৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


আমরা তো এমন দেশ চাইনি

-

‘প্রজেক্ট’ যত, দুর্নীতি তত। আমাদের জাতীয় চরিত্র এত নিচে নেমেছে যে, বিদেশীরা আমাদের ঘুষখোর জাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনের মূল কথা এটি। বর্তমান সরকারের আমলে দুর্নীতি যে শুধু মহামারী আকার ধারণ করেছে তা নয়, রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা আছেন, তাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এ দুর্নীতি পৌঁছে গেছে। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ প্রথম শ্রেণীর একটি জাতীয় দৈনিকের শীর্ষ নিউজ ছিলÑ হাত দিলেই টাকার খনি। তিন বছরে দুই ভাইয়ের ৩০ বাড়ি, হকার থেকে সিনেমা প্রযোজক, ২৫ যুবলীগ নেতা পলাতক। ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে চলছে ক্যাসিনো বাণিজ্য। আওয়ামী লীগ কমিটিতে এক পরিবারের ১৭ জন ক্যাসিনো বাণিজ্যে জড়িত। যুবলীগ পিয়ন থেকে ধনাঢ্য। আওয়ামী যুবলীগ অফিসের পিয়ন থেকে দফতর সম্পাদক বনে যাওয়া ধনাঢ্য কাজী আনিসুর রহমান সম্পর্কে নানা মহলে মুখরোচক আলোচনা হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার পর তিনি একাধিক বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট দোকান ও জমির মালিক হয়েছেন। ক্যাসিনো ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ধরপাকড় শুরুর পর ২২ সেপ্টেম্বর রোববার থেকে তিনি লাপাত্তা। কোটিপতি আনিস যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী ছাড়া কাউকে পরোয়া করতেন না। এ আনিসের কাছেই থাকত যুবলীগের সব লেনদেনের খাতা। পিয়ন থেকে সাত বছরে হয়ে যান যুবলীগের দফতর সম্পাদক। মাসিক পাঁচ হাজার টাকার পিয়ন আনিস এখন কোটি কোটি টাকার মালিকই নয়, অনেকটা আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মতো ঘটনা।
আমাদের দেশে মানুষ দেখছে প্রতি বছর নতুন নতুন প্রজেক্টের উদ্বোধন হয়। প্রকল্পের খবর নেই কিন্তু শত শত কোটি টাকা রঙ-বেরঙের ফেস্টুন, বিলবোর্ড, সভা সমিতি আয়োজনে এবং মিডিয়ায় এর প্রচার সারাক্ষণ চলতে থাকে। মনে হয়, সরকার অনেক কাজ করে ফেলেছে। আমাদের দেশে ক’দিন পরপর যেভাবে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়Ñ সেটি অন্য দেশে দেখা যায় না। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ আরম্ভ করা হয় এবং তা নজরদারি রাখা হয় সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা দিয়ে। সেখানে অডিট রিপোর্ট দেখে বিল পেমেন্ট করা হয়। যেভাবে টেন্ডারে কাজ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেভাবে যদি কাজ সম্পন্ন করা না হয়, তা হলে চূড়ান্ত পেমেন্ট বন্ধ করে দেয়া হয়। আমাদের দেশে একই পদ্ধতি কথা লেখা থাকলেও নির্মাণ খাতে গুণগত মান বজায় রাখা হয় না। ফলে কিছু দিন পর সড়কপথে নির্মাণ-পূর্ব অবস্থায় ফিরে আসে এবং জনদুর্ভোগ বেড়ে যায়। পাশাপাশি দুর্ঘটনা মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে যায়। যারা দেশসেবার কথা বলে ক্ষমতায় আসেনÑ তারা মূলত নিজের সেবায় ব্যস্ত থাকেন। ৪৮ বছর ধরে আমরা এ দৃশ্য অবলোকন করে আসছি। লক্ষণীয় যে, ৫৬ হাজার বর্গমাইল বেষ্টিত বাংলাদেশে নি¤œ আয়ের মানুষেরা টাকার অভাবে সংসার চালাতে পারছে না, আরেক দিকে পদ্মা নদীর করালগ্রাসে ভূমিহারা হচ্ছেন শত শত মানুষ। অন্য দিকে দলীয় সরকারের উচ্চপদস্থ মানুষগুলো শত শত কোটি টাকা লুটপাট করছে। আমরা