০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫
`


কোনো এক সাঙ্কারার প্রতীক্ষায়

থমাস সাঙ্কারা - ফাইল ছবি

পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ, নাম বুর্কিনা ফাসো। এক লাখ পাঁচ হাজার ৯০০ বর্গমাইলের এই দেশটিই একসময় শোষিত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী ফ্রান্সের দ্বারা। তখন দেশটির নাম ছিল আপার ভোল্টা। ১৯৪৯ সালে এই ভূখণ্ডেই জন্ম নিয়েছিল এক কালজয়ী বিপ্লবী, নাম থমাস সাঙ্কারা। ১৯৬০ সালে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে স্বাধীনতা লাভের পর শাসক শ্রেণীর বিলাসিতা, শোষণ, দুর্নীতি আর ভূস্বামীদের দৌরাত্ম্য দারুণভাবে আঁচড় কেটেছিল সাঙ্কারার কিশোর মনে। তখনই তিনি সঙ্কল্প করেছিলেন সব কিছু বদলে দেয়ার। তাই তো যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে। ১৯৮৩ সাল, সাঙ্কারা তখন ক্যাপ্টেন। প্রচণ্ড এক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে হয়ে গেলেন আপার ভোল্টার প্রেসিডেন্ট, বয়স মাত্র ৩৩ বছর। ক্ষমতায় এসেই জাতিকে চমকে দিয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের বেতন ৪৫০ ডলার নির্ধারণ করলেন। কর্তন করলেন সব মন্ত্রী, পার্লামেন্ট মেম্বার ও সরকারি কর্মকর্তার বেতন। ব্যয় সঙ্কোচনের জন্য বিক্রি করে দিলেন সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা মার্সিডিজ বেঞ্চের বিশাল বহর। আর সরকারি কাজে বরাদ্দ দিলেন তৎকালীন বাজারের অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের গাড়ি। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে মন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের সব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিদেশে চিকিৎসা নেয়া নিষিদ্ধ করলেন। প্রতিষ্ঠা করলেন আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অবিস্মরণীয়ভাবে ২৫ লাখ শিশুকে বাতজ্বর, কালাজ্বর ও হামের টিকাদান সম্পন্ন করলেন। ১৯৮৪ সালে সাংবিধানিকভাবে দেশের নাম বদলে দিলেন। নতুন নামকরণ করা হলো- বুর্কিনা ফাসো, অর্থাৎ- সৎ মানুষের দেশ।

ভূস্বামীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সব জমি কেড়ে নিয়ে সাধারণ কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। তার দূরদর্শী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের ফলে হেক্টর প্রতি গমের উৎপাদন এক হাজার ৭০০ কেজি থেকে বেড়ে দাঁড়াল তিন হাজার ৮০০ কেজিতে। তিনি চার বছরে ১০ মিলিয়ন বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে সাহেল অঞ্চলসহ দেশকে মরুকরণের কবল থেকে বাঁচাতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ঠিক একইভাবে শিক্ষা বিস্তারে ৩৫০টি গোত্রকে একযোগে কাজে লাগিয়ে মাত্র চার বছরে সাক্ষরতার হার ১৩ থেকে ৭৩ শতাংশে উন্নীত করেন। জাতিকে স্বনির্ভর করতে সব বৈদেশিক ঋণ এবং বিশ্ব ব্যাংকের প্রস্তাবই বাতিল করে দিয়ে জাতির উদ্দেশে এক ঐতিহাসিক উক্তি করলেন- ‘যে তোমাদের খাওয়াবে, সেই তোমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে।’ তার এমন সব বুদ্ধিদীপ্ত, সাহসী ও সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্তের কারণে আর্থ-সামাজিকভাবে এগিয়ে যেতে থাকে দেশ। আর তিনি হয়ে ওঠেন জনতার অবিসংবাদিত নেতা।

এ দিকে একটি দিনের জন্যও থেমে থাকেনি ফরাসি-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত। তারা প্রতিনিয়ত উসকানি দিয়ে গেছে জাতিগত বিদ্রোহ ও সন্ত্রাসবাদে। সেগুলো তিনি সফলভাবে দমন করতে সক্ষমও হয়েছিলেন। সব কিছু বুঝেই তিনি আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য আফ্রিকাজুড়ে বৃহত্তর ঐক্যের ডাক দেন। আর মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন- ‘বিপ্লবীরা প্রত্যেকেই আলাদা সত্তা। মানুষকে হত্যা করা যায়, কিন্তু আদর্শকে হত্যা করা যায় না।’

মার্কিন, ফরাসি ও আইভরিকোস্টের সহায়তায় ১৯৮৭ সালে সাঙ্কারার প্রিয় ও বিশ্বস্ত বন্ধু ক্যাপ্টেন কম্পেওর তাকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে। ১৪টি বুলেট তার শরীরকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। মাত্র ৩৭ বছর বয়সেই পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেল স্বাধীন, স্বনির্ভর ও উন্নত দেশের স্বপ্নদ্রষ্টা টগবগে এক তারুণ্য।
ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী এই তরুণ বিপ্লবী তার জীবন ও কর্ম দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন, কারো চরিত্রে চারটি বৈশিষ্ট্য থাকলে সব কিছু বদলে দেয়া সম্ভব। আর তা হলো-

১. সঙ্কল্প; ২. সাহস; ৩. নৈতিকতা ও ৪. দেশপ্রেম,
যদিও নব্বই দশকের শেষের দিকেই সমাজতন্ত্র তার জন্মভূমিতেই একপ্রকার আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। আর অন্যান্য দেশে তার আবেদন হারিয়ে অকার্যকর রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে হিমঘরে চলে যায়। তবুও ব্যক্তি থমাস সাঙ্কারা বিশ্বব্যাপী তরুণদের মধ্যে রেখে যান সমাজ বিপ্লবের উন্মাদনা। সেই উন্মাদনা আজো দুর্বিনীত। পিনাকী ভট্টাচার্যের সময়ের আলোচিত এই উক্তি যেন সাঙ্কারার মতো বীরদের জন্যই রচিত হয়েছে- ‘মানুষ বিজয়ীকে মনে রাখে না, মনে রাখে বীরদের।’

নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের প্রতিটি মিছিলের জনপ্রিয় সোগান ছিল- ‘রুশ ভারত মার্কিন চীন, ফুরিয়ে গেছে তোদের দিন।’ বর্তমান বাস্তবতায় সেই সোগান আজ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ওদের দিন ফুরিয়ে যায়নি; বরং আরো আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে আমাদের। রাজনৈতিক সমস্যা বাংলাদেশে, বৈঠক বসে দিল্লিতে। নির্বাচন হয় বাংলাদেশে, পলিসি নির্ধারিত হয় দিল্লিতে। দেশের রাজধানী ঢাকা, অথচ কূটনৈতিক ব্রিফিং দেয়া হয় দিল্লিতে গিয়ে। এক পক্ষ দিল্লি গিয়ে আবেদন জানায়, ‘যেকোনো মূল্যে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে হবে।’ আরেক পক্ষ দরখাস্ত নিয়ে বসে থাকে আরো পশ্চিমে, ‘আমাদের জন্য কিছু একটা করো’। এ কেমন স্বাধীনতা? আজ শাসক শ্রেণীর বিলাসিতা, দুর্নীতি, অবিরত নির্লজ্জ মিথ্যাচার আর আইনের অপপ্রয়োগে বিক্ষুব্ধ ও দিশেহারা জাতি।

প্রচলিত ধারার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর রক্ষণাত্মক ও দুর্বল কৌশল আর প্রৌঢ় নেতৃত্বের গতিহীনতায় বীতশ্রদ্ধ ও আস্থাহীন হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ যার ফলে এখন দায়িত্ব এসে বর্তেছে তরুণদের ওপর। জাতির এই সঙ্কটকালে সাহস ও উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে ওই সব তরুণদের, যাদের বয়স ৩০ থেকে ৫০-এর মধ্যে, যাদের অনুপ্রেরণা হতে পারে থমাস সাঙ্কারার সাহসী নেতৃত্বগুণ ও সিদ্ধান্ত। জাতির বর্তমান প্রজন্ম ও বৃহত্তর অংশ যেন প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে শুরু করেছে কোনো এক সাঙ্কারার উত্থান ও নেতৃত্বের যিনি হবেন উন্নত নৈতিকতায় সমৃদ্ধ, দুর্বার গতিসম্পন্ন সাচ্চা এক দেশপ্রেমিক।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল