মানদণ্ডের সাহায্যে একটি রাষ্ট্র বা সমাজের সামগ্রিক অবস্থা যাচাই করা যায়। যে রাষ্ট্র বা সমাজ যত বেশি সুশাসন দ্বারা পরিচালিত হয়, সেই রাষ্ট্র বা সমাজ তত বেশি অগ্রগতির দিকে ধাবিত হয়।
আমাদের দেশে সুশাসন ও জবাবদিহির যথেষ্ট অভাব রয়েছে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। যার ফলে ঘুষ-দুর্নীতি, অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা সর্বত্র লেগেই আছে। বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহি ও সুশাসন যেন উধাও হয়ে গেছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে যার মতো করে লুটপাট করে চলেছে, টাকার পাহাড় গড়ে তুলছে। আমরা যদি সরকারি ব্যাংকগুলোর দিকে তাকাই তা হলে কী দেখতে পাই?
ব্যাংকের তহবিল শূন্য, মূলধনের ঘাটতি। হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণখেলাপি, ঋণ আদায় ঠিকমতো হচ্ছে না। বেসরকারি ব্যাংকের কথা বাদই দিলাম। রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলোকে অনিয়ম ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে প্রতি বছরই মূলধন ঘাটতিতে পড়তে হচ্ছে। জনগণের করের টাকায় বাজেট থেকে সেই ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ নিয়ন্ত্রণের অভাবে চলছে লুটপাট। একেক জন শত শত কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়ে যাচ্ছে। যেমন বলা যেতে পারে, বেসিক ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার লুটপাটের কথা। ‘হলমার্ক’ নামের তথাকথিত একটি প্রতিষ্ঠান ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে হাত মিলিয়ে লুটে নেয়। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও একই অবস্থা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেই, নেই কোনো জবাবদিহির প্রশ্ন। সরকারের সেবা খাতগুলোতে সেবা পেতে গেলে অবশ্যই দুর্নীতিবাজদের সালামি দিতে হয়। আবার সালামি দিয়েও অনেক সময় সেবা পাওয়া যায় না।
গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির লাইন পেতে গেলেও বিশাল অঙ্কের সালামি দিতে হয়। প্রায়ই সংবাদপত্রের পাতায় দেখা যায়, একজন লাইনম্যান কোটি কোটি টাকার মালিক। ব্যাংক হিসাব তো অনেকগুলো, তার পর আবার বিছানার নিচে, বালিশের ভেতর টাকা রাখা হয়। একজন লাইনম্যানের একাধিক আলিশান বাড়ি আর দামি গাড়ি আছে। এক কথায় বলতে গেলে যেখানেই যান, ঘুষ ছাড়া কোনো কথা নেই। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবের কারণে লুটপাট বেড়েই চলছে। দেশে কালো টাকার ছড়াছড়ি। কোথা থেকে আসে এত টাকা? দুর্নীতিবিরোধী গবেষণা সংস্থা টিআইবি গত বছর বলেছিল, জিডিপির ১০ থেকে ৩৮ শতাংশের মধ্যে কালো টাকা ওঠানামা করে। সরকার প্রতি বছর জাতীয় বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখে। কিন্তু আশানুরূপ কালো টাকা সাদা হচ্ছে না। কালো টাকা যায় বিদেশের ব্যাংকে। প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর বা প্রতিষ্ঠান কী করছে? অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্যে বলেছেন, ‘অর্থপাচারকারীদের তালিকা তার কাছে নেই। তালিকা দিলে তিনি ব্যবস্থা নেবেন’। এ সম্পর্কে আর কিছু বলতে চাই না। প্রশাসনে জবাবদিহিতা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সÑ এসব কথা সরকারের পক্ষ থেকে জোর দিয়ে বলা হলেও তা কতটুকু কার্যকর হচ্ছে, এ প্রশ্ন থেকেই যায়।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনপ্রতিনিধি ও জনপ্রশাসকের সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করা একান্ত বিবেচ্য। রাজনৈতিক নেতৃত্বাধীন জনপ্রশাসকরা আনুগত্যশীল হবেনÑ এটিই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সুনির্দিষ্ট যোগ্যতার পরিচয় প্রদান একান্ত আবশ্যক। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হলে জনপ্রতিনিধি ও জনপ্রশাসকদের ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করা হয়। এতে করে স্বেচ্ছাচারিতাও থাকে না। গণতান্ত্রিক বিশ্বে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানেও তা পরিলক্ষিত হয়। সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধানের বিধানাবলিসাপেক্ষে সংসদ সদস্য আইনের দ্বারা প্রজাতন্ত্রের কর্মে কর্মচারীদের নিয়োগ ও কর্মের শর্তাবলি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।’ গণতন্ত্রের প্রকৃত শাসন হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আইন বা নীতি প্রণীত হয় সংসদে, তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকে জনপ্রশাসনের ওপর। নীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, সমন্বয় ও সরবরাহ করে থাকেন প্রশাসকরা।
লক্ষণীয় যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদ যেহেতু দলীয় সেহেতু নীতি নির্ধারিত হয়ে থাকে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু তার প্রয়োগকারীরা অর্থাৎ প্রশাসকরা থাকেন নিরপেক্ষ। তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন কার্যকর সংসদ এবং দক্ষ ও নির্দলীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা। একটির অভাবে অন্যটির কার্যক্রম কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। সরকারি কার্যক্রম বাস্তবায়নে চাই এ দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় ও সুসম্পর্ক, যা আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। আমাদের বাংলাদেশের মতো সীমিত সম্পদের দেশে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য এর প্রয়োজন আরো বেশি। কাজেই দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা খুবই জরুরি।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট।


আরো সংবাদ



premium cement