মনে করি, নিত্যনতুন প্রজেক্ট খাতে ব্যয় লোকচক্ষুর অন্তরালে রেখে সৎ মানুষ বেছে বেছে টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ বণ্টন করা উচিত। পরিকল্পনামন্ত্রী ২৯ সেপ্টেম্বর এক কর্মশালায় বলেছেন, ৭০ ভাগ প্রকল্প যথাসময়ে শেষ হয় না শুনে ব্যথা পাই। দলীয়ভাবে কাজ করলে অর্থ লুটপাট হবে এবং সেই নির্মিত প্রজেক্ট টেকসই হবে নাÑ উল্টো জনদুর্ভোগ আরো বাড়বে। সম্প্রতি ক্যাসিনো ব্যবসা নিয়ে মুখ খুললেন মেনন। ২৮ সেপ্টেম্বর খুলনায় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে মেনন বলেন, ১০ বছরে ৯ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আওয়ামী লীগের শাসনামলেই এসব কালো টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। এই পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনা এবং তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে। এটা করতে না পারলে আমও যাবে ছালাও যাবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের অর্থনীতি ভিত্তি আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। নির্বাহী প্রধান সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বলেছেনÑ প্রবাসীরা যেন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেন এবং রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশকে স্বনির্ভর দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ভূমিকার কথাও বললেন। কিন্তু প্রশ্ন হলোÑ মানুষ টাকা পাঠাবে এবং শিল্পে বিনিয়োগ করবে। কিন্তু দুর্নীতি ঠেকাতে না পারলে দেশ আবার তলাবিহীন ঝুড়ির দেশে পরিণত হবে এ কথা আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন। ৩০ তারিখে বাংলাদেশ প্রতিদিনে দু’জন ব্যক্তির বক্তব্য প্রকাশ হয়েছেÑ তারা বলেছেন, এই সরকারের আমলে সবেচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে নারী-শিশু এবং নদী। এ কথা বলেছেন বিশিষ্ট কলাম লেখক আবুল মকসুদ। আরেকজনের নাম মেজর জেনারেল এ কে মো: আলি শিকদার। তার নিবন্ধে লিখেছেন ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি আওয়াজ চারিদিকে। এ দু’জনই আওয়ামী ঘরানার মানুষ। আওয়ামী ঘরানার লোকজন মুখ খুলতে শুরু করেছেন। সত্য বেরিয়ে আসছে। ৩০ সেপ্টেম্বর বাজারে গিয়ে দেখলামÑ পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৩০ টাকা বেড়ে গেছে। এখন ১০০ টাকা করে প্রতি কেজি পেঁয়াজ কিনতে হবে। প্রতিটি ডিমের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। শাকসবজিসহ এমন কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস নেই যার দাম বাড়েনি। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে জি কে শামীম একাই নাকি মাসে ক্ষমতাধরদের মধ্যে ২৫ কোটি টাকা বিতরণ করত। বর্তমানে ঝিনাইদহ গণপূর্ত বিভাগ দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে সরকারি বিভিন্ন দফতর বাসভবন মেরামত ও উন্নয়নমূলক কাজ না করেই ভুয়া বিলভাউচার দাখিল করে প্রায় ১০ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে জনগণের শাসন প্রয়োজন। সেটি এখন নেই। তাই লংটার্মের বিনিয়োগের জন্য দেশে গণতন্ত্র এবং অর্থতন্ত্রের ব্যাপক আকারে সুশাসন প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। আসলে আজকের যে বাংলাদেশ, সে বাংলাদেশ তো আমরা চাইনি। হ
লেখক : গ্রন্থকার
E-M.harunrashidar@gmil.com

 


আরো সংবাদ



premium cement