২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাজারে আগুন, নিভছে না পেটের আগুনও

- ছবি : সংগৃহীত

ব্যবসায়ীরা দামে জনগণকে ঠকাচ্ছে আর কর খাজনায় রাষ্ট্রকে ঠকাচ্ছে। জেতাচ্ছে তাদের সরকারি উচ্চ মহলের নীতিনির্ধারক ও আমলা-কামলাদেরকে। ভোক্তা জনসাধারণ কাউকে দুষতে পারছেন না। তারা নিয়তির ওপর সব ছেড়ে দিয়ে একবেলা বা আধাপেট খেয়ে উঠে পড়ছেন... দোষারোপের পানির ছিটায় বাজারের আগুন নিভবে না, পেটের আগুন নেবার তো প্রশ্নই ওঠে না।

প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়ে চলেছে। যে সব জিনিসের দাম বাড়ার কোনো যুক্তি নেই, সেগুলোর দামও বেড়েছে। সাধারণ মানুষ কি তাহলে উন্নয়নের বলি হচ্ছে? উন্নয়নের জোয়ারে অসাধারণদের বেহেশতবাস সম্ভব। কিন্তু সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষ, বিশেষ করে সীমিত আয়ের নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষদের জীবন কিভাবে কাটছে, অসাধারণরা কি সে ব্যাপারে সামান্যতম খেয়াল করছেন? বাজারে এক গাছ শোলা কচুর দাম যেখানে ৬০-৭০ টাকা সেখানে কচুঘেচু খেয়ে দিনাতিপাত করারই বা উপায় কোথায়? চাল, ডাল, সয়াবিন তেল, আলু, শাক-সবজি, মাছ-গোশত, সাবান-সোডা সব কিছুর দাম বেড়েছে। শুনছি চাল-ডালের দাম আরো বাড়বে। চাল নিয়ে তো রীতিমতো মহাকারসাজি শুরু হয়েছে।

অসাধারণ মানুষ জানে চালের বাজার নিয়ে কারা কী করছে? তারপরও সবাই চুপ! অসাধারণরাও চুপ, সাধারণ মানুষও চুপ! এ দেশ শ্রীলঙ্কা হবে না বলে যে সব ‘বেহেশতি’ মানুষ সগর্বে খুতবা দিচ্ছেন, তারাও জানেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি শ্রীলঙ্কার চূড়ান্ত বিপর্যয়কালের আগেকার সময়ের চেয়েও খারাপ যাচ্ছে। লক্ষণগুলো কিন্তু শ্রীলঙ্কার পুনরাবৃত্তির লক্ষণ নয়; তার চেয়েও ভয়াবহ পরিণতির দিকনির্দেশ করছে। ২০২৪ সাল থেকে যখন এত বড় বড় ঋণ সুদাসলে শোধ দেয়া শুরু হবে তখন বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ শূন্যের বদলে বিয়োগের ঘরে বা ‘মাইনাসে’ নেমে যেতে পারে, তখন কী হবে?

যারা বলছেন বাংলাদেশের মানুষ বেহেশতে আছে, তাদের অশিক্ষা, অজ্ঞতা কিংবা বিবেকহীন প্রবঞ্চনার জন্য করুণা করা যেতে পারে। কারণ বৈশ্বিক বিপর্যয়ের জন্য সব দেশে নিত্যপণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে, এটি সত্য। কিন্তু মূর্খেরা এটি জানে না যে, সব দেশে না হলেও বহু দেশে সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক সেবার আওতায় থাকে। তাদের জন্ম-মৃত্যু, সৎকার, বেকারত্ব, পঙ্গুত্ব, রোগজরা, শিক্ষা, বাসস্থান, বার্ধক্যসেবা সবই রাষ্ট্রের কল্যাণ কাঠামোর মধ্যে তথা ‘ওয়েলফেয়ার’ এর মধ্যে থাকে? শুধু নাগরিক নয়, তাদের পোষ্য, পরিজন, এমনকি গৃহপালিত পশু প্রাণী থাকলে মনিবের যদি আয় না থাকে, তাদের খাদ্য এবং রোগ বিমারির ব্যয়ভারও রাষ্ট্র বহন করে। সত্যি বলতে কি, ইউরোপ ও দূরপ্রাচ্যেও কল্যাণ-রাষ্ট্রগুলো দেখলে মনে হয় খলিফা ওমরের হুকুমত ওখানেই চলেছে আয় তথাকথিত ভণ্ড মুসলিম শাসনাধীন একনায়কতন্ত্র ও নামসর্বস্ব মুসলিম সংখ্যাগুরু দেশ বা আফ্রিকার বন্য-তন্ত্রগুলো চালাচ্ছে ‘দজ্জাল’ শাসকরা, যেখানে কল্যাণ বলতে কিছু নেই; আছে কেবল শোষণ, জুলুম, অবিচার, অন্যায়, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট, স্বজনতোষণ এবং কোষাগার গাঙ করে ফেলার অবিসংবাদিত চৌর্যবৃত্তি। প্রতিবাদ করলেই প্রতিবাদকারী মামলা-হামলার শিকার। কে প্রতিবাদ করবে? ব্রাদারহুড মিসরি জনগণের ভোটে ক্ষমতায় এসেছিল, পেরেছে কি টিকতে? মরক্কোর রাজবিরোধীদের ওপর কী চলছে? পাকিস্তানের জনপ্রিয় ইমরান সরকার আজ ক্ষমতাচ্যুত। লিবিয়া-সিরিয়া-ইরাক-লেবানন-ফিলিপাইন এসব দেশে দুর্ভিক্ষ এবং দুঃশাসন দেশগুলোকে হাবিয়া দোজখে পরিণত করেছে। পাঠক, বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না তো আর একটি দেশের নাম কেন করতে পারছি না? অথচ যুদ্ধ করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সে দেশে। অভাব অনটন ঘোচানোর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। গণতন্ত্রের জন্যই স্বাধীন হয়েছিল দেশটি। সে দেশের মানুষ আজ তাহলে এমন দুঃখকষ্ট ও দুঃশাসনের জিঞ্জিরে কয়েদবন্দী যেন?

বিশ্ববাজারে যখন তেলের দাম স্থিতিশীল ছিল, এমনকি হঠাৎ করে বেশ খানিকটা একেবারে কমেও এসেছিল, তখনই আমাদের দেশে এক দফা জ্বালানির দাম বাড়ানো হলো। কয়টা বিদ্যুৎকেন্দ্র ফার্নেস অয়েলে চলে যে, তেলের দামের দোহাই দিয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। এখন মূল্যস্ফীতির ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল দৌড়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিও অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে। এমনিতেই বিদ্যুৎ মাঙ্গা; তদুপরি অকল্পনীয় হারে ইউনিট রেট বৃদ্ধি!

মূল্যবৃদ্ধিও সিরিজ ওপেন হয়েছিল ভোজ্যতেল দিয়ে। ইন্দোনেশিয়া তেল রফতানি কমানোর অজুহাতে শতভাগ পর্যন্ত বাড়ানো হলো তেলের লিটার মূল্য। একই সাথে আইন করা হলো বাজারে খোলা তেল বিক্রি বন্ধ। যে সাধারণ পরিবারটি দিনান্তের ভূতের পরিশ্রম শেষে ২০০-৩০০ টাকা নিয়ে বাজারে যেতেন অন্যান্য নিত্যপণ্যের সাথে তারা ১০০ বা ২০০ গ্রাম খোলা তেল পলিতে মুখ বেঁধে ঘরে আনতেন ১০-২০ টাকার মধ্যে। তার দাম এখন ২৫ থেকে ৩০ টাকা। চাল কিনে পয়সা বাঁচলে তো তেল-নুন-মরিচ! যে আটা (লুজ) বিকাতো ছয় মাস আগেও ৩২ টাকা কেজি, এখন তার পাইকারি মূল্যই ৫২ টাকা। ভোজ্যতেল নিয়ে যা চলছে তাকে স্রেফ মাফিয়াচক্রের তৈরি নৈরাজ্য ছাড়া আর কোনো নামে ডাকার উপায় নেই।

রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো বণিক স্বার্থের প্রহরী। ট্যারিফ কমিশন শুধু ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করে বলে অভিযোগ আছে। ব্যবসায়ীরা দামে জনগণকে ঠকাচ্ছে আর কর খাজনায় রাষ্ট্রকে ঠকাচ্ছে। জেতাচ্ছে তাদের সরকারি উচ্চমহলের নীতিনির্ধারক এবং আমলা-কামলাদের। বিশ্ববাজারে যখন অপরিশোধিত পাম অয়েলের দাম বাড়ে তখন দরে স্থিতাবস্থা আনার দোহাই পেড়ে তারা ভ্যাট ছাড়, এলসি কমিশন, এলসি মার্জিন রেয়াতসহ বিস্তর সুযোগ-সুবিধা নিলো ঠিকই, কিন্তু দাম কমল না। ফলে বাজারে দাম কমার সামান্যতম লক্ষণও দেখা গেল না। ঠকেছে স্রেফে ভোক্তা, গরিব-দুঃখী সাধারণ মানুষ। ব্যবসায়ীদের যুক্তি আছে। তারা বলেছেন, জাহাজ ভাড়া বেড়েছে, ইন্স্যুরেন্স কভারেজের দাম বেড়েছে, ডলার কেনা যেতো ৮১-৮২ টাকায়, এখন তা ১১৫-১১৯ বা ১২০ টাকা। এলসি খুলেছি ডলারে। এখন ডলার নাগালেরও বাইরে। গত বছর তিন তিনবার সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হয়। এবার হবে চতুর্থ দফা মূল্যবৃদ্ধি। যুক্তির অভাব হবে না। ব্যবসায়ীদের যুক্তিই প্রতিধ্বনিত হবে সরকারের নেতাদের মুখে, কর্মকর্তাদের কাজে।

জিনিসপত্রের দামদরে এই উল্লম্ফন কেবল বাজারে নৈরাজ্যই সৃষ্টি করছে তাই নয়; একেকটি খাতে দাম বাড়ানোর ব্যাপারে একেক ধরনের ছুতা বা অজুহাত দেখান হচ্ছে। সেগুলোর দাম বাড়ার যুক্তি বিবেচনাযোগ্য সেগুলোর দাম যেমন বাড়ছে, যেগুলো মাঙ্গা হওয়ার কোনো যুক্তি নেই, সে সেগুলোরও দাম বাড়ছে। গোটা বাজার ব্যবস্থাপনায় এমন দেউলিয়াপনার কথা না কেউ শুনেছে আগে, না এটি সম্ভব বলে কেউ ভাবতে পেরেছে? অর্থাৎ বাজার বাস্তবতা সব বিচার-বিবেচনার বাইরে চলে গেছে। জ্বালানি তেল বা সারের দাম বেড়েছে এটি সত্য। তবে তার চেয়ে বহুগুণ বেড়েছে কাঁচা পণ্যের দাম। সবখানে চলেছে একে অন্যকে দায়ী করা বা দোষ চাপানোর ভয়ঙ্কর খেলা। কৃষক ও খুচরা ব্যবসায়ীরা দুষছেন পাইকারদেরকে। পাইকাররা বলছেন বহু হাত ঘুরে কাঁচাপণ্য বাজারে আসার কারণে পাইকারি ও খুচরা বেচাকেনার মধ্যে দামের ফারাক ঘটছে। এই হাত বদল কমাতে পারলে দাম কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে নামতে পারে বলে বাজার-সংশ্লিষ্টদের ধারণা। তাহলে এত সড়ক, সেতু, ঘাটলা-জেটি বানিয়ে মানুষ কী ফায়দা পেলো? বাজারে সরবরাহব্যবস্থার ওপর সরকারের কি সামান্যতম নজরদারিও নেই? কেন মানুষকে ৩০ টাকার সবজি ৮০-৯০ টাকায় কিনতে হবে? ভোক্তা জনসাধারণ কাউকে দুষতে পারছেন না। তারা নিয়তির ওপর সব ছেড়ে দিয়ে একবেলা বা আধাপেট খেয়ে উঠে পড়ছেন। দিনের বাকি সময় স্রেফে অভুক্তই থাকতে হচ্ছে অনেককে। বাজারে দামের আগুন আর জঠরে ক্ষুধার আগুন মিলে এক অসহনীয় দাবানল সৃষ্টি করছে। একবার দাম বেড়েছে করোনার দোহাইতে। একবার বাড়ল ইউক্রেন যুদ্ধের ছুতোয়। একবার বাড়ল জ্বালানি তেলের দাম উছিলায়। সরকারের কিছু করার নেই, এটি একবারেই গ্রহণযোগ্য যুক্তি নয়। দোষারোপের পানির ছিটায় বাজারের আগুন নিভবে না, পেটের আগুন নেভার তো প্রশ্নই ওঠে না।


আরো সংবাদ



premium cement
‘ফ্রি ভিসার গল্প’ আর শূন্য হাতে ফেরা লাখো শ্রমিক নোয়াখালীতে প্রবাসীর স্ত্রীর ব্যক্তিগত ছবি দেখিয়ে চাঁদা আদায় দেশের উন্নয়নে পাকিস্তান প্রশংসা করে, অথচ বিরোধী দল দেখে না : কাদের আশুলিয়ায় বাঁশবাগান থেকে নারী পোশাক শ্রমিকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার মিয়ানমারের কর্মকর্তারা ফেরত গেলেন, কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কট কি আরো জটিল হচ্ছে দিনাজপুরে দুই ট্রাকের সংঘর্ষ, চালক-হেলপার নিহত মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২ সখীপুরে বৃষ্টির জন্য অঝোরে কাঁদলেন মুসল্লিরা দক্ষিণ ভারতে কেন কাজ করেনি বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের নতুন আংশিক কমিটি বাংলাদেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসায় বিনিয়োগ সম্ভাবনা অন্বেষণে থাইল্যান্ডের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান

সকল