০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বাংলা ভাষায় ইংরেজি শব্দের ব্যবহার

-

আজকাল আমাদের লিখিত বাংলা ভাষায় ইংরেজি শব্দের বাহুল্য ব্যবহার একটি সমস্যার পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এটি বাংলা ভাষার ওপর নতুন বিপদ। এখনই সচেতন না হলে বিপর্যয় ঘটতে পারে। এক ভাষায় আর এক ভাষার শব্দ প্রবেশ নতুন কিছু নয়Ñ এটি কোনো দোষেরও নয়। ইংরেজি ভাষায় বিশ্বের বহু ভাষা থেকে শব্দ প্রবেশ করেছে। প্রাথমিক স্তরের ইংরেজি ভাষার (ইধংরপ ঊহমষরংয) শব্দ সংখ্যা মাত্র ৮৫০টি। কিন্তু বর্তমানে ইংরেজি ভাষার শব্দসম্ভার পাঁচ লাখের মতো। পৃথিবীর বহু দেশের বহু ভাষা থেকে বহু শব্দ প্রবেশের ফলেই এমনটি হয়েছে।
এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় শব্দ প্রবেশ করে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে। দুটি ভাষার লোক পাশাপাশি বসবাস করলে এক ভাষার শব্দ আরেক ভাষায় প্রবেশ করে। কোনো স্থানে কোনো একটি ভাষার লোকের প্রাধান্য থাকলে প্রধান জনগোষ্ঠীর ভাষার শব্দ গৌণ জনগোষ্ঠীর ভাষায় প্রবেশ করে। পরাধীন দেশের ভাষায় বিদেশী শাসকগোষ্ঠীর ভাষার শব্দ প্রবেশ করে। উন্নত ভাষার শব্দ অনুন্নত ভাষায় প্রবেশ করে। এগুলো হলো, এক ভাষার শব্দ আরেক ভাষায় প্রবেশের স্বাভাবিক নিয়ম। বাংলা ভাষায় আরবি শব্দ প্রবেশ করেছে স্বাভাবিক নিয়মে। আবার কৌশলে বা ইচ্ছাকৃতভাবেও এক ভাষার শব্দ আরেক ভাষায় প্রবেশ করানো হয়। যেমনÑ ইংরেজ আমলের শুরুতে বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দের ব্যাপক অনুপ্রবেশ। সংস্কৃত একটা মৃত ভাষা। মৃত ভাষার শব্দ স্বাভাবিক নিয়মে জীবিত ভাষায় প্রবেশ করে না। এভাবে জোর করে ঢোকানো বহু সংস্কৃত শব্দ এখন অচল। এদের ব্যবহার নেই বললেই চলে। এগুলো আমাদের বাংলা অভিধানের বোঝা হয়ে আছে।
আমাদের দেশ ইংরেজ শাসকদের অধীনে চলে যাওয়ার পর ইংরেজরা বাংলা ভাষাকে ‘আধুনিক’ করার একটি চেষ্টা চালায়। সংস্কৃত ভাষা জানা হিন্দু পণ্ডিত এ কাজে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেন। সেই সময়ের বাংলা ভাষা আরবি শব্দপ্রধান ভাষা ছিল। আরবি একটি জীবিত ভাষাÑ এই ভাষা মৃত ভাষা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। হিন্দু পণ্ডিতরা সুযোগ পেয়ে বাংলা ভাষা থেকে প্রতিষ্ঠিত ও বহুল ব্যবহৃত আরবি শব্দ বাদ দিয়ে সেখানে সংস্কৃত শব্দ ঢুকিয়ে দিয়ে বাংলা ভাষাকে আধুনিক করলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা ভাষায় বইপত্র (বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তক) লেখার জন্য সংস্কৃত ভাষাপ্রধান পারিভাষিক শব্দ সৃষ্টির একটা চেষ্টা চলে। এটি তেমন কার্যকর হয়নি। আমাদের লেখকরা সাহসের সাথে মূল ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেই বইপত্র লিখছেন। ইংরেজদের ২০০ বছর রাজত্বকালে হয়তো দুই শতাধিকের মতো ইংরেজি শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছিল। গত শতাব্দীর নব্বই দশকে যখন এ দেশে কম্পিউটার চালু হয় তখন কম্পিউটার শিক্ষার জন্য অনেক বইপত্র লেখা হয়। এ জন্য আমাদের লেখকরা সংস্কৃত ভাষার শব্দের ধার ধারেননি।
তবে এখানে একটি কথা বলে রাখছি, কেউ পছন্দ করুক বা না করুকÑ এখন বাংলা ভাষায় প্রধানত ইংরেজি শব্দই প্রবেশ করবে, এটা আমাদের গরজে এবং আমাদের প্রয়োজনে। ইংরেজ আমলে বাংলা ভাষায় সামান্য ইংরেজি শব্দ প্রবেশ করেছিল। কিন্তু এখন বাংলা ভাষায় ইংরেজি শব্দ প্রবেশ করছে বেশুমার এবং বিনা বাধায়। এখন নাকি তিন হাজার ইংরেজি শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ করে ফেলেছে। তবে কিছু লেখকের বেখেয়ালের কারণে অপ্রয়োজনীয় ইংরেজি শব্দের ব্যবহারের ফলে বাংলা ভাষার সৌন্দর্য ব্যাহত হচ্ছে। এ দেশে যারা লেখালেখি করেন তাদের প্রায় সবাই ইংরেজি ভাষা জানেন। তাদের কেউ কেউ বাংলা লিখতে গিয়ে (হয়তো বেখেয়ালে) বাংলা বাক্যে এমন ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে থাকেন যার বাংলা শব্দ আছে। এর ফলে বাংলা ভাষার সৌন্দর্য ব্যাহত হয়।
ক’দিন আগে নয়া দিগন্তের মাসিক পত্রিকা ‘অন্য দিগন্ত’ (সেপ্টেম্বর, ১৯ সংখ্যা) একটা নিবন্ধে অপ্রয়োজনীয় ইংরেজি শব্দের ব্যবহারের নমুনা পাঠকের সামনে তুলে ধরছিÑ ১. ‘একবার এক সোশ্যাল গ্যাদারিংয়ে আমার...’ [এখানে ‘সোশ্যাল গ্যাদারিং’ এর বদলে সামাজিক সমাবেশ লেখা যেত] ২. ‘আই থিঙ্ক আই অ্যাম ইন মিড লাইফ ক্রাইসিস’ [‘আমার মনে হচ্ছে আমি এখন পৌরত্বের বা মাঝ বয়সের সমস্যায় আছি’ লেখা যেত] ৩. ‘একই মুখ দেখতে দেখতে বোরড হয়ে গেছেন’ [এখানে ‘বোরড’ না লিখে ‘একঘেয়ে’ বোধ করছেন লেখা যেত] ৪. ‘ড্রাইভ করছি আর ভাবছি, মিড লাইফ ক্রাইসিস নিয়ে একটা শর্টপিস লিখলে কেমন হয়’ [‘ড্রাইভ’ এর বদলে ‘গাড়ি চালাচ্ছি’ এবং ‘শর্টপিস’ এর বদলে ‘ছোট আকারের লেখা’ লেখা যেত] ৫. ‘সে দারুণভাবে নস্টালজিয়ায় ভুগতে থাকে’ [‘নস্টালজিয়া’ এর বদলে বাড়িঘরের স্মৃতি যাতনা লেখা যেত] ৬. একই সময়ে মানুষের জীবনে আর একটা ‘সিনড্রোম’ দেখা দিতে পারে [এখানে ‘সিনড্রোম’ এর বদলে ‘দৃশ্যপট’ লেখা যেত] ৭. ‘কাজের ওভারলোডের কারণে’ [‘ওভারলোড’-এর বদলে ‘অতিরিক্ত চাপ’ লেখা যেত] ৮. ‘এটা হয়ে থাকে সেলফ অ্যাকচুয়েলাইজেশন, সেলফ রিয়েলাইজেশন, সেলফ ইভ্যালুয়েশন ইত্যাদির কারণে [এখানে ‘আত্মপ্রতিষ্ঠা’, ‘আত্মোপলব্ধি’, ‘আত্মমূল্যায়ন’ লেখা যেত] ৯. ‘মুসলিম দুনিয়ায় মিডলাইফ ক্রাইসিস সম্ভবত একটা ট্রিভিয়াল ইস্যু [‘ট্রিভিয়াল ইস্যু’-এর বদলে ‘একটা মামুলি বিষয় বা সমস্যা লেখা যেত]
দৈনিক পত্রিকায়ও এমন লেখা দেখা যায়। গত ২৭ অক্টোবর, ২০১৯ প্রকাশিত দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় একটি উপসম্পাদকীয় নিবন্ধে ৬০ বারের মতো বাংলা বাক্যে ইংরেজি শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। বহু ক্ষেত্রে বাহুল্য ব্যবহারÑ এটা দস্তুর মতো বিরক্তিকর মনে হয়েছে। সেই নিবন্ধে বাংলা বাক্যে ইংরেজি শব্দের কয়েকটি নমুনা ব্যবহার তুলে ধরছি : ১. অভিযোগের ‘ফোকাস ছিল, কথিত মমতা-জামায়াত-জেএমবি চক্র (ফোকাসের বদলে লক্ষ্য বা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু লেখা যেত) ২. ‘টার্গেট’ ২০১৬ সালে কলকাতার রাজ্য নির্বাচনে মমতার তৃণমূলকে ক্ষমতা থেকে ফেল করানো (এখানে টার্গেটের বদলে লক্ষ্য বা নিশানা লেখা যেত) ৩. অভিযোগের ‘প্রপাগান্ডা’ ডালি সাজিয়ে ভারতে বলা হয়েছিলÑ (এখানে প্রপাগান্ডার বদলে প্রচারণা লেখা যেত) ৪. এখন জার্মানিতে বসে সরকারের বিরুদ্ধে ‘ভোকাল’ কাতরাচ্ছেÑ (ভোকালের বদলে সশব্দে লেখা যেত) ৫. বাংলাদেশে ‘লিগেল স্ট্যাটাসের দিক থেকে ইসকন এক বিদেশী এনজিওÑ (লিগেল স্ট্যাটাসের বদলে আইনগত মর্যাদা লেখা যেত)।
নিবন্ধটিতে বাংলা বাক্যে ইংরেজি শব্দের এমন ব্যবহার ৬০ বারের মতো করা হয়েছে। বাংলা বাক্যে ইংরেজি শব্দের এমন ব্যবহার না করলেও হতো। নিবন্ধে এত এবং অপ্রয়োজনীয় ইংরেজি শব্দের ব্যবহারের ফলে প্রবন্ধে বাংলা ভাষার সৌন্দর্য ব্যাহত হয়েছে। প্রবন্ধকার (গৌতম দাস) একজন ভালো কলাম লেখক। তিনি তার নিবন্ধে ১০০ বারের মতো আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহারও করেছেন। বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দও বিদেশী। কিন্তু বর্তমান বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি-ফারসি শব্দগুলো শুধু প্রতিষ্ঠিতই নয় বরং বহুল ব্যবহৃতও। এসব আরবি-ফারসি শব্দের কারণেই একসময় বাংলা ভাষা সাহিত্যচর্চার উপযোগী হয়েছিল।
এ দেশে ইংরেজদের ২০০ বছর শাসনকালে বাংলা ভাষায় ২০০ ইংরেজি শব্দও প্রবেশ করেনি। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকে প্রকাশিত বাংলা অভিধান দেখলেই এ কথার সত্যতা বোঝা যাবে। কিন্তু গত শতাব্দীর কয়েক দশকেই বাংলা ভাষায় তিন হাজার ইংরেজি শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে। এ তথ্য বাংলা একাডেমি প্রকাশিত একটি বিশেষ অভিধান থেকে জানা গেল। সেই অভিধান ঘেঁটে দেখেছি। বেশির ভাগ শব্দই অপ্রয়োজনীয়। কোনো শব্দ কারো দ্বারা দু’য়েকবার বাংলা বাক্যে ব্যবহার হলেই এটি ‘বাংলা ভাষার শব্দ’ হয়ে যায় না। কোনো শব্দ অনেকের দ্বারা ব্যবহৃত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হলেই সেই শব্দ অভিধানে প্রবেশের অধিকার লাভ করে। একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ইংরেজির অধ্যাপক তার এক বাংলা নিবন্ধে লিখলেনÑ ... এ বিষয়ে পর্যাপ্ত ‘ডিসকোর্স’ হওয়া উচিত। এই একবার ব্যবহারেই কি ‘ডিসকোর্স’ শব্দটি বাংলা শব্দ হয়ে গেল! ‘ডিসকোর্স’ শব্দটির বদলে ‘আলাপ-আলোচনা’ লেখা যেত। বাংলা বাক্যে ‘ডিসকোর্স শব্দটি ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন ছিল না। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়। এখানে সেখানে ছাত্রছাত্রীদের জটলা। চলার পথে হঠাৎ শোনা গেলÑ এই বদি (মানে বদিউজ্জামান) কোন সাবজেক্টে চান্স পেলি রে? আর বলিস না, বহু স্ট্রাগল করে ফিলোসফিতে চান্স পেয়েছি। বলিস কি রে! ফিলোসফি? ফিলোসফির মতো রাবিশ সাবজেক্টে কেউ পড়ে? আরে থাম, এটাও হতো না। লাকিলি আমার আঙ্কেলের এক ওল্ড ফ্রেন্ড ডিপার্টমেন্টের হেড। তাই ইজিলি হয়ে গেছে আর কি। নইলে মার্ডার হয়ে যেতাম। সেন্সকৃট পড়তে হতো!
এই কয় ছত্রেই বাংলা কথায় ১৮ বার ইংরেজি শব্দের ব্যবহার হয়ে গেছে। বাংলা ভাষায় ইংরেজি শব্দের এমন ব্যবহার মাঠে-ঘাটে, গাছতলায়, আড্ডাখানায় চলতে পারে। কিন্তু যা লাখো লোকে পাঠ করবে এমন মাধ্যমে অর্থাৎ সংবাদপত্রে চলতে পারে না। তা হলে এ ধরনের অপব্যবহার দ্রুত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে এবং আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা একটা ইতর ভাষার রূপ লাভ করবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ফলে বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলা ভাষার দেখভাল করার দায়িত্ব বাংলা একাডেমির। তবে বাংলা দৈনিক পত্রিকাগুলোর দায়িত্ব অনেক বেশি। বাংলা পত্রিকাগুলো দৈনিক লাখো পাঠক পড়ে। ফলে শব্দের একটি অপব্যবহারও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তাই সম্পাদকমণ্ডলীর খেয়াল রাখা অনেক বেশি জরুরি। সাধারণ পাঠককে সচেতন করার জন্যই নিবন্ধ লিখা। বাংলা ভাষায় ইংরেজি শব্দ ব্যবহারে নীতিমালা হবেÑ যেখানে বাংলা শব্দ আছে সেখানে বাংলা শব্দই ব্যবহার করতে হবে। যেখানে বাংলা শব্দ নেই সেখানেই শুধু ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা যেতে পারে। হ


আরো সংবাদ



premium cement
ট্রাম্পের সাথে যা ঘটেছিল পর্ন তারকা স্টর্মির মধ্য বয়স থেকে যে অভ্যাসগুলো আপনার আয়ু বাড়াবে শাল্লায় ২ চেয়ারম্যান সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, কারাগারে ৪ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে যুক্তরাজ্যের এফসিডিও'র ইন্দো-প্যাসিফিক প্রতিমন্ত্রীর সাক্ষাৎ রাফায় ইসরাইলকে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে হবে : রাশিয়া মিরসরাইয়ে জাল ভোট, ৩ নির্বাচনী কর্মকর্তা আটক উপজেলা নির্বাচনের কেন্দ্রগুলো খাঁ খাঁ করছে : মেজর হাফিজ হজযাত্রীদের জীবন আল্লাহর রাস্তায় উজাড় করে দিতে হবে : জামায়াত আমির ডলারের দাম ৭ টাকা বাড়াল বাংলাদেশ ব্যাংক চুয়াডাঙ্গায় নির্বাচনে আটক ৩, প্যানেল চেয়ারম্যানের কারাদণ্ড নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের গ্রুপে খেলবে স্কটল্যান্ড

সকল