২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিপর্যয়

মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিপর্যয় - ফাইল ছবি

বৈশ্বিক রাজনীতিতে কূটনীতির অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কূটনীতি বলতে আমরা বুঝি রাজনীতিতে কৌশলগত অবস্থান নিয়ে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করা। অন্য দিকে বিজাতীয়রা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিথ্যা ও অপকৌশলের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান ও বিজয়কে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যে কৌশল গ্রহণ করে তাকে কূটনীতি নামে আখ্যায়িত করে। মুসলিম জাতি বর্তমানে রাজনৈতিক সচেতনতায় ও কূটনীতিতে বিপর্যস্ত। মহানবী সা: মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি করেছিলেন। যে কারণে তার সহচররা সমসাময়িক কালের দুই পরাশক্তি পারস্য ও রোমান শক্তিকে মোকাবেলা ও পর্যুদস্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কূটনৈতিক কৌশলেও মহানবী ছিলেন অনন্য। তিনি বিভিন্ন সময়ে কুরাইশদের কূটনৈতিক কৌশলে পরাস্ত করেছেন।

বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে রাজনৈতিক সচেতনতার খুব অভাব। মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ মুসলিম রাষ্ট্রে প্রাচীন পদ্ধতির রাজতান্ত্রিক সরকার অথবা স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা চালু আছে। এ সব দেশের জনসাধারণের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে দেশের শাসকরা নাগরিকদের ওপর একচেটিয়া শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে রেখেছেন। আমরা জানি, খোলাফায়ে রাশেদার যুগের সরকার পদ্ধতিতে জনসাধারণ খোলামেলা বাকস্বাধীনতা ভোগ করতেন। তারা নির্দ্বিধায় খলিফা বা শাসকের সামনে তার কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করা ও জবাবদিহির অধিকার রাখতেন। যে কারণে সে সময়ের মুসলিম রাষ্ট্রের জনসাধারণ সর্বোচ্চ নাগরিক সুবিধা ভোগ করতেন। ফলে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটেছিল।

বর্তমানে বেশির ভাগ মুসলিম রাষ্ট্রের সরকার পদ্ধতির গৃহীত নীতিমালার সমালোচনা ও পর্যালোচনার অধিকার দেশের জনসাধারণ সংরক্ষণ করেন না। সে কারণে জনসাধারণের মধ্যে কাক্সিক্ষত মাত্রায় রাজনৈতিক সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। ফলে দেশের জনসাধারণের সাথে সরকারের সহযোগিতামূলক মনোভাবের বিকাশ ঘটেনি। যে কারণে সরকার অভ্যন্তরীণভাবে ও বৈদেশিক নীতিতে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে জনসাধারণ সে সব সিদ্ধান্তের প্রতি সহযোগিতা বা আন্তরিকতা প্রদর্শন করেন না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- ইরাক ও লিবিয়া যুদ্ধে বৈদেশিক শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে সে দেশের জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে সরকারকে সহযোগিতা করেননি। ফলে অতি সহজে বিদেশীরা যুদ্ধে জয়লাভ করে ও সে দেশের সম্পদরাজি লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। অথচ আমাদের দেশে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেশের জনসাধারণ রাজনৈতিক সচেতনতার চরম বিকাশ ঘটেছিল। যে কারণে দেশের জনসাধারণ মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিলেন। জনসাধারণের ঐক্যবদ্ধ শক্তি অতি সহজে শক্তিশালী পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করেছিল।

মিসর মধ্যপ্রাচ্যের এক শক্তিশালী দেশ। সে দেশের জনসাধারণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিরপেক্ষ ভোটের মাধ্যমে ২০১২ সালে ড. মো: মোরসিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেন। অথচ পশ্চিমা বিশ্বের চক্রান্তে অল্প দিনের মধ্যে মিসরের নিরপেক্ষভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। স্মরণযোগ্য যে, মিসর বিগত আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইলের কূটকৌশলের কাছে পর্যুদস্ত হয়েছিল। অদ্যাবধি মিসর ইসরাইলের সে কূটকৌশল থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইসরাইলও পশ্চিমা বিশ্বের ঘেরাটোপে এখনো এ দেশ ১৬০ মিলিয়ন ডলারে ঋণী হয়ে আছে।

আমরা জানি, মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব মুসলিম জাতিগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রসমূহের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিয়ে আছে। পবিত্র মসজিদুল হারাম সৌদি আরবে অবস্থিত, অপর দিকে সৌদি আরব অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যথেষ্ট শক্তিশালী। মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশটি সহজে পশ্চিমা বিশ্ব বা আমেরিকার বিরুদ্ধে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে পারে। অথচ সৌদি রাজপরিবার নিজেদের রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে আমেরিকার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে আছে। বর্তমানে আরব ইসরাইল চলমান যুদ্ধে কূটনৈতিকভাবে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো পর্যুদস্ত ও বিপর্যস্ত। আমেরিকা মুসলিম বিশ্বের নয়, পুরো পৃথিবীর মানবতা ও মানবাধিকারের শত্রু।

আমরা জানি, আমেরিকা কূটকৌশলে মধ্যপ্রাচ্যে ভাগ করো ও শাসন করার নীতি জিইয়ে রেখেছে। আমেরিকার প্ররোচনায় ইরাক ও ইরান দীর্ঘ ৮ বছর ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। অপর দিকে আমেরিকা শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব উসকে দিয়ে ইরান ও সৌদি আরব তথা সুন্নি মুসলিম জনগোষ্ঠীর সাথে দূরত্ব সৃষ্টি করে রেখেছে। অনেক দেরিতে হলেও ইরান ও সৌদি আরব ভুল বুঝতে পেরে পুরনো নীতি পরিত্যাগ করে নিজেদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকা বিরূপ মনোভাব পোষণ করেছে। বর্তমানে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনির মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধে আমেরিকা ইসরাইলকে মানবতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন করে অন্যায় ও নগ্নভাবে সহায়তা করে যাচ্ছে। ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ স্থায়ীভাবে বন্ধ করার প্রস্তাব আমেরিকা ভেটো শক্তি প্রয়োগ করে দুইবার বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ রাশিয়া চীন ও পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট প্রদান করেছিল। অতীব আশ্চর্যের বিষয়, আমরা জানি আমেরিকা- ফিলিস্তিন তথা মুসলিম বিশ্বের দুশমন। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলো সেই আমেরিকার মাধ্যমে কূটনৈতিকভাবে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের যুদ্ধের সমাধান করতে চাচ্ছে। এ যেন শৃগালের কাছে মুরগি বরগা দেয়ার সমতুল্য।

আমেরিকা একদিকে ইসরাইল-ফিলিস্তিনি যুদ্ধের সমাধান কামনা করছে, অপর দিকে ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের স্থায়ী যুদ্ধবিরতির বিরোধিতা করছে। অপর দিকে প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি নারী ও শিশু হত্যাকারী ইসরাইলি সেনাবাহিনীকে আমেরিকা বিনামূল্যে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র সরবরাহ করছে। আবার আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন অবিরত মধ্যপ্রাচ্য সফর করে ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ বন্ধের কৌশল নিয়ে আলোচনা করছেন। মুসলিম বিশ্বের শাসকরা আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ কূটনৈতিক মিশনকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করছেন। এ এক হাস্যকর পরিস্থিতি।

আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ওপর ইসরাইলের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে ও কূটনৈতিক কৌশলে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর দুর্বলতার সুযোগে বিভাজন তৈরি করছে। এ বিভাজিত রাষ্ট্রগুলোকে ক্রমান্বয়ে ইসরাইলির মিত্র রাষ্ট্র তৈরি করার আমেরিকান পলিসি অব্যাহত আছে। এ ক্ষেত্রে সে অনেকখানি সফলতা লাভ করেছে। সৌদি আরবকে ইসরাইলের সাথে সখ্যতা গড়ার জন্য আমেরিকা নানাভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ মুসলিম বিশ্ব তাদের প্রধান শত্রুর বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে অবিরত ঘুরপাক খাচ্ছে। মুসলিম বিশ্বকে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে নিজেদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। অন্যথায় বিজাতীয়দের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বিসর্জন দিতে হবে।

লেখক : অধ্যক্ষ ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement