০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`


মায়েদের ভালো থাকা

-

এক মায়ের কথা বলছি, সে মা একজন ভালো মা, আদর্শ মা। তিনি একাধারে চাকরি করতেন একটি কলেজে, ছিলেন ভালো শিক্ষক, একজন অতি উন্নত গুণের অধিকারী অধ্যক্ষও ছিলেন। ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে কর্মকর্তা ও কর্মচারী, এমনকি তার নিজের বাড়ির ও শ্বশুরবাড়ির সবার কাছেই ছিলেন একজন আদর্শ। দেশের জন্যও ছিলেন একজন আদর্শ নাগরিক। তিনি সুযোগ পেলেই দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে সমাজ সেবা করতেন। এতিমখানায় গিয়ে শিশুদের খাবার দিতেন সামাজিক ও ধর্মীয় দিনগুলোতে। এতিমদের সাথে গল্প করতেন, উৎসাহ দিতেন বড় হওয়ার। ওরা তাকে ‘বড় মা’ বলে ডাকত। দেশে কোনো দুর্যোগ দেখা দিলে ছুটে যেতেন এবং সাধ্যমতো চাঁদা সংগ্রহ করে দুর্যোগ মোকাবেলা করতে সহায়তা করতেন।
ওই মা আমার চেনা জানা এবং কাছের মানুষ ছিলেন। তার জীবনের একটি ঘটনা জানি। তিনি একদিন ছুটির দিনে রান্নার ফাঁকে একমাত্র ছেলেকে সামান্য কিছু নাশতা দেয়ার জন্য এবং তার ছেলেটি নিজের রুমে ঠিক পড়ালেখা করছে কি না, দেখতে গেলেন। দেখলেন ছেলেটি খবরের কাগজ পড়ছে, কিন্তু তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে তো পড়ছেই। মা জানতে চাইলেন ‘কী হয়েছে বাবা, তোমার’? ছেলেটি খবরের কাগজ মায়ের হাতে দিয়ে বললÑ ‘দেখ, বৃদ্ধাশ্রমে মায়েরা ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে কত ভালো ভালো মিথ্যা কথা বলেন, যা সাংবাদিকেরা ধরে ফেলেছেন।’ খবরটি মা পড়লেন এবং জানতে পারলেন, মায়েরা তাদের সন্তানদের কোনো দোষ-ত্রুটি সাংবাদিকদের কাছে উপস্থাপন করেননি; বরং বলেছেন ‘ওরা সব সময় আমাকে ওদের কাছে রাখতে চায়। এখানেও আমার দেখাশুনা করে, বাসায় নিয়ে যায়, খাবার কিনে দেয়, নানা জায়গায় ঘুরিয়ে আনে,’ আরো কত কি! সাংবাদিকেরা গোপনে সঠিক খবর জেনে নিয়ে তা লিখেছেন। ছেলেটি ওর মাকে বলল, ‘মা, আমি এমন ছেলে হবো না। তোমাকে আমার সাথেই রাখব, প্রয়োজনে ভিক্ষে করে হলেও তোমায় নিয়ে রাস্তার পাশের বস্তিতে বাস করব’। সে ছেলেকে রাস্তার পাশে আশ্রয় নিতে হয়নি; বরং আলিশান ফ্ল্যাটে তার বসবাস, বড় চাকরি, বড় ঘরের মেয়েকে বৌ করে আনাÑ এসবই সম্ভব হয়েছে।
একদিন আমার এক বান্ধবীর আগ্রহে ঢাকার আগারগাঁওয়ে বৃদ্ধাশ্রম দেখতে গেলাম। এ বান্ধবী প্রায় ২৬ বছর বিদেশে ছিলেন। তার একমাত্র ছেলে ওই দেশের মেয়ের সাথে লিভটুগেদার করছে। তারা নাকি বিয়েও করবে না, সন্তানও নেবে না। বান্ধবীটি চিরদিনের জন্য দেশে চলে এসেছেন এবং ভাবছেন, জীবনের শেষ দিনগুলো কিভাবে কাটবে। এই জন্যই বৃদ্ধাশ্রমের খোঁজ নেয়া। ঘুরে ঘুরে আগারগাঁওয়ের বৃদ্ধাশ্রমটা দেখছি। হঠাৎ দেখলাম সেই মাকে, যার ছেলে খবরের কাগজ পড়ে চোখের পানি ফেলেছিল। জানতে চাইলাম ‘আপনি এখানে? আপনার ছেলে কোথায় আপা, বিদেশে’? তিনি বললেন ‘না, দেশেই। আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু হলো স্বাধীনতা, তাই নিজের মতো করে আছি, ভালোই আছি’। বলতে বলতে দু’চোখের পানি ছেড়ে দিলেন যেমন খবরের কাগজ পড়ে চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছিল তার সাত রাজারধন ছেলেটি।হ
লেখক : প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